কুচকাওয়াজের প্রমীলারা

২০২৪-এর সাধারণতন্ত্র দিবস প্যারেড থেকে ট্যাবলো— সবেতেই নারীশক্তির জয়জয়কার। কখনও মোটরবাইক নিয়ে বিপজ্জনক স্টান্ট, কখনও-বা কুচকাওয়াজের নেতৃত্বে, আবার কখনও আকাশপথে যুদ্ধবিমানও উড়িয়ে তাঁরা দেশকে করেছেন গর্বিত। কিন্তু কয়েক বছর আগেও ছবিটা এমন ছিল না। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, সেই অচলায়তন ভেঙে, মিথকে মিথ্যে করে সাফল্যের ঝান্ডা উড়িয়েছে প্রমীলা বাহিনী।

Must read

শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী: গতকাল অনুষ্ঠিত হল দেশের ৭৫তম বর্ণাঢ্য সাধারণতন্ত্র দিবস। অন্যান্য বছরের চেয়ে এই বছরের সাধারণতন্ত্র দিবস বিশেষভাবে উল্লেখনীয় কারণ হল প্রমীলা বাহিনী। গত বছর থেকেই শোনা যাচ্ছিল ২০২৪-এর সাধারণতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথের ঐতিহ্যবাহী কুচকাওয়াজ গড়বে নতুন ইতিহাস। হবে নারীশক্তির জয়জয়কার। সেইমতোই কিন্তু এদিন প্যারেড ছিল নারীময়। ঐতিহ্যের, গর্বের কুচকাওয়াজে অংশ নিলেন দেশের মহিলারা। এই বাংলার বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলমহলের কন্যা সুস্মিতা সরেন, বাঁকুড়ারই কোতলপুরের মেয়ে পূজা কোলে, দিনহাটার কোচবিহার কলেজের এনএসএস ছাত্রী গীতাদেবী রায়-সহ আরও অনেকে সাক্ষী থাকলেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের, নিজেরা গড়লেন ইতিