গত মাসের শেষেই কলকাতায় বছর দশেকের একটি মেয়ে অ্যাকিউট নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সিভিয়র কন্ডিশনে হাসপাতালে ভর্তি হয়। সংবাদমাধ্যমে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমে উপসর্গ দেখে মনে হয়েছিল অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণ। কিন্তু পরে মেয়েটির থুতু-লালার নমুনা পরীক্ষা করে ধরা পড়ে মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি। যে ব্যাকটেরিয়াটি মেয়েটির হওয়া অ্যাকিউট নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী। পার্ক সার্কাসের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে ভর্তি করা হয়েছিল মেয়েটিকে। জানা গিয়েছে সর্দি ও শুকনো কাশির উপসর্গ দেখা গিয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে ছিল ধুম জ্বর। এমন একটি খবরে শহরবাসীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ শুধু কলকাতা নয়, ভারতের উত্তরাখণ্ডেও এই রোগ দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞের মতে, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি ব্যাকটেরিয়াই বিরল নিউমোনিয়ার কারণ। একে বিশেষজ্ঞরা অজানা নিউমোনিয়া নামকরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন চাইনিজ নিউমোনিয়া। সুদূর চিনদেশে যে রোগটি বিগত বছর থেকেই চিনবাসীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এদেশে সেই রোগ এল কী করে তার কারণটা রহস্যে ঘেরা।
আরও পড়ুন-হরমনপ্রীতদের হার সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার
কী এই মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সবই মাইক্রোস্কোপিক প্যাথোজেন বা প্যাথোজেন যা থেকে এই জাতীয় রোগ ছড়ায়। মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি হল মলিকিউট শ্রেণির খুব ছোট্ট ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে এক বিরল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় শিশুরাই বেশি। এটি গলা এবং শ্বাসযন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যা থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে। রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস বা আরএসভি এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাসটি ‘আপার রেসপিরেটরি’, নাক এবং গলাকে প্রভাবিত করে। এটি সর্দি, কাশি এবং জ্বরেরও কারণ।
মাইকোপ্লাজমা এএসভি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা খুব সাধারণ রোগ, যা খুব গুরুতর না হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে সেরেও যায়। গত বছরের একেবারে শেষদিকে এই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিনের অসংখ্য শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর রোগটি শুধু চিনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকা এবং নেদারল্যান্ডসেও। প্রথমে একে অজানা নিউমোনিয়া বললেও পরে এর নতুন নামকরণ হয় ‘হোয়াইট লাং সিনড্রোম’।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এই নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত শিশুদের বুকের এক্স-রে করলে ফুসফুসের উপর সাদা সাদা দাগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা এই রোগটির নাম দিয়েছেন ‘হোয়াইট লাং সিনড্রোম’। তাঁরা বলছেন, ফুসফুসের অ্যালভিওলা বা রন্ধ্রজনিত কোনও রোগের কারণে ‘হোয়াইট লাং সিনড্রোম’ হতে পারে। আবার সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হলেও ফুসফুসে এই রোগে দানা বাঁধতে পারে। এই রোগের আওতায় পড়ছে অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম, পালমোনারি অ্যালভিওলার মাইক্রোলিথিয়াসিস ও সিলিকা।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চাইনিজ নিউমোনিয়া কোনও একটি ভাইরাস নয়। একাধিক ভাইরাসের প্রভাবে সংক্রমিত হচ্ছে শিশু। যেমন, সার্স-কোভিড টু, প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা, এইচ নাইনএনটু, রেসপিরেটরি সিনিক্যাল ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া ভাইরাসের সম্মিলিত সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে রোগীর শরীরে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শরীরে পড়ছে সাংঘাতিক প্রভাব।
