মাকে স্বপ্নে দেখি
আমার মা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত দু’বছর হল চলে গেছেন। এখনও থিয়েটারের যে কোনও কাজ করতে গেলে সর্বপ্রথম তাঁর কথা আমার মনে আসে। সে রিহার্সাল করার সময়ই হোক বা একা নাচ করার সময়। মাঝেমধ্যেই আমি মাকে স্বপ্নে দেখি। দেখি, উনি আমাদের সঙ্গে নাটকের রিহার্সাল করছেন। আরও অনেক কিছু দেখি, অনেক ভাবে দেখি। তাই আমার মনে হয়, মা আমাকে ছেড়ে যাননি। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে আছেন। এই অনুভূতিটা থেকে আমি কোনওদিন মুক্ত হতে চাই না। যদিও অনেকেই আমাকে এটা থেকে বেরোতে পরামর্শ দেন। জানি না সেটা কীভাবে সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন-১২৭ বছরের বৃদ্ধার আশীর্বাদ-সহ জনসংযোগ যাত্রার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা অভিষেকের
ছবি দেখি না
মা তো শুধু আমার মা ছিলেন না। তিনি আমার কলিগ ছিলেন। একজন শিল্পী ছিলেন। মায়ের শিল্পীসত্তাটাকে আমি নান্দীকারে খুব মিস করি। মায়ের কাজের তাগিদ ছিল সাংঘাতিক। ছিলেন প্রচণ্ড রাগী। রিহার্সালে মাঝেমধ্যেই রেগে যেতেন। এটা আমি, সপ্তর্ষি এবং দলের আরও কয়েকজন পেয়েছি। মায়ের ওই কাজের তাগিদ, ওই রাগটা আমি প্রতি মুহূর্তে খুব মিস করি। বাড়িতে মায়ের ছবি আছে। তবে চট করে আমি সেই ছবির দিকে তাকাই না। ভয় নয়, খুব কষ্ট হয়। কীরকম কষ্ট বলতে পারব না। তবে হয়। তখন মনে মনে মায়ের মুখ ইমাজিন করি।
আরও পড়ুন-২৪-এ মোদিকে দিল্লি ছাড়া করার হুঙ্কার তৃণমূল সুপ্রিমোর
নিউ মার্কেট এবং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট
মা ভীষণ চাইনিজ খেতে ভালবাসতেন। অনেকের সঙ্গেই যেতেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। শপিং মলে যেতে পছন্দ করতেন না। নিউ মার্কেট ছিল খুব প্রিয়। ২২ মে মায়ের জন্মদিন। প্রতিবছর ওই দিন মা এবং আমি নিউ মার্কেটে যেতাম। বিছানার চাদর, জানলার পর্দা ইত্যাদি ঘরের জিনিসপত্র কিনতাম। কেনাকাটা হয়ে গেলে একটা রেস্টুরেন্টে জমিয়ে দুজনে মিলে চাইনিজ খেতাম। দু’বছর হল মা নেই। আমি কিন্তু মায়ের জন্মদিনে গেছি নিউ মার্কেটে। মায়ের পছন্দের দোকানে কেনাকাটা করেছি। খেয়েছি চাইনিজ। গতবছর আমার সঙ্গে সপ্তর্ষি ছিল। এবার গেছি একাই। এইভাবে মায়ের জন্মদিনে আমি মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। খুঁজে পেয়েছি।
আরও পড়ুন-অভিষেককে ‘ফ্রেমবন্দি স্মৃতি’ উপহার দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, শৈশবেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর
সবার মধ্যেই মিশে আছেন
কাজ করতে করতে আমি বিভিন্ন জনের মধ্যে মাকে দেখতে পাই। মাকে খুঁজে পাই সপ্তর্ষির মধ্যে। বিশেষত ও যখন কোনও ব্যাপারে বকুনি দেয়। তখন মনে হয়, ঠিক যেন মায়ের কথা ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। কারণ মা প্রচণ্ড বকতেন। বিশেষত নান্দীকারে রিহার্সালের সময় কেউ ক্লান্তি বোধ করলে, অসুস্থতা দেখালে, সমস্যার কথা বললে খুব রেগে যেতেন। শুরু থেকে এভাবেই অভ্যস্ত হয়েছি। আমি এবং দলের বাকিরা। আমাদের দলের অর্ঘ্য, অনিন্দিতার মধ্যেও মাকে খুঁজে পাই। বুঝতে পারি সবার মধ্যেই মিশে আছেন আমার মা। বাবা আছেন। তবে বাবার সঙ্গে মাকে নিয়ে বেশি আলোচনা করি না। কারণ বাবা বড্ড কষ্ট পান। দুঃখের কথা, মনখারাপের কথা আমি বাবাকে বলি না। বোঝাই, আমি খুব ভাল আছি। আসলে দুঃখকষ্ট বড় বেশি ব্যক্তিগত।
