খাদ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার কোনও দয়ার দান নয়

নাগরিকদের অধিকারকে সরকারের বদান্যতায় পরিণত করার ফন্দি এঁটেছে মোদি সরকার। এজন্যই খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় থাকা রেশন প্রকল্পটির নাম বদলে প্রধানমন্ত্রী গরিব অন্ন সুরক্ষা যোজনা করার উদ্যোগ। ওদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিতে কলম ধরলেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

খাদ্যের (Right to Food) অধিকার মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বে এই অধিকার মানুষ পেয়েছিলেন। জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে। এই আইনের আওতাধীন রেশন গ্রাহকদের এতদিন স্বাভাবিক বরাদ্দের চাল ৩ টাকা, গম ২ টাকা ও মোটা দানাশস্য (রাগি, বাজরা ইত্যাদি) ১ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করত কেন্দ্রীয় সরকার। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, খাদ্যসাথী প্রকল্পের অধীনে ২ টাকা দরে রেশনের মাধ্যমে রাজ্যবাসীকে খাদ্যশস্য বিলি শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে। প্রশ্নটি ছিল, অধিকারের। খাদ্য সুরক্ষা আইন সকলের জন্য। যিনি চাইবেন, তাঁকেই দিতে হবে। কারণ আইনের চোখে সবাই সমান। মমতা বন্দ্যােপাধ্যায় এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন। এরই সঙ্গে তিনি একথা সামনে আনেন যে, মৌলিক অধিকার হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিলে এই গরিব দেশে স্বল্পমূল্যই বা নেওয়া হবে কেন? বিনামূল্যে খাদ্যের অধিকার (Right to Food) থাকা উচিত। পরে তা তিনি চালু করেন।

এরপর করোনা অতিমারির কারণে ২০২০ সালে এপ্রিল মাস থেকে চালু হয় ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’। এর মাধ্যমে বিনামূল্যে ৮১ কোটি ৩৫ লক্ষ গরিব মানুষকে ৫ কেজি অতিরিক্ত খাদ্যশস্য দেওয়া শুরু হয়। শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রকল্পটিকে বারবার সময়-নির্দিষ্ট করার প্রচেষ্টাও চলতে থাকে। বারবার তাই রিনিউ করতে হয় প্রকল্পটিকে। অধিকারের বাইরে এনে ‘গরিব-কল্যাণের’ দয়া-দাক্ষিণ্যের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় খাদ্যের অধিকারকে। তবে এর মাধ্যমে অন্তত এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, দেশে ৮১ কোটি ৩৫ লক্ষ গরিব মানুষ আছে। অপরদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দেন যে, তিনি যতদিন মুখ্যমন্ত্রী আছেন ততদিন বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ ব্যবস্থা চলবে খাদ্যসাথী হিসেবে। এখানে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ বা গরিব-কল্যাণের ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় বদান্যতার কোনও ভাবনা নেই। যা আছে তা হল সামাজিক ন্যায়ের ধারণা।

করোনার প্রকোপ কমতে থাকলে, ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব-কল্যাণ অন্ন যোজনা’ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বারবার তোলা হচ্ছে। বিরোধীদের চাপে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই কেন্দ্রীয় সরকার এবার কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেই কৌশলের মূল কথা হল, খরচ বিশেষ বাড়বে না কিন্তু কৃতিত্ব মিলবে ষোল আনাই। এটা বুঝেই নরেন্দ্র মোদি সরকার পুরোপুরি নিখরচায় রেশন বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। বিজেপি নেতারা জোর গলায় বলতে শুরু করেছে, মোদি সরকার রেশন ফ্রি করে দিল। বিরাট কৃতিত্ব! প্রশ্ন উঠেছে, ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’-এর আওতায় যা ছিল, তাকে কেন, ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব অন্ন সুরক্ষা যোজনা’— এই নতুন নাম দেওয়ার কথা উঠেছ? এর মধ্যে দিয়ে কি আইনি অধিকারকে লঘু করে দেওয়া হচ্ছে না? অধিকারকে (Right to Food) কি রাষ্ট্রীয় বদান্যতায় পরিণত করা হচ্ছে না? তার পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নিখরচায় যেটুকু রেশন দেওয়া হবে, তার পরে কি বিনামূল্যে অতিরিক্ত ৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়ার প্রকল্পটি থাকবে, না উঠে যাবে? উঠে গেলে সরকারের বাড়তি কৃতিত্ব বলে আর কিছু তো থাকল না। তা হলে গোটা বিষয়টা তো দাঁড়াল এককথায় লোক ঠাকানো। তার পরের প্রশ্ন হল, খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় থাকা রেশন ব্যবস্থায় নিখরচায় যে চাল-গম দেওয়া হবে— তা এক বছরের জন্য কেন? খাদ্য সুরক্ষা আইন তো এক বছরের জন্য নয়! তাহলে কি আইনটাকে তুলে দেওয়া হবে? না-কি শুধুমাত্র অতিরিক্ত ৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়ার প্রকল্পটি তুলে দেওয়ার জন্যই এটা একটা নির্বাচনী কৌশল মাত্র? চব্বিশ সালে নির্বাচন। তার আগে ধুয়ো তোলা যাবে— মোদি সরকার রেশন ফ্রি করে দিয়েছে, তাই বিজেপিকে ভোট দাও। প্রশ্নগুলির কোনও সদুত্তর নেই বিজেপি নেতাদের কাছে। তাই সবটা কেমন যেন ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে যা হচ্ছে তার মধ্যে নির্বাচনী গন্ধটাই প্রবল। মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব নেওয়াটাই হল আসল কথা। এ তো একটা বড় ধরনের জালিয়াতির মতো।

