চলুন রথের মেলায়

ওড়িশার পুরীর রথ জগদ্বিখ্যাত। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত হয় রথযাত্রা উৎসব। বসে জমজমাট মেলা। প্রচুর লোক সমাগম। আগামিকাল ১ জুলাই, রথের দিন। চাইলে যে-কোন‌ও রথের মেলায় ঘুরে আসতে পারেন। রাজ্যের ৪ জেলার ৪টি উল্লেখযোগ্য রথের মেলার উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

মাহেশ
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাধারানী’ উপন্যাসে পাওয়া যায় মাহেশের রথযাত্রার উল্লেখ। হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রার ইতিহাস প্রায় ৬০০ বছরের। জানা যায়, ধ্রুবনন্দ ব্রহ্মচারী এখানে জগন্নাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাহেশের নামকরণ করেছিলেন নব নীলাচল। মাহেশ রথযাত্রার (West Bengal Rath Yatra) সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের শিষ্য কমলাকার পিপলাইয়ের হাত ধরে। ১৭৫৫ সালে কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে নতুন জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন। যা আজও বর্তমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রথেরও পরিবর্তন হয়েছে। মাহেশের বর্তমান রথটির উচ্চতা ৫০ ফুট। ওজন ১২৫ টন। আছে মোট ১২টি লোহার চাকা। ৯টি চূড়া এবং দু’টি তামার ঘোড়া। রথযাত্রা উপলক্ষে স্নানপিঁড়ি ময়দানে এক মাস ধরে বসে মেলা। দূর-দূরান্তের বহু মানুষ আসেন। টান দেন রথের রশিতে। হিন্দুদের পাশাপাশি আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন অন্য ধর্মের মানুষও। জিলিপি, পাঁপড় ভাজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদা, গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিভিন্ন সময় এসেছেন এই মেলায়। বহুকাল ধরেই মাহেশের রথযাত্রার নাম সর্বত্র গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। করোনার জন্য ২ বছর গড়ায়নি রথের চাকা। আশা করা যায়, এইবছর দেখা যাবে মেলার পুরনো চেহারা।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে শ্রীরামপুর। স্টেশন থেকে রিকশা, অটো অথবা টোটোয় মাহেশ।

মায়াপুর
নদিয়া জেলার মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা বহুদিনের। রথযাত্রা উপলক্ষে উল্টোরথ পর্যন্ত এখানে বসে জমজমাট মেলা। আয়োজিত হয় সামাজিক এবং ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান। ২ বছর করোনার জন্য আয়োজন ছিল আড়ম্বরহীন। এবার রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে সাড়ম্বরে। তবে সতকর্তার সঙ্গে। এখানে রথের সময় পুরী থেকে আনা হয় বলরামের রথের চাকা। সেটা দেখার জন্য প্রচুর লোকসমাগম হয়। জানা যায়, মায়াপুর এবং পার্শ্ববর্তী রাজাপুরের বহু মানুষ ছিলেন বৈষ্ণব। প্রায় পাঁচশো বছর আগে এখানে থাকতেন এক পুরোহিত। তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেন, রাজাপুর থেকে মায়াপুরে প্রস্থান করবেন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। তারপর সেখান থেকে রথে চড়ে তাঁরা ফিরে আসবেন। সেই প্রথামতোই প্রতিবছর মায়াপুর ও রাজাপুরে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে নবদ্বীপ। নবদ্বীপ থেকে মায়াপুর খুব কাছেই। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে কৃষ্ণনগরে নেমেও মায়াপুর যাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: মেঘালয়ে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মিসড কল দিন ৯৬৮৭৭৯৬৮৭৭ নম্বরে