আরও পড়ুন-শান্তি ফিরছেই না মণিপুরে, এবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল জনতা
আমার পরিচালনায় মা
বেশ কয়েকটা নাটকে আমার পরিচালনায় মা অভিনয় করেছেন। পরিচালকের সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীর গিভ অ্যান্ড টেক সম্পর্ক। একজন ভাল অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে বেশি বোঝাতে হয় না। কারণ ভাল শিল্পীর ভাল অভিনয়ের তাগিদ থাকে। রিহার্সালে মাকেও কোনও দিন বেশি কিছু বোঝাতে হয়নি। উনি তিন-চার রকম ভাবে ট্রাই করতেন। আমি বলতাম কোনটা বেশি ভালও লাগছে। সেটাই করতেন। মাঝেমধ্যে হয়তো টুকটাক পরামর্শ দিতেন। আমিও হয়তো কিছু বলতাম। এইভাবেই হত ভাবনার আদানপ্রদান। আমি সমৃদ্ধ হতাম খুব। সেই মুহূর্তগুলো এখন খুব মিস করি।
আরও পড়ুন-বিপর্যয়: গুজরাতের একাধিক এলাকা তছনছ, সতর্কতা রাজস্থানেও
‘ঘরে-বাইরে’র বিমলা
মা চলচ্চিত্রে খুব কম অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন আর বড়পর্দায় কাজ করেননি। যদিও পেয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেনের প্রস্তাব। তবে মা যাননি। কারণ নান্দীকার ছেড়ে যেতে চাননি। এখানে তিনি পেতেন শিল্পীর স্বাধীনতা, মানসিক শান্তি। তাই হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনও মাধ্যমে যাওয়ার কথা ভাবেননি। নান্দীকারে তখন কেউ ফ্রি-ল্যান্সার ছিলেন না। নান্দীকারে প্রথম ফ্রি-ল্যান্সার দেবুদা, দেবশঙ্কর হালদার। পরে আরও কেউ কেউ। আগে আমাদের কারও বাইরের জগতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। করিনি খুব বেশি কাজ। মায়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। শো না থাকলে কবিতা আবৃত্তি করতেন, আপনমনে নাচতেন, গান গাইতেন। থাকতেন নিজের মতো। এই স্বাধীনতা ছিল নান্দীকারে। ভরপুর স্বাধীনতা। তবে আমিই মাকে আবার সিনেমায় কাজ করার জন্য জোর করেছি। তাই হয়তো শেষ জীবনে কয়েকটা ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন-পুরীগামী আরও ট্রেন বাতিল হল
রাঁধতে এবং খাওয়াতে ভালবাসতেন
মায়ের মধ্যে ছিল অদ্ভুত ছেলেমানুষি, পাগলামি। আপনজনদের নিয়ে মেতে থাকতেন। কখনও সাঁতার কাটতে যেতেন, কখনও রান্না করে কারও বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। প্রচুর রাঁধতে এবং খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। মায়ের রান্নার স্টাইল ছিল উত্তরপ্রদেশের মতো। আমরা মূলত ভেজিটেরিয়ান। যদিও মা এবং আমি মাঝেমাঝে মাছ খেতাম। ভালবাসতেন বেড়াতে। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলায় বেরোতেন। জীবনটা উপভোগ করেছেন চুটিয়ে। আমরা সবাই প্রতি মুহূর্তে ছিলাম তাঁর সঙ্গে। শেষদিকে শারীরিক ভাবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। একদিন আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন।
আরও পড়ুন-বিপর্যয়: গুজরাতের একাধিক এলাকা তছনছ, সতর্কতা রাজস্থানেও
কাজের মধ্যে দিয়ে
১৬ জুন ২০২১, মা চলে গিয়েছেন। দু’বছর হল তিনি নেই। আলাদা ভাবে কোনও স্মরণ অনুষ্ঠান নয়, দিনটা আমরা কাটাই কাজের মধ্যে দিয়ে। গতবছর তাই করেছি। এবারও তাই।