১৭৮৫ সালের কথা। মারাঠাদের বিরুদ্ধে তখন লড়াই চালাচ্ছে মহীশূরের শাসক, টিপু সুলতানের বাহিনী। পুণেতে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের বিবাদ। টিপুর প্রতিনিধিরা সরাসরি মুসলমানদের পক্ষ অবলম্বন করলেন। একেবারে ঘোষিত সিদ্ধান্ত। মারাঠা কর্তৃপক্ষকে মুসলমানদের অনুকূলে বিবাদ মেটানোর জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন টিপুর প্রতিনিধিরা। কথাটা কানে গেল টিপুর। শুনেই রেগে অগ্নিশর্মা। চিঠিতে জানালেন আপন মতামত। স্পষ্ট কথা, মুসলমানদের পক্ষ অবলম্বনের কোনও আবশ্যকতা নেই। তাঁর লোকেরা বরং বাস্তবোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নিক। হিন্দু হোক বা মুসলমান, মারাঠা প্রজাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদে শেষবিচারে মারাঠা শাসকরাই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাদেরই অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে পড়তে হবে। সুতরাং মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে বিবাদ মেটানোর চেষ্টা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে ঢাক পিটিয়ে প্রচারেও সায় নেই টিপুর, সেকথাও স্পষ্ট করে জানালেন।
আরও পড়ুন-সরকারি উদ্যোগে পুনর্বহাল এইচআইভি পজিটিভ শিক্ষক
অর্থাৎ, ধর্মবিশ্বাস নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতাই ছিল টিপু সুলতানের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। উল্লিখিত ঘটনাটি অন্তত তারই প্রমাণ।
প্রায় ২৫০ বছর পর টিপু সুলতানের চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক দর্শন ভারতে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। টিপু সুলতানের জন্মবার্ষিকী সরকারের পালন করা উচিত কি না, তা নিয়ে ফি বছর একটা হইচই হয়। প্রচুর তর্কাতর্কি চলে। নির্বাচন এগিয়ে এলেই সংখ্যালঘুদের একমেবাদ্বিতীয়ম প্রতিনিধি হিসেবে টিপু সুলতানকে খাড়া করা হয়। এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এটা বহুকালাগত ব্যাধি।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি, সরব সাঁকরাইল
এবারও তেমনটাই ঘটল। আর তাই নিয়ে কতই না হইচই!
২০২৩-এ কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচন সমাগত। এই আবহে কর্নাটকে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির প্রদেশ সভাপতি টিপুকে নিয়ে বিতর্ক খুঁচিয়ে তুলেছেন। তাঁর এবং তাঁর মতো গেরুয়া শিবিরের ব্যক্তিবর্গের সৌজন্যে কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনের বিষয়টা স্রেফ গণতন্ত্রের নিয়মমাফিক মরশুমি প্রক্রিয়া আর নেই। সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিপুর বংশধরদের সঙ্গে যারা রামের ভজন গায়, তাদের লড়াই। এমনটা দেখলে, জানলে স্বয়ং টিপু সুলতান নির্ঘাৎ মুখটিপে হাসতেন। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সুবিধা নিয়ে আমাদের রাজনীতিকরাও নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা সুনিশ্চিত করতে চাইছেন, এটা দেখলে জানলে টিপু নির্ঘাৎ দারুণ মজা পেতেন। এতো তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ! এটা বোঝার পর সুলতানের মজা পাওয়ার সঙ্গত কারণ তো আছে, বটেই।
আরও পড়ুন-বৃত্তি নিয়ে কড়া বার্তা নবান্নের
কিন্তু এমতাবস্থায় একটাই জিজ্ঞাসা।
একবিংশ শতাব্দীর ভারতের রাজনীতি আর অষ্টাদশ শতকের রাজারাজড়াদের যুগের ঘটনাবলি, এসবের ভিড়ে টিপু সুলতানকে, সত্যিকার টিপুকে খুঁজব কোথায় এবং কীভাবে?