সিহারসোল
পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জ। অঞ্চলটি বিখ্যাত কোলিয়ারি বা কয়লা খনির জন্য। রানিগঞ্জের সিহারসোলে আছে বহু পুরনো রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির স্কুলের ছাত্র ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সিয়ারসোলের রানি হরসুন্দরী দেবীর উদ্যোগে সিয়ারসোলে তৈরি হয় কাঠের রথ। একটা সময় সেই রথ আগুনে পুড়ে যায়। পরে ১৯২৩ সালে রাজ পরিবারের প্রমথনাথ মালিয়ার উদ্যোগে তৈরি হয় সুদৃশ্য পিতলের রথ। সেই থেকে চলে আসছে রথযাত্রা উৎসব। কেমন দেখতে রথটি? ৯টি চূড়া। উচ্চতা ৩০ ফুট। তিনতলা। সামনের দিকে প্রথম তলে আছে প্রবেশপথ। ভেতরে গা বরাবর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায়। পিতলের এই রথটি আকৃষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের। রথের গায়ে স্থায়ীভাবে সাজানো আছে রামায়ণ, মহাভারত, পৌরাণিক, কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নানা মূর্তি। যেমন, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা, কালী, সিংহবাহিনী, অন্নপূর্ণা, বিষ্ণু, সীতাহরণ, রাধাকৃষ্ণ, জগাই-মাধাই, গৌর-নিতাই, বিষ্ণুর দশাবতার, দক্ষিণা কালী, বকাসুর বধ, কালীয়দমন, রাম-সীতা-রাবণ প্রভৃতি। রথযাত্রার দিন রথের সামনের দিকে সাজানো হয় দুটি ঘোড়া, সারথি ইত্যাদি। তারপর বসানো হয় গৃহদেবতা দামোদরচন্দ্রকে। আগে রথটি টানত মানুষ। বর্তমানে ট্রাকের সাহায্য নেওয়া হয়। সোজা রথের দিন নতুন রাজবাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো রাজবাড়িতে। উল্টোরথের দিন আবার ফিরিয়ে আনা হয়। জানা গেছে, এখন রাজবাড়ির পরিবর্তে, সিয়ারসোল স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন রথযাত্রা উৎসব পরিচালনা করে। যদিও রথের দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন রাজবাড়ির সদস্যরাই। রথযাত্রা উপলক্ষে বসে জমজমাট মেলা। দুই বছর করোনার পর এবার আবার মেলা সেজে উঠবে।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে রানিগঞ্জ। স্টেশনে নেমে টোটো, রিকশায় সিহারসোল রাজবাড়ি।

মহিষাদল
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল। এখানকার রথযাত্রা (West Bengal Rath Yatra) সুপ্রাচীন। আয়োজিত হয় রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। জানা যায়, ১৭৭৬ সালে মহিষাদলের রানি জানকীদেবী এই রথযাত্রার সূচনা করেন। রথের উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। ধ্বজা এবং কলস দিয়ে সাজানো হলে ৫০ ফুটের বেশি হয়ে যায়। আগে ছিল সতেরো চূড়া। বর্তমানে কমে তেরো চূড়া। চাকার উচ্চতা ৪ ফুট। বেধ ৮ ইঞ্চি এবং পরিধি ১২ ফুট। রথের কারুকার্য অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। চোখ ফেরানো যায় না। দেশীয় শিল্পীর পাশাপাশি আছে বিদেশি শিল্পীর ছোঁয়া। রথটি মূলত মদনগোপাল জিউ-এর রথ নামে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে থাকেন জগন্নাথ ও রাজবাড়ির শালগ্রামশিলা শ্রীধর জিউ। রথ উপলক্ষে বসে জমজমাট মেলা। বহু মানুষের সমাগম হয়। আসেন জেলার বাইরের মানুষরাও। ভিড় সামলাতে তৎপর থাকেন প্রশাসন। গত দুই বছর অতিমারির কারণে করা হয়েছিল শুধুমাত্র নিয়মরক্ষা। তবে এই বছর আগের মতোই দেখা যাবে উৎসবমুখর পরিবেশ।
কীভাবে যাবেন : কলকাতা ও হাওড়া থেকে হলদিয়াগামী যে কোনও বাসে মহিষাদল নামতে হবে। ট্রেনে হাওড়া থেকে হলদিয়া লোকাল। মহিষাদল স্টেশনে নেমে টোটো।

Latest article