আরও পড়ুন-শ্লীলতাহানির অভিযোগে বিজেপি রাজ্যে চিঠি ৫০০ ছাত্রীর
কেন সতর্কতা
ফুসফুসের লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে যে সংক্রমণ হয় তাকে নিউমোনিয়া বলা হয়। নিউমোনিয়াকে আগে আমরা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন বা এআরআই বলে জানতাম। এটি ফুসফুসে ফোলাভাব সৃষ্টি করে৷ যা সাধারণত কিছু সংক্রমণের কারণে ঘটে। ঠিক সময় ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসা শুরু না হলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শীতকালে জীবাণুর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি হয় বলে এই সময়ে নিউমোনিয়ার প্রকোপে শিশু এবং বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হন। নিউমোনিয়া মূলত তিন ধরনের। কমিউনিটি অ্যাকুয়ার্ড নিউমোনিয়া (ক্যাপ), হসপিটাল অ্যাকুয়ার্ড নিউমোনিয়া (হ্যাপ) আর ভেন্টিলেটর অ্যাকুয়ার্ড নিউমোনিয়া (ভ্যাপ)। এর মধ্যে হ্যাপ এবং ভ্যাপে আক্রান্ত হওয়া মানুষের শরীরের দ্রুত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে-কারণেই এই রোগে কড়া সতর্কতা জরুরি।
আরও পড়ুন-প্রয়াত প্রাক্তন নগরপাল তুষারকান্তি তালুকদার
অজানা বা চাইনিজ নিউমোনিয়ার লক্ষণ
অস্বাভাবিক জ্বর। তাই শিশুর জ্বর আসার পর তা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং কিছুতেই না কমে, তখন অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।
জ্বরের সঙ্গে প্রবল কাশিও হতে পারে এবং বুকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। কখনও এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বমি ও ডায়েরিয়ার সমস্যাও দেখা দিতে থাকে একই সঙ্গে। একাধিক ভাইরাসের আক্রমণ শরীরকে খুব দুর্বল করে দেয়।
প্রবল ডায়েরিয়া দেখা দেয়।
জ্বর আর কাশি না কমলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বুকের এক্স-রে করে নিতে হবে। একসঙ্গেই জ্বরের মাত্রা না কমলেও শিশুকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করানোই শ্রেয়।
শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এই অসুখের জীবাণু শরীরের মধ্যে দ্রুত ছড়াতে থাকে। তাই আপনার শিশু যদি ইতিমধ্যেই অন্য কোনও রোগে ভোগে তাহলে এই ধরনের লক্ষণ দেখলেই আগেভাগে সতর্ক হওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন-জিএসটি ফাঁকি রুখতে পারলে সাশ্রয় হবে লক্ষ কোটি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে চিঠি অমিত মিত্রের
আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই
গত বছর দিল্লি এমসে নিউমোনিয়া আক্রান্ত প্রায় ৬০০ শিশুর উপরে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছে। তাতে সাতজনের শরীরে এই বিশেষ জীবাণুটি অর্থাৎ মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন এই রোগ হলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ার মতো কিছু নেই। এই নিউমোনিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না। যদি দিতেই হয় তবে অ্যারিথ্রোমাইসিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিকেই কাজ হয়। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কখনওই উচিত নয় তাতে ফল বিপরীত হতে পারে— যেটা চিনে হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খেলে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। যার ফলে সেগুলি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আবার অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে অনেক ভাল ব্যাকটেরিয়াও নষ্ট হয়ে যায়।
ভারতে মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া নতুন কিছু নয়। এই ব্যাকটেরিয়াটি পুরনো। বহু আগে এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়েছিল। চিনেও এই মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া বহু পুরনো। ইদানীং আবার বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে। স্বস্তি এটাই, এই দেশে শিশুদের মধ্যে এই রোগ দেখা গেলেও একেবারে সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রে এই রোগ পাওয়া যায়নি। এই রোগের উপসর্গ শরীরে এলে জ্বর পাঁচদিনের বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শিশুদের অবশ্যই ভ্যাকসিন দেওয়ান।