আমরা নারী আমরা সব পারি

আজকের নারী জয় করে ফেলেছে স্বর্গ মর্ত পাতাল— ত্রিভুবনই। তাঁরা দশভুজা। সামলাচ্ছেন ঘর এবং বাহির। পাড়ি জমাচ্ছেন মহাকাশে, আন্টার্কটিকায়। চালাচ্ছেন বাস, অটো— আবার চালাচ্ছেন গোটা একটা রেল স্টেশনও। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। ভারতবর্ষে কয়েকটি রেল স্টেশন শুধুমাত্র নারীরাই পরিচালনা করছেন। আর সেই মহিলা পরিচালিত রেল স্টেশনগুলোকে বলা হয় পিঙ্ক স্টেশন। লিখছেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

একসময় নারীরা শুধুমাত্র পরদানশিন ছিল। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই তাদের কেটে যেত চব্বিশটা ঘণ্টা। ঘরের কাজ করা, সংসার সামলানো, বাচ্চা মানুষ করা— এই ছিল তাদের প্রধান এবং একমাত্র কাজ। কিন্তু সময় পাল্টেছে। আজ নারীরা ঘরের চার দেওয়াল ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে বাইরের জগতে। মেয়েরা ট্রেন চালাচ্ছে, পাইলট হচ্ছে, সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে আবার মহাকাশেও পাড়ি জমাচ্ছে তারা। সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত জায়গায় আজ নারীদের জয়জয়কার। আর এখন তো নারীরা দল বেঁধে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে ভারতের কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশনের পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্বভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে ভারতের কয়েকটি এমন স্টেশন আছে, যে স্টেশনগুলো শুধুমাত্র মহিলারাই পরিচালনা করেন অর্থাৎ এই স্টেশনগুলোতে কোনও পুরুষ কাজ করেন না। আর এই মহিলা পরিচালিত স্টেশনগুলো পিঙ্ক স্টেশন হিসাবে খ্যাত।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্রভবন আধিকারিকের মিডিয়া পোস্ট ঘিরে চাঞ্চল্য

পিঙ্ক স্টেশন কী
পিঙ্ক রেলওয়ে স্টেশন হল ভারতের বিশেষ ধরনের রেলওয়ে স্টেশন যেখানে স্টেশনটির পরিচালনার দায়িত্ব থাকেন শুধুমাত্র মহিলা কর্মীরা। গোলাপি আলো, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং প্যানিক বোতামের মতো বৈশিষ্ট্য-সহ মহিলাদের জন্য নিরাপদ এবং আরামদায়ক হওয়ার জন্য এই স্টেশনগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এই স্টেশনটিগুলো শুধুমাত্র নারীদের ক্ষমতায়নই করে না বরং নারী কর্মী এবং ভ্রমণকারীদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থলও প্রতিষ্ঠা করে।

আরও পড়ুন-শিশির অধিকারীর সম্পত্তির খতিয়ান তুলে নিশানা কুণাল ঘোষের

পিঙ্ক স্টেশনের গুরুত্ব
ভারতীয় রেলওয়েতে এই গোলাপি স্টেশন অর্থাৎ পিঙ্ক স্টেশন হচ্ছে নতুন সংযোজন। স্টেশনগুলি শুধুমাত্র মহিলা কর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। অর্থাৎ এই স্টেশনগুলিতে স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে টিকিট পরীক্ষক, সুপারভাইজার থেকে শুরু করে সাফাই কর্মী সবাই মহিলাকর্মী। পিঙ্ক স্টেশন করার উদ্যোগটি মহিলাদের ক্ষমতায়নের একটি ভাল উপায়। কারণ এই উদ্যোগটি মহিলা কর্মী এবং যাত্রীদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করে। এছাড়াও এই পিঙ্ক স্টেশন বা গোলাপি স্টেশন করায় মহিলাদের আরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এমন অনেক মহিলা আছেন বিশেষ করে বিধবা এবং একক মা, যাঁদের কাছে কাজ খুঁজে পাওয়াটা ভীষণ কঠিন একটা বিষয়। পিঙ্ক স্টেশন হওয়ার ফলে যেহেতু এখানকার সব ধরনের কর্মী মহিলা হয় সেহেতু সেই সমস্ত পিছিয়ে পড়া মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে এই উদ্যোগটি। অর্থাৎ অনেক মহিলার কর্মসংস্থানের প্রতিবন্ধকতার সমাধান হয়েছে এই পিঙ্ক স্টেশনগুলো। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা— সকাল থেকে শুরু করে রাত, অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনই তাঁরা অনায়াসেই স্টেশনগুলো দক্ষ হাতে পরিচালনা করছেন।

