সমান সুযোগ সকলের তরে

১৭ এপ্রিল, ২০২৩। গোটা পৃথিবী জুড়ে পালিত হল ‘বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস’। জিনগত কারণে মানুষের দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হয়, রক্ত প্রাকৃতিকভাবে জমাট বাঁধে না। ডেকে আনে মৃত্যু। তাই এইসব রোগীর যত্ন ও তাদের চিকিৎসা যেন বিশ্বজনীন মানদণ্ডের হয়; আমাদের একত্রে সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে। লিখেছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

পটভূমি
ছোট বউয়ের শরীরটা দিনদিন কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, ফোলা-ফোলা ভাব, গাঁটে-গাঁটে ব্যথা, শুনলাম রাতের দিকে মাঝেমাঝে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছে; নয় মাসের পোয়াতি, রেডি হয়ে থাকতে হবে যে-কোনও দিন প্রসব হতে পারে।
ঠিক এই সময়েই বউমার শরীর খারাপ হতে হল! এই ঝড়-জলের রাতে, এখন আমি কী করে সব সামাল দিই— তা তো ভেবেই পাচ্ছি না— হ্যাঁ হ্যাঁ, আগে আশা দিদিমণিকে ডেকে পাঠাই, তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
হাসপাতালে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আয়া মাসি বলে গেলেন খোকা হয়েছে, তবে ডাক্তারবাবু যা বললেন তা শুনে আমাদের হুঁশ উড়ে গেছে। যদিও স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে তবুও এখনও পর্যন্ত বউমার নাকি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি! ওঁরা সব নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন—
ঘণ্টা দুয়েক পর জানলাম বউমা এখন আপাতত সুস্থ, তবে তিনি হিমোফিলিয়া জিন-বাহক। ডাক্তারবাবুরা সকলে মিলে পরীক্ষা করে দেখছেন সদ্যোজাত বাচ্চাটি হিমোফিলিয়া (Haemophilia) আক্রান্ত কি না—।
আমাদের তো সকলের মাথায় হাত!

কী এই হিমোফিলিয়া
হিমোফিলিয়া (Haemophilia) হল এমন এক জিনগত অসুখ যার কারণে মানবদেহের স্বাভাবিক রক্ত তঞ্চন প্রক্রিয়া দারুণভাবে ব্যাহত হয়। রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না, অনর্গল রক্ত ক্ষরণ হয়, এমনকী খুব সামান্য আঁচড় লাগলেও। শরীরের ভিতর ও বাহির উভয় জায়গা থেকেই রক্ত ঝরে পড়তে পারে, হঠাৎ করে। এর ফলে শরীর বিবর্ণ হয়ে পড়ে, গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হতে পারে, ফোলা-ফোলা ভাব, তীব্র যন্ত্রণা, অবচেতন হয়ে পড়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, দৈহিক বিকৃতি, ঝিমুনি, অমনোযোগী হয়ে পড়া ও এমনকী মৃত্যুও হতে পারে।

কেন হয় এই হিমোফিলিয়া
যদিও এটি একটি দুষ্কর রোগ, সচরাচর এর প্রকোপ দেখা যায় না। তবে যে-সমস্ত মানুষের দেহে লিঙ্গ নির্ধারণকারী এক্স-ক্রোমোজোম অস্বাভাবিক হয় এবং ওই ক্রোমোজোমে উপস্থিত রক্ত তঞ্চনে সাহায্যকারী জিনসমূহে পরিব্যপ্তি দেখা যায়, তাদের দেহে হিমোফিলিয়া (Haemophilia) জিন বর্তমান। সাধারণত নারীরা এই জিনের বাহক হয়ে থাকেন এবং পুরুষেরা অধিকাংশ সময় আক্রান্ত হন। যদি একজন বাহক-মা ও একজন অনাক্রান্ত-বাবা মিলিত হন তাহলে তাঁদের পুত্রসন্তান হলে তারা হয় হিমোফিলিয়া আক্রান্ত হবে— নয় অনাক্রান্ত হবে, কিন্তু যদি কন্যাসন্তান হয় তবে তারা কেউই আক্রান্ত হবে না; হয় বাহক হবে নয় অনাক্রান্ত হবে। কিন্তু যদি একজন আক্রান্ত-বাবা ও একজন অনাক্রান্ত-মা মিলিত হন তাহলে পুত্রসন্তান হলে তারা প্রত্যেকেই অনাক্রান্ত হবে এবং কন্যাসন্তান হলে তারা প্রত্যেকেই বাহক হবে।

