রূপকথায় মোড়া ময়ূরভঞ্জ

সে যেন এক রূপকথার জগৎ। সেই জগতে আছে সবুজ জঙ্গল, নীল আকাশ, পাহাড় আর পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে নেমে আসা ঝরনা। দেখে মনে হবে যেন সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত যুবতী। খিলখিল করে হাসতে হাসতে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসছে। এই রূপকথার জগতে আরও অনেক কিছু তথা ঐতিহ্যশালী সংস্কৃতি, প্রাচীন মন্দির ইত্যাদি আছে। আর এখানেই বিশ্বের একমাত্র বিরল প্রজাতির কালো বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। জায়গাটি হচ্ছে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ। ময়ূরভঞ্জে প্রকৃতি দু হাত খুলে উজাড় করে দিয়েছে তার সমস্ত সৌন্দর্য। লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

ওড়িশার অন্যতম জেলা ময়ূরভঞ্জ (Mayurbhanj Odisha)। পাহাড়-পর্বত অরণ্যে ঘেরা। পর্যটকদের কাছে এক স্বর্গ রাজ্য। ময়ূরভঞ্জের সদর শহর বারিপদা। এই বারিপদাকে কেন্দ্র করেই ঘুরে নেওয়া যেতে পারে গোটা ময়ূরভঞ্জ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া এই অঞ্চলে আছে বেশকিছু দেখার মতো জায়গা।

কিচকেশ্বরীর মন্দির
সবুজ প্রকৃতির বুকে ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূরভঞ্জের রাজপ্রাসাদ। ১৮০৪ সালে মহারানি সুমিতাদেবী ভঞ্জ এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। অবশ্য বর্তমানে এই রাজপ্রাসাদে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন সাধারণ পর্যটকেরা। অরণ্যে ঘেরা রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য যাতে সাধারণ পর্যটকেরা উপভোগ করতে পারে তার জন্য এই ঐতিহাসিক রাজবাড়িটিকে একটি বিলাসবহুল হোম-স্টে বানানো হয়েছে।
অতীতকালে এই ময়ূরভঞ্জ (Mayurbhanj Odisha) রাজ্যের প্রতীক ছিল দুটি ময়ূর। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, দশম শতকে ময়ূরভঞ্জ রাজাদের রাজধানী ছিল খিচিং। এই ভঞ্জ রাজাদের গৃহদেবতা ছিলেন কিচকেশ্বরী। খিচিং-এ অবস্থিত দেবী কিচকেশ্বরীর মন্দির আজও তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ১৩৬০ বা ১৩৬১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ভঞ্জ রাজাদের রাজধানী খিচিং আক্রমণ করে সেটা তছনছ দেয়। এরপরে ভঞ্জ রাজারা বাধ্য হয়ে হরিপুরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তবে রাজধানী সরে গেলেও খিচিং-এর কিছু মানুষ সেখানে বসতি স্থাপন করে জনপদ গড়ে তোলেন এবং ভঞ্জ রাজাদের কুলদেবীকে একটা ছোট্ট ঘরে স্থাপন করে সেখানে পুজো শুরু করেন। পরে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট এই মন্দিরের কথা জানতে পেরে দেবী কিচকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সেই মন্দির তৈরি শেষ হয়। এর পরের বছর সেই মন্দিরে দেবী কিচকেশ্বরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়। তখন ময়ূরভঞ্জরাজ ছিলেন প্রতাপচন্দ্র ভঞ্জদেও।

তাই ময়ূরভঞ্জ ঘুরতে গেলে এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি দেখতে ভুলবেন না। বারিপদা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দির আজও পর্যটকদের কাছে টানতে সক্ষম। এছাড়াও—
মা অম্বিকা মন্দির
বারিপদাতে অবস্থিত মা অম্বিকার মন্দির। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই দেবী প্রচণ্ড জাগ্রত। এই মন্দিরের পাশেই অবস্থিত দেবকুণ্ড। এই দেবকুণ্ড হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পুকুর। পাশেই প্রবাহিত একটি জলপ্রপাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই দেবকুণ্ড। অনেকটা উঁচুতে। এই দেবকুণ্ড পিকনিকের জায়গা হিসাবে প্রসিদ্ধ।

