পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে মা-মাটি-মানুষের সরকার

মোদি সরকার নয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। মিথ্যের মুখোশ ছিঁড়ে সত্যের উন্মোচনে ডোমকল গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৌরভ মধুর দে

Must read

কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২০ সালে মার্চ মাসের হঠাৎ ঘোষিত লকডাউন ও তার ফলে বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজ রাজ্যে ঘরে ফেরার ছবি কেন্দ্রীয় সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল, একই সঙ্গে শিহরন জাগিয়ে ছিল সচেতন নাগরিকদের মনে। কেন্দ্রীয় সরকারের মিনিস্ট্রি অফ লেবার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্টের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালের প্রথম ধাপের লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে ফেরার সংখ্যাটা ছিল এক কোটি চার লক্ষ ছেষট্টি হাজার একশো বাহান্ন জন। তবে এই এক কোটি চার লক্ষ ছেষট্টি হাজার একশো বাহান্ন জন পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা, উদ্বেগ ও হতাশার ভয়াবহতাকে কোনও পরিসংখ্যানের মধ্যে আনা যাবে না।

আরও পড়ুন-পেশ হল পুরবাজেট, রাজস্ব বাড়ল ১০ শতাংশ

খুব সহজেই মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে পরিযায়ী শ্রমিকদের যদি নিজ রাজ্যের মধ্যেই কাজের সংস্থান হত তাহলে হয়ত এই ভয়াবহতার চিত্র দেখতে হত না। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় একজন নাগরিকের রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোনও একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে অপর একটি নির্দিষ্ট অংশে বিচরণ করার, বসবাস করার এবং জীবনজীবিকা নির্ধারণের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ আছে। এছাড়াও পরিযায়ী শ্রমের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস বিশেষত গ্রাম থেকে নগরে শ্রমিক পরিযানের ইতিহাস ভারতবর্ষের বুকে দীর্ঘদিন ধরে আছে। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পাটলিপুত্রের (অধুনা পাটনা) জনসংখ্যা ছিল দু লক্ষ সত্তর হাজার, মথুরার জনসংখ্যা ছিল ষাট হাজার, বিদিশার জনসংখ্যা ছিল আটচল্লিশ হাজার। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই নগরগুলোতে এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা গ্রাম থেকে নগর অভিমুখে মানুষের পরিযান ছাড়া সম্ভবপর ছিল না। ১৮৫৭-এর পরবর্তী সময়ে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে শাসন ভার ব্রিটিশ রাজের হাতে হস্তান্তরিত হয় এবং প্রত্যক্ষ শাসনের সুযোগ এল তখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁরা কৃষিকাজকে শিল্পগত রূপ দিতে থাকলেন এবং চা, কফি, রাবার, তুলা, নীল ইত্যাদি চাষের মাত্রা বৃদ্ধি পেল সাথে সাথে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদেরও আগমন হয়েছিল সেই সমস্ত কৃষিভিত্তিক শিল্পস্থলগুলোতে। এ প্রসঙ্গে উত্তর-পূর্বের আসাম, দার্জিলিং, দক্ষিণ ভারতের মহীশূরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে রেললাইনের পত্তন, সড়কপথের উন্নতি, বন্দরের সুবিধার কারণে বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজের জনসংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেল ও পরিযায়ী শ্রমিকদেরও আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকল এই তিন শহরে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং কাজের ধরনের পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাম থেকে নগরে পরিযান এবং ভিন রাজ্যে পরিযানের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯১ সালে ভিন রাজ্যে পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা ছিল তেইশ কোটি, ২০০১ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ছত্রিশ কোটি এক লক্ষ এবং ২০০১ সালের সর্বশেষ জনসংখ্যার আদমশুমারি অনুযায়ী সেই সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ কোটি ষাট লক্ষে পৌঁছেছে। সবথেকে বেশি পরিমাণ পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ থেকে,দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিহার রাজ্য। তাই সরাসরি প্রশ্নটা ছুঁড়তে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমুখে, যে-দেশে পঁয়তাল্লিশ কোটির উপর পরিযায়ী মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আবার অসংগঠিত শ্রমিক তাঁদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা কী রয়েছে?