আরও পড়ুন-উন্নয়নের কোনও দেশীয় সীমারেখা থাকতে পারে না

আসলে এ-সবের মাধ্যমে কয়েকটি সরল সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে। সাধারণ ভাবে দেখলে বলা যায়, রাষ্ট্র যা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে পারে না— সেটাই মানুষের অধিকার। এখানে কোনও বদান্যতার জায়গা নেই। কোনও রাজা-প্রজার স্থান নেই। আইনের দ্বারা স্বীকৃত কোনও নাগরিক অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। খাদ্য একটি নাগরিক অধিকারের বিষয়। ৮০ কোটিরও বেশি গরিব মানুষকে আগামী এক বছর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়ার বিষয়টি নাগরিকের সেই অধিকারটি স্বীকার করে নিল। খাদ্যশস্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে পূবর্বতন ইউপিএ সরকার যে পথে হেঁটেছিল, প্রায় এক দশক পরে হলেও মোদি সরকার সেই পথের ধারাবাহিকতা বজায় রাখল। কিন্তু সেকথা বলা যাচ্ছে না। কারণ এই সিদ্ধান্তটির মধ্যে ভোটের গন্ধ বড় বেশি প্রকট। নরেন্দ্র মোদি সাধারণ মানুষের খাদ্যের অধিকারকে বড় বেশি গুরুত্ব দেন, অতিমারির ধাক্কা লাগার আগে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং এ-ধরনের প্রকল্পকে তিনি অপছন্দই করতেন বলে আমরা জানি। লোকসভা ভোটের আগে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বণ্টনের সিদ্ধান্তটির পিছনে কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্তব্য বা নাগরিকের অধিকার সম্বন্ধে বোধ যতটা, সন্দেহ হয় তার চেয়ে বেশি রয়েছে অন্নদাতা হিসেবে আত্মপ্রচারের বিশেষ তাগিদ।
সরকার এই সিদ্ধান্তটি গরিব মানুষের প্রতি ‘নতুন বছরের উপহার’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ সরকার এই সিদ্ধান্তটিকে নাগরিকের অধিকার হিসেবে নয়, দেখছে সরকারের বদান্যতা হিসেবে। উৎসবের দিনে প্রজাকে ‘উপহার’ দেওয়া রাজতন্ত্রের অভ্যাস বলে আমরা জানি। এটা গণতন্ত্রের অভ্যাস নয়। এভাবেই মোদি-রাজত্বে নাগরিকের অধিকারকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হচ্ছে।

এ-কথা জোরের সঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের যা প্রাপ্য, তা ক্ষমতাসীন দলের বদান্যতার উপর নির্ভর করে না। চিন্তার বিষয় হল, গোটা দুনিয়াতেই নরেন্দ্র মোদির মতো কতৃর্ত্ববাদী শাসকরা অধিকারের প্রশ্নটিকে সরকারের বদান্যতায় নামিয়ে এনেছেন। এই ধরনের শাসকরা রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের অধিকার স্বীকার করে না। মোদি-রাজত্বে সেটাই বারবার প্রমাণ হচ্ছে। নাগরিকের অধিকার নিয়ে এঁদের মাথাব্যথা নেই, নাগরিকের কর্তব্য নিয়েই এঁদের যত চিন্তা।

Latest article