জগন্নাথদেবের মন্দির
বারিপদার একটি দর্শনীয় স্থান জগন্নাথদেবের মন্দির। পুরী ছাড়াও এই বারিপদাতেও জগন্নাথ মন্দির রয়েছে। তবে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের যেদিন রথযাত্রা পালন করা হয় তার ঠিক একদিন পরে এই বারিপদার জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রা পালন হয়।

আরও পড়ুন: শাহজির খোয়াবনামা অতঃকিম ঘোড়ার ডিম

সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান
ময়ূরভঞ্জ রাজারা মৃগয়ায় যেতে খুব পছন্দ করতেন। অতীতে তাঁরা যে মৃগয়াভূমিতে নিজেদের শখ পূরণ করতে যেতেন সেটা বর্তমানে ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান সিমলিপাল রূপে পরিচিত। পূর্বঘাট পর্বতমালায় অবস্থিত সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে আছে বন্যপ্রাণী, আকাশ ছোঁয়া শৈলশিখর, সবুজ পার্বত্য উপত্যকা, জলপ্রপাত ইত্যাদি। অর্থাৎ পাহাড়-পর্বত নদী জলপ্রপাত ঘেরা একটি আকর্ষণীয় অভয়ারণ্য হচ্ছে সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান। এই জাতীয় উদ্যানে গেলে চোখে পড়বে চিতাবাঘ, হাতি, সাম্বার, পেঙ্গলিন-সহ পাখি সরীসৃপ ইত্যাদি। এই জঙ্গলে একটি ব্যাঘ্র সংরক্ষণাগার আছে যেটি বর্তমানে ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীন। ১৯৯৪ সালে সিমলিপালকে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে ঘোষণা করে ভারত সরকার। এই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে গেলেই ছোট ছোট আদিবাসী জনগোষ্ঠী-সমৃদ্ধ গ্রাম চোখে পড়বে। আর সেই গ্রামগুলোর শোভা অতুলনীয়। জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে বরাহিপানি এবং জোরান্ডা পাহাড়। পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের ওপর সূর্যের রশ্মি এসে যখন পড়ে তখন সেটি হয়ে ওঠে স্বর্গের মতো সুন্দর।

জলপ্রপাত
এই সিমলিপালেই রয়েছে দুটি জলপ্রপাত জোরান্ডা এবং বারহিপানি জলপ্রপাত। জোরান্ডা ৫৯৪ ফুট ওপর থেকে এবং বারিপানি ৭১২ ফুট ওপর থেকে নিচে পড়ছে। জলপ্রপাত দুটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এ-ছাড়াও ময়ূরভঞ্জে দেখা মেলে, ভীমকুণ্ড জলপ্রপাতের। বৈতরণী নদীর ওপরে অবস্থিত এই ভীমকুণ্ড। কথিত আছে ভীম নাকি এখানে স্নান করতেন । আর সেই কারণেই এটির নাম হয়েছে ভীমকুণ্ড। ভীমকুণ্ডর সামনে ভীমের একটি বড় মূর্তি রয়েছে। ভীমকুণ্ড দেখে যাওয়া যেতেই পারে রামতীর্থ। রামতীর্থ পার্কে গড়ে উঠেছে ক্রোকোডাইল রিসার্চ সেন্টার। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খয়েরি নদী। বনবাসে থাকাকালীন রামসীতা আর লক্ষ্মণ নাকি রামতীর্থে এই খয়রি নদীর তীরেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান, ভঞ্জ রাজাদের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ, দেবকুন্ড, ভীমকুণ্ড, আদিবাসী গ্রাম, জলপ্রপাত, বন্যপ্রাণী সব এক জায়গায় দেখার জন্য কলকাতা থেকে সড়কপথে মাত্র কয়েক ঘণ্টা দূরত্বের স্বর্গরাজ্য ময়ূরভঞ্জে (Mayurbhanj Odisha) যেতেই হবে।

কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে সড়কপথে নিজস্ব গাড়ি বা এসপ্ল্যানেড থেকে বাসে করে অথবা শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বারিপদা পৌঁছনো যায়।

কোথায় থাকবেন?
বারিপদাতে অনেক ভাল হোটেল আছে। সেখানেই থাকতে পারেন। এ-ছাড়া একদিন রাজকীয় ভাবে থাকার জন্য ময়ূরভঞ্জ রাজপ্রাসাদ বেছে নেওয়া যেতেই পারে। এ-ছাড়াও সিমলিপালে প্রচুর হোটেল ও রিসর্ট রয়েছে। সেখানে রাত্রিযাপন সুখকর হবে।

Latest article