আরও পড়ুন-ড্রোন কিনতে এবার কৃষকদের ভর্তুকি দেবে রাজ্য, ফের পাশে বাংলার কৃষকবন্ধু সরকার

ইন্টারস্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট,১৯৭৯ (রেগুলেশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অফ সার্ভিস)-এ পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকারের কিছু দিক ও নিরাপত্তার জায়গাটি সুনিশ্চিত করার কথা উল্লেখ থাকলেও এর প্রয়োগের মাত্রা যেমন কম তেমনি এই আইনের মধ্যে অনেক ত্রুটি থেকে গেছে। একটি উল্লেখযোগ্য ত্রুটি হল এই আইন সেই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা কন্ট্রাক্টর-এর মাধ্যমে নিযুক্ত হচ্ছে এবং সেই সমস্ত কন্ট্রাক্টরকেই এই আইনের আওতায় আনা হবে যারা পাঁচ অথবা তার অধিক পরিযায়ী শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে ব্যক্তিগত পরিচয়ের মাধ্যম দিয়েই এক পরিযায়ী শ্রমিক অপর পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের সন্ধান করে দেয় তাই ব্যক্তিগতভাবেই অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালে পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটি এই আইনের সংশোধনী বিলের প্রস্তাব আনলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই সংশোধনী বিল ও পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষার দিকগুলো অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে।
২০২০ সালে অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই দুর্দশাগ্রস্ত ছবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার দিকটি প্রকাশিত হয়। সেই লজ্জা ঢাকতে ২০২১ সালে ই-শ্রম পোর্টাল চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকরা নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। বিশ্লেষণ করলেই এই উদ্যোগের অন্তঃসারশূন্যতা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করার জন্য আধার কার্ড এবং সেই আধারের সাথে ফোন নম্বর যুক্ত থাকাও বাধ্যতামূলক। অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকের ফোন নম্বরের সাথে আধার কার্ড সংযুক্ত করা নেই ফলে তাঁরা নাম নথিভুক্তকরণ থেকে বঞ্চিত। যাঁদের সংযুক্ত আছে তাঁরা সেবাকেন্দ্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের কাজের জায়গা থেকে দূরত্ব অনেকটাই। এছাড়াও এই পোর্টালে অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়োগকর্তার নাম লিপিবদ্ধকরণের বিষয়টি উল্লেখিত নেই, তাই কোন নিয়োগকর্তার দ্বারা শ্রমিকটি শোষিত বা বঞ্চিত হলে তার কোনও হদিশ থাকবে না কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। অসংগঠিত শ্রমিক-সহ পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে কেন্দ্রীয় সরকার যে দিশাহীন ব্যর্থ তা খুব সহজেই স্পষ্ট।

আরও পড়ুন-ড্রোন কিনতে এবার কৃষকদের ভর্তুকি দেবে রাজ্য, ফের পাশে বাংলার কৃষকবন্ধু সরকার

এই অন্ধকারের বিপরীতেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে উজ্জ্বল দিশা দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ভারতবর্ষের বুকে রাজ্য হিসেবে প্রথম পশ্চিমবঙ্গেই ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে গঠিত হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ। এই পর্ষদের তত্ত্বাবধানে চালু হয়েছে কর্মসাথী পরিযায়ী শ্রমিক পোর্টাল। এই পোর্টালে বাংলা থেকে ভিন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা তাদের নাম-সহ নিয়োগকর্তার নাম নথিভুক্ত করতে পারছেন। মোবাইল অ্যাপও চালু হয়েছে, ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তা সরাসরি জানাতে পারবেন। এছাড়াও কোনও পরিযায়ী শ্রমিকের নিজ জেলা, পার্শ্ববর্তী জেলা-সহ অন্য রাজ্যে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কোনও তথ্য সরকারের কাছে এলে তা সরাসরি মোবাইলের মেসেজে পাঠানো হবে সেই শ্রমিকের কাছে। দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের একটি কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে, সেখানে নিযুক্ত হয়েছেন একজন নোডাল অফিসার। দিল্লির বুকে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকরা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন সেই অফিসারের সাথে। ইতিমধ্যেই শিয়ালদহ স্টেশনে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য হেল্প ডেস্ক উদ্বোধন হয়েছে। যে সমস্ত শ্রমিক এই স্টেশন ব্যবহার করে বাইরের রাজ্যে যান তাঁরা তাদের নাম নথিভুক্তকরণ ও যারা ইতিমধ্যেই নাম নথিভুক্ত করেছেন তাঁদের বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানে সক্রিয় থাকবে এই হেল্প ডেস্ক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অভিনবত্ব এখানেই যে, দুয়ারে সরকার প্রকল্পের সাথেই সংযুক্ত হয়েছে এই নাম নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়া। রাজ্য সরকারের এই কর্মসূচিগুলো পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি কার্যকরকরণের দিকটাকেই তুলে ধরে।

আরও পড়ুন-আজ থেকে সমুদ্রসাথী প্রকল্প নিয়ে শিবির চালু

বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণের দিকটি নিয়ে যেখানে দিশাহীন, এখনও পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারেনি স্বতন্ত্র পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন কমিশন সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার অব্যর্থ দিশা দেখাচ্ছে সারা দেশকে।

Latest article