আরও পড়ুন-এক নারী দুই হাতে তরবারী

গান্ধীনগর রেল স্টেশন
২০১৮ সালে রাজস্থানের জয়পুরের গান্ধীনগর রেল স্টেশনটি ভারতের প্রথম মহিলাচালিত রেল স্টেশন হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এই গান্ধীনগর রেল স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশটি ট্রেন যাতায়াত করে, যার মধ্যে পঁচিশটি ট্রেন এই স্টেশনে দাঁড়ায়। প্রায় সাত হাজার মানুষ প্রতিদিন এই স্টেশনটি ব্যবহার করে থাকে। এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষী, টিকিট পরীক্ষক, রেল পুলিশ— অর্থাৎ সবাই মহিলা। প্রায় চল্লিশ জন মহিলা রেলওয়ে কর্মচারী রয়েছেন এই পিঙ্ক স্টেশনটি পরিচালনার দায়িত্বে।
মাটুঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন
মধ্য রেলওয়ের অধীনে অবস্থিত মুম্বইয়ের মাটুঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ভারতবর্ষের অন্যতম পিঙ্ক স্টেশন। অর্থাৎ এই স্টেশনটি সম্পূর্ণ মহিলাশাসিত একটি স্টেশন। এই স্টেশনটিতে স্টেশন ম্যানেজার থেকে শুরু করে সাফাই কর্মী— সবাই মহিলা। প্রায় ৪২ জন মহিলা কর্মচারী আছেন যাঁরা এই স্টেশনটিকে পরিচালনা করেন। ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ নারীচালিত মহিলা স্টেশন হিসেবে স্টেশনটির নাম লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নথিভুক্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-ব্যবসা বাড়ায় ১১ শতাংশ জিএসটি আদায় বৃদ্ধি

আজনি রেলওয়ে স্টেশন
মহারাষ্ট্রের দ্বিতীয় মহিলা পরিচালিত রেল স্টেশনটির নাম হচ্ছে আজনি রেলওয়ে স্টেশন। এই রেল স্টেশনটি সেন্ট্রাল রেলওয়ের মহারাষ্ট্রের নাগপুর সেকশনের একটি অংশ। প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজারের বেশি যাত্রী এই রেলওয়ে স্টেশনটি দিয়ে যাতায়াত করে। এই স্টেশনটি পরিচালনা করেন বাইশ জন মহিলা কর্মচারী।
নিউ অমরাবতী রেল স্টেশন
ভারতবর্ষের অন্যতম মহিলা-পরিচালিত রেল স্টেশন হচ্ছে নিউ অমরাবতী রেল স্টেশন। সেন্ট্রাল রেলওয়ের ভুসাবল ডিভিশনের এটা প্রথম পিঙ্ক স্টেশন। এই স্টেশনে স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে বুকিং এজেন্ট সবাই মহিলা। এই স্টেশনটি পরিচালনা করেন ১২ জন দক্ষ মহিলা কর্মী। এই অমরাবতী স্টেশনটিতে প্রতিদিন প্রায় তিনশো আশি জন যাত্রী যাতায়াত করে। সেন্ট্রাল রেলওয়ের অধীনে তৃতীয় পিঙ্ক স্টেশন হচ্ছে এই নিউ অমরাবতী স্টেশন। এই পিঙ্ক স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দশটি ট্রেন যাতায়াত করে।

আরও পড়ুন-পর্ষদ সভাপতি গৌতম পালকে রক্ষাকবচ সুপ্রিম কোর্টের

মণিনগর রেলওয়ে স্টেশন
মণিনগর রেলওয়ে স্টেশনটি আমেদাবাদে অবস্থিত। এই স্টেশনটিও মহিলা দ্বারা পরিচালিত একটি পিঙ্ক স্টেশন। এই স্টেশনটি মোট তেইশ জন মহিলা কর্মীর দ্বারা পরিচালিত হয়। স্টেশন মাস্টার থেকে সুইপার— এই পিঙ্ক স্টেশনে সকলেই মহিলা।
চন্দ্রগিরি রেলওয়ে স্টেশন
চন্দ্রগিরি রেলওয়ে স্টেশনটি অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত। এই স্টেশনটিও একটি মহিলা দ্বারা পরিচালিত পিঙ্ক স্টেশন। এই স্টেশনটিতে মোট ১২ জন কর্মচারী— সকলেই মহিলা।

আরও পড়ুন-পরিচালক গৌতম হালদারের প্রয়াণে শোক প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন
শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন হচ্ছে ভারতবর্ষের অন্যতম ঐতিহাসিক রেল স্টেশন। এই স্টেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বহু মনীষীর পদধূলি পড়েছে। আর এই শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা পরিচালিত স্টেশন তথা পিঙ্ক স্টেশন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে স্টেশনটি মহিলা স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে পয়েন্টসম্যান, পোর্টার, জুনিয়র কমার্শিয়াল ক্লার্ক, দু’জন গেট কিপার— সব মিলিয়ে ৩০ জন মহিলা কর্মী পরিচালনা করেন। পিঙ্ক স্টেশন হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য মানদণ্ডগুলো হচ্ছে স্টেশনগুলো অবশ্য করেই সব মহিলা কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, স্টেশনটিতে গোলাপি আলো থাকতে হবে, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং প্যানিক বোতাম অবশ্যই থাকতে হবে, এই স্টেশনগুলোতে মহিলাদের জন্য আলাদা করে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এবং অবশ্য করেই স্টেশনগুলোতে নারী-যাত্রীদের জন্য একটি হেল্প ডেস্ক থাকতে হবে।
ভারতীয় রেল ভবিষ্যতে আরও গোলাপি রেল স্টেশন খোলার পরিকল্পনা করছে। গণপরিবহণকে নারীদের জন্য নিরাপদ এবং আরও সহজলভ্য করার দিকে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

Latest article