ঐতিহাসিক নথি স্পষ্ট জানাচ্ছে, মালাবার আক্রমণের সময় টিপুই সেই ব্যক্তি যিনি শত্রুপক্ষকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেছিলেন। এজন্যই অন্তত ডজনখানেক পারাপ্পান্দ বংশীয় রাজন্যবর্গ টিপুর লোকজনের জোর করে ধর্মান্তরিত করার কারণে অচ্ছুত জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আবার টিপুই সেই ব্যক্তি যিনি শৃঙ্গেরীর জগৎগুরুর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তাঁর নির্দেশ মেনে তাঁর কাছে শিবলিঙ্গসমূহ প্রেরণ করেছিলেন যথাযথভাবে সেগুলির পূজন নিশ্চিত করার জন্য।
টিপু সুলতানই সেই ব্যক্তি যাঁর বাহিনী ছেড়ে পালিয়েছিল মালাবারের ব্রাহ্মণরা।
আরও পড়ুন-ভাষা দিবসে ইংরেজি! ধুয়ে দিলেন ব্রাত্য
আবার টিপুই সেই সুলতান যাঁর প্রশাসনের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন এক মহীশূরীয় ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর নাম পূর্ণাইয়া। ব্রিটিশরা মহীশূর দখল করার পর এই পূর্ণাইয়াই ব্রিটিশদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান যাতে ইংরেজরা মহীশূর টিপুর স্বজনবর্গকে ফিরিয়ে দেয় এবং ভুলেও তা হিন্দু ওয়াদিয়ার বংশীয়দের হাতে তুলে না দেয়।
এসব দেখে কি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত যে টিপু সুলতান একজন ধর্মান্ধ মুসলমান শাসক ছিলেন?
এসব জেনে কি এই উপসংহার টানাও সমীচীন যে টিপু সুলতান একজন হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরাগী শাসক ছিলেন?
কোনওটাই টিপু সুলতানের বিষয়ে ঠিকঠাক বিচার হবে না।
আরও পড়ুন-প্রবাসী বাঙালিদের জন্য ‘আপন বাংলা পোর্টাল’-এর উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী
এই গোলকধাঁধায় দাঁড়িয়ে একটা সহজ সত্য বুঝে নেওয়া দরকার। দেশে গেরুয়া পক্ষের দাপাদাপি শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা দেশের বিগত দিনের শাসকদের ধর্মীয় মনোভাব নিয়ে যেভাবে মাতামাতি করি, ভারত-ইতিহাসের শাসকবর্গ বোধ হয় ধর্মকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতেন না, শাসন বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতেন না। তাঁরা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বহু বিষয়ের কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন। ধর্ম সেগুলির একটি মাত্র। অন্যতম। কিন্তু একমাত্র বিচার্য বিষয় নয়।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার ইতিহাস চর্চায় ব্রাত্য বসু, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়
টিপু সুলতান নিঃসন্দেহে একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসক ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অহেতুক বিরুদ্ধাচারণ তাঁর নেহাতই না-পসন্দ ছিল। মুসলমানদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে, তাদের নিরাপত্তা দানের প্রশ্নে, হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে পক্ষাবলম্বনের সময় কিন্তু টিপুর সিদ্ধান্তগুলো একেবারেই বাস্তববোধ সম্পন্ন শাসকের মতো ছিল, তাতে নিজধর্ম নিয়ে অন্ধ আবেগের ছোঁয়া একেবারেই থাকত না। পুণে থেকে প্রেরিত নিজের বাহিনীকে লিখিত উল্লিখিত পত্রে সেই ভাবনার প্রতিফলন সুস্পষ্ট।
কোনও গোঁড়ামিতে আটকে থাকা নয়, প্রয়োজনমাফিক অবস্থান অবলম্বন, এই হল টিপু সুলতানের ধর্মনীতি, যদিও ব্যক্তিগত পরিসরে, নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি মুসলমানই ছিলেন। মালাবার আক্রমণের সময় প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি তীব্রভাবে ‘কাফের’দের বিরোধী। আবার প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি সেই ‘কাফের’দের দেবতা যাতে যথাবিহিত পূজা লাভ করেন, সেজন্য টিপু সুলতান তৎপর। একই কারণে আওরঙ্গজেবও, যাঁকে হিন্দুদ্বেষী বলে দেগে দিতে ব্যস্ত গৈরিক শাসকবর্গ, তিনিও দাক্ষিণাত্যে শিয়া শাসকদের ওপর আক্রমণ চালান। মনে রাখতে হবে, মুঘল শাসক আওরঙ্গজেবের মা-ও কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান ছিলেন।
আরও পড়ুন-মেডিকা হাসপাতাল চত্বরে আগুন, হতাহতের খবর নেই
সুতরাং গেরুয়া কাচ লাগানো চশমা পরে টিপু সুলতানের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রকে বিচার করতে বসলে ভুল হয়ে যাবে। টিপু সুলতানের মতো মানুষজন শাসকের নিজস্ব চারিত্র-বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল। ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করার ক্ষেত্র তাঁরা জাতীয় আইকন, আবার বিজিত এলাকায় হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে তিনি বাস্তব প্রয়োজন অনুসারে ধর্মান্ধ।
এটা ইতিহাস।
কেউ অন্য কিছু বললে, সেটা অনৈতিহাসিক গাঁজাখুরি। বিভ্রান্ত ছড়ানোর অপপ্রয়াস।