যারে তুমি নিচে ফেল…

বিজেপির মিথ্যাচারিতা ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। জাতপাতের অঙ্কে ওরা ভোটের ব্যালান্স শিট মেলাতে চাইছে। লিখছেন অনির্বাণ ধর

Must read

“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।”

আরও পড়ুন-অবশেষে ১৭ দিন পরে উত্তরকাশীর টানেল থেকে ‘মুক্তি’ ৪১ শ্রমিকের

রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি নিশ্চয় বিজেপির বাবুরা পড়েননি, কিংবা পড়লেও কবিতার বিষয়বস্তুটি বুঝে উঠতে পারেননি। নইলে মোদি জমানায় একই দৃশ্যের অভিনয় পুনরাভিনয় হতে থাকে কী করে?
ঘটনা ১: ঘটনাস্থল : গুজরাত
হকের বেতনের টাকা চাইতে গিয়ে জুটল নিদারুণ প্রহার। সঙ্গে মালকিনের জুতো মুখে নেওয়ার অভিনব শাস্তি! ঘটনাস্থল, মোদি জমানায় ‘এগিয়ে থাকা’ রাজ্য গুজরাত। প্রধানমন্ত্রী এ-রাজ্যের ভূমিপুত্রও বটে। খবরে প্রকাশ, অভিযুক্ত ব্যবসায়ী মহিলার সংস্থায় ১৬ দিনের কাজের বেতন চাওয়ায় এক যুবককে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। মালকিন তাঁর পায়ের জুতো মুখে নিতে বাধ্য করেন ওই যুবককে। এটা অক্টোবরের ঘটনা।

আরও পড়ুন-দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরুতে রোহিতরা নেই

ঘটনা ২: ঘটনাস্থল : গুজরাত
গত জুন মাসে এই রাজ্যেই মাঠে খেলা দেখার সময় এক কিশোর বল-এ হাত দিয়েছিল বলে তাকে জাত তুলে গালি দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদ করায় ওই কিশোরের কাকার বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয়।
ঘটনা ৩: ঘটনাস্থল : গুজরাত
বছর দুয়েক আগে পিছিয়ে যাওয়া যাক। মোদির রাজ্যে এক মন্দিরে প্রবেশ করায় এক পরিবারের ছ’জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। বিজেপি শাসিত এই রাজ্যের উনাতে বছরখানেক আগে এক সমাবেশে বর্ণবিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে ১৯ জনকে বেধড়ক মারা হয়েছিল। উপরের প্রতিটি ঘটনায় আক্রান্তদের একটাই পরিচয়, তারা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। উচ্চবর্ণের প্রতিভূ বিজেপির একাংশের চোখে এরা ‘অস্পৃশ্য, ঘৃণার পাত্র-পাত্রী’।

আরও পড়ুন-আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হল ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক বইমেলার দিন

ঘটনা ৩: ঘটনাস্থল : মধ্যপ্রদেশ
সাল ২০১৯। মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার এক অজ গ্রাম। এ-গ্রামে দলিত বাড়িতে শৌচাগার নেই। ফলে গ্রামের পুরুষ-নারী প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতে বাধ্য হন। এখানেই একদিন ১০ ও ১২ বছরের দুই কিশোরী মাঠের মাঝে সেই কাজ করায় তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে উচ্চবর্ণের লোকেরা। ধরা যাক, সঞ্জয়ভাই পারমারের কথা। শখ করে গোঁফ রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু একজন দলিত কোন সাহসে গোঁফ রাখে, এই অজুহাতে তাঁকে গোঁফ কাটতে বাধ্য করা হয়।
ঘটনাস্থল ভিন্ন ভিন্ন হলেও একটা কথা পরিষ্কার। মোদি জমানায় কোনও কোনও ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যে অপশাসনের জেরে একেবারে জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। সেখানে দলিত নিগ্রহ মাত্রাছাড়া, হেলদোল নেই পদ্মশিবিরের!