রক্ত তঞ্চন কী
মানবদেহের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অংশ বিশেষ। রক্ত আমাদের শরীরকে সুস্থ ও সচল রাখে, কিন্তু কোনওরকম দুর্ঘটনায় কিংবা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে শরীরের উপরিভাগে কেটে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই রক্ত বের হয়, আবার প্রাকৃতিক ভাবে সঙ্গে সঙ্গেই সেই রক্ত জমাট বেঁধে যায় ফলে আর রক্তক্ষরণ হয় না। এই হল রক্ত তঞ্চন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রক্তের মধ্যে উপস্থিত অণুচক্রিকা। অণুচক্রিকাই রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এই কাজে অণুচক্রিকাকে সাহায্য করে তন্তুজাতীয় একটি প্রোটিন, নাম তার ফিব্রিন। ফিব্রিনকে তার কাজ করতে সাহায্য করে ফ্যাক্টর-৮, ফ্যাক্টর-৯, ফ্যাক্টর-১১, ফ্যাক্টর-৫, ফ্যাক্টর-১৩ নামে প্রভৃতি জিন। এরা ফিব্রিন প্রোটিনকে আড়াআড়ি সংযুক্ত করে শক্ত ও সংকুচিত করে তোলে, ফলস্বরূপ অণুচক্রিকা-গুচ্ছের উপর একটি প্রোটিনের জালি তৈরি হয় যা ক্ষতস্থানের কোষগুলোকে উত্তেজিত করে এবং পার্শ্ববর্তী কোষের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। এভাবেই তঞ্চন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ওই ফ্যাক্টর জিনগুলোর সংখ্যা কমে গেলেই রক্ত আর ঠিকঠাক জমাট বাঁধে না; তখনই মানুষ হিমোফিলিয়া আক্রান্ত হয়।

কত রকমের হয়
সাধারণত হিমোফিলিয়া দুই প্রকারের— যে-সমস্ত মানুষের দেহে রক্ত তঞ্চনে সাহায্যকারী ফ্যাক্টর-৮ জিনের সংখ্যা যথেষ্ট নয় তারা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত; সচরাচর প্রায় প্রতি ৫০০০ জনের মধ্যে একজন এই বিশেষ ধরনের হিমোফিলিয়ায় (Haemophilia) আক্রান্ত হন। যাদের দেহে ফ্যাক্টর-৯ জিনের সংখ্যা যথেষ্ট নয় তারা হিমোফিলিয়া-বি আক্রান্ত। এই ধরনের রোগীর সংখ্যা প্রায় প্রতি ২০,০০০-এ একজন। এ-ছাড়াও লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম বাদে অন্য ক্রোমোজোমে ফ্যাক্টর-১১-র অভাবজনিত হিমোফিলিয়া-সি এবং ফ্যাক্টর-৫ এর অভাবজনিত প্যারাহিমোফিলিয়াও দেখা যায়। দেহস্থিত অ্যান্টিবডির স্বতঃপরিব্যাপ্তি জনিত ফ্যাক্টর-৮-এর ঘাটতির দরুন অর্জিত হিমোফিলিয়া খুবই দুষ্কর কিন্তু মারাত্মকভাবে জীবনদায়ী!

আরও পড়ুন: এবার আটহাজারি অন্নপূর্ণা শিখরে বাংলার পিয়ালি

চিকিৎসা ও চর্চা
এই রোগ মা ও প্রসূতি, জোয়ান ও মাঝবয়সি সকলের হয়ে থাকে। পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে ‘রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’র মাধ্যমে সুঁই দিয়ে ফ্যাক্টর জিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে রোগীদের সুস্থ করে তোলা হয়। একটি রক্ত পরীক্ষা মানবদেহে এই রোগের উপস্থিতি জানান দিতে পারে, তাই এ-বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা গড়ে তুলতে সারা দুনিয়া জুড়ে প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল পালিত হয় ‘বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস’। ১৯৮৯ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া-র পক্ষ থেকে এই দিনটি পালিত হচ্ছে।

ভারতবর্ষ ও হিমোফিলিয়া
১৯৬৩ সালে ফ্রাঙ্ক স্ন্যাবেল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া-র ২০১৭ সালের বার্ষিক বৈশ্বিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রতিবছর ১.৯৬ লক্ষ লোক হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হন। তবে দেশের হিসেবে ভারতবর্ষে সর্বাধিক সংখ্যক, বাৎসরিক প্রায় ১৯,০০০; অনুমান করা হয় আমাদের দেশে প্রায় আশি শতাংশ ঘটনাই অনিবন্ধিত, প্রকৃত সংখ্যা নাকি প্রায় ২ লক্ষের কাছাকাছি। এই উদ্দেশ্যে ভারত সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় সকলের জন্য বিনা পয়সায় রক্ত পরীক্ষার সুব্যবস্থা করেছে এবং দ্য ন্যাশনাল পলিসি ফর রেয়ার ডিজিজ-২০২১-এর মাধ্যমে সকল মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে স্বেচ্ছায় অর্থ ও পরিষেবা প্রদান করার জন্য।

Latest article