দার্শনিকভাবে কথাটির অন্য মানে দাঁড়ালেও বৈজ্ঞানিকভাবে কথাটা কিন্তু একদম সত্যি। আসলে ঘুম বলতে আমরা যা বুঝি সেটি হল শারীরিকভাবে সমস্ত অঙ্গের কাজের অব্যাহতি। একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে এই ঘুম আমাদের দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিশ্রাম দেয় যা এই সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ করার ক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। আসলে আমরা আমাদের দেহকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করি তাহলে সমস্ত যন্ত্রেরই যেমন বিশ্রামের প্রয়োজন আছে তার কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য ঠিক তেমনি আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশ্রামের প্রয়োজন আছে তাদের কার্যকারিতা সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য। এবং সবথেকে বেশি এই বিশ্রাম যাকে দেওয়ার প্রয়োজন হয় সেটি হল মস্তিষ্ক। কারণ আমাদের দেহের সমস্ত কার্যকারিতা পরিচালনার জন্য মস্তিষ্ককে সমস্ত সময় সজাগ থাকতে হয়।
আরও পড়ুন – অম্বিকা ব্যানার্জীর প্রয়াণ দিবসে এবিসিএফ এর উদ্যোগে রক্তদান শিবির
তাই যথেষ্ট পরিমাণ ঘুম বা নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘুম আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম প্রদান করে যা কিনা মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে আরও জোরদার করে তুলতে সাহায্য করে। এই ঘুম ও স্বপ্ন দেখা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে গেলে আবার আমাদের জীববিদ্যার দ্বারস্থ হতে হবে। তবে সেই ভাষাতেই ব্যাখ্যা করা যাক। এই ঘুমের মূলত দুটি দশা বর্তমান। একটিকে আমরা বলি REM (Rapid Eye Movement) sleep ও অপরটিকে বলি NREM (Non Rapid Eye Movement) sleep। সাধারণত একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন হয়। এই ঘুমানোর গোটা সময়কাল সাধারণত উক্ত দুই দশায় বিভক্ত হয়। যার মধ্যে আমাদের ঘুমের গোটা সময়কালের ২০-২৫% অংশ REM দশার আর বাকি ৪৫-৫৫% অংশ NREM দশার অন্তর্ভুক্ত। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে REM দশার এরকম নামকরণের একমাত্র কারণ হল এই দশায় আমাদের চোখের সঞ্চালন দেখা যায়। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এটি দেখা গিয়েছে যে REM দশায় আমাদের মস্তিষ্ক খুব বেশি মাত্রায় সক্রিয় থাকে এবং শুধু তাই নয় আমরা জেগে থাকা অবস্থায় মস্তিষ্কের যেরকম কার্যকারিতা লক্ষ্য করে থাকি REM দশায় আমাদের মস্তিষ্ক তার থেকেও বেশি কার্যকর থাকে এবং এই দশাতেই আমরা স্বপ্ন দেখে থাকি।
আরও পড়ুন – সিবিআইয়ে মানুষের আর শ্রদ্ধা নেই: সুজিত
প্রায় সমস্ত মানুষ এই দশাতেই তাদের বেশিরভাগ স্বপ্ন দেখে থাকে। কারণ NREM দশায় মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে এবং এই অবস্থায় মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও অনেকটা কমে যায় তাই এই দশায় খুব কম স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয় বা একেবারেই দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, এই দশায় দেখা স্বপ্ন মানুষ মনেও রাখতে পারে না কিন্তু REM দশায় দেখা স্বপ্ন মানুষ সহজেই মনে রাখতে পারে কারণ এই সময় মস্তিষ্কের সক্রিয়তার দরুন মানুষ স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি সে স্বপ্ন সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য মস্তিষ্কে ধরে রাখতে পারে। তাই সেটি খুব সহজেই মনে করতে পারে। যদিও এই দশায় মস্তিষ্ক ছাড়া বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রামরত অবস্থাতেই থাকে। আসলে বিজ্ঞানের ভাষায় মস্তিষ্ক সজাগ থাকার অর্থই হল আমাদের জেগে থাকা আর এই আলোচনা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়ে গেল যে মানুষ একমাত্র জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখতে পারে। অন্তত বিজ্ঞান তাই বলে।
আরও পড়ুন – পাচার ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে কলিমুদ্দিন তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের সহায়তা
জৈব ঘড়ি
আমরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য কমবেশি সকলেই অ্যালার্ম ক্লক ব্যবহার করে থাকি। কিন্ত আমাদের দেহের (Body) মধ্যেই বিশেষত মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রা কায়াজমাটিক নিউক্লিয়াসটি এই অ্যালার্ম ক্লক-এর কাজটি করে থাকে। সাধারণত নিদ্রা ও জাগরণ, বিভিন্ন হরমোনের ক্ষরণ এই ঘড়ির সময় ধরেই নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ঘড়ি যে পদ্ধতিতে এগুলির নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাকে বলে সারকাডিয়ান রিদম। আমরা যে রাতে ঘুমোতে যাই ও সকালে ঘুম থেকে উঠি তার জন্য এই ঘড়িটিই কাজ করে। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা যদি বেশ কিছুদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস করি তাহলে অ্যালার্ম ক্লক ছাড়াই আমাদের ঠিক সেই সময়ে ঘুম ভেঙে যায়। এটিও আমাদের দেহে (Body) থাকা জৈব ঘড়ির জন্য সম্ভব হয়।
এমনকী যাঁরা রাতের শিফটে কাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এই জৈব ঘড়ি তাঁদের রাতে জাগিয়ে রাখার জন্য সারকাডিয়ান রিদমকে ওভাবেই নিয়ন্ত্রিত করে। রাত হলে যে আমাদের ঘুম পায়, সেই ঘটনাটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই নিউক্লিয়াসটি পিনিয়াল নামক গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নামক একপ্রকার হরমোন ক্ষরণ করায় যা আমাদের ঘুমের আবেশ সৃষ্টি করে। যদিও এটির ক্ষরণ অন্ধকারের ওপর নির্ভরশীল। তাই দিন ও রাতের পার্থক্যের জন্য আমাদের ঘুমেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই বলা যায় ঘুম থেকে উঠতে আমরা যতই অ্যালার্ম ক্লক ব্যবহার করি না কেন, আসল চাবিকাঠি কিন্তু এই জৈব ঘড়ির হাতেই।