আরও পড়ুন-বাংলার আটকে পড়া শ্রমিকদের ফেরাতে উত্তরকাশীতে টিম পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রী

মুসলমান নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সবচেয়ে নিম্নবর্ণের প্রতি শাসকদলের সমর্থকদের একাংশের নানাবিধ অত্যাচার ও ঘৃণাবর্ষণের নজির যে ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যগুলিতেই বেশি তা অস্বীকার করা যাবে কি? গতবছর লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায়মন্ত্রক যে রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মোদি জমানায় দলিতদের উপর অত্যাচার কয়েকগুণ বেড়েছে। ২০১৮ থেকে ’২০ এই তিন বছরে দলিত, তফসিলি জাতি-উপজাতিদের উপর অত্যাচারের মামলার নিরিখে প্রথম দুটি স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ। লক্ষণীয় বিষয় হল, অত্যাচার, ঘৃণা, অস্পৃশ্যতার এমন নগ্ন প্রদর্শন চললেও ভোট রাজনীতির ময়দানে এই বিজেপিই আবার ‘দলিত-দরদি’ সেজে মাঠে নেমে পড়ে! যেমন দেখা গিয়েছে, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে। এক দলিত যুবককে প্রস্রাব খেতে বাধ্য করেছিল উচ্চবর্ণের এক ব্যক্তি। এই নিয়ে দেশজুড়ে হইচই হতেই রাজ্যে বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী ওই যুবককে নিজের বাসভবনে ডেকে ক্ষমা চেয়ে পা ধুয়ে দেন। এই একই লক্ষ্যে অর্থাৎ ওবিসি ভোট নিশ্চিত করতে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মোদি নিজেকেই নাকি ‘ওবিসি’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমনিতে বিজেপি হিন্দু, উচ্চহিন্দু জাতির পার্টি বলে পরিচিত। কিন্তু শুধু এই পরিচয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না বুঝেই ভোটের রাজনীতিতে তোষণের কৌশল নিয়েছে বিজেপি। প্রথমে আদিবাসী, তারপর তফসিলি, তারপরে ওবিসিদের নথিভুক্ত করছে ফাঁদ পেতে। বলা যায়, এই কাজে তারা সফলও। উদাহরণ, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৩৭.৪ শতাংশ। এর মধ্যে ওবিসি ভোট ছিল ৪৪ শতাংশ।

আরও পড়ুন-কোটায় ২০ বছর বয়সী ছাত্রের রহস্যমৃত্যু

এই খেলার ছকেই ভাঁওতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে মতুয়া সম্প্রদায়কেও।
লোকসভা ভোটের মুখে ‘মতুয়া কার্ড’ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছে বিজেপি। এবারও তাদের তুরুপের তাস মতুয়াদের নাগরিকত্ব। রবিবার উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর ঠাকুর বাড়িতে এসে সেই নাগরিকত্ব ইস্যুকে উসকে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র (রাষ্ট্র) মন্ত্রী অজয় মিশ্র। মতুয়াদের এই পরিচয়পত্র দেশের যে কোনও প্রান্তে সুবিধা দেবে বলে দাবি করেন মন্ত্রী। কিন্তু মতুয়ারা বলছেন, আমাদের বাপ-ঠাকুরদা যেভাবে এদেশে এসেছেন, সংঘাধিপতির বাপ-ঠাকুরদাও একইভাবে এদেশে এসেছেন। তাহলে তাঁর দেওয়া কার্ড যদি আমাদের পরিচয়পত্র হয়, সেক্ষেত্রে তিনি নিজে কোন কার্ড নিয়ে ঘুরবেন? তাঁদের সাফ কথা, আমরা এদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করেছি। ভোটার, আধার কার্ড রয়েছে, ভোটও দিচ্ছি। এখন আবার নতুন করে পরিচয়পত্র কেন! পাশাপাশি তিনি বলেন, ওদেশ থেকে যারা নতুন করে আসছে, সরকার বরং তাদের জন্য ভাবুক। ভোটের মুখে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয় বিজেপি। লোকসভার আগে এটা আরও একটা প্রলোভন। আর এই বিষয়ে পদ্ম শিবিরের বাগদার বিধায়ক অসীমবাবুর কথায়, ‘‘যদি কেউ বলে থাকেন, মতুয়া কার্ড থাকলে, সে এদেশের নাগরিক, তাহলে সেটা ভাঁওতা। আমি ভাঁওতা দিতে পারব না! মতুয়া কার্ড যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ হয়, তবে তা নিতে লম্বা লাইন পড়বে। কার্ড বিক্রি হবে, জালিয়াতি হবে।’’
মিথ্যের ঢাক ফেঁসে গিয়েছে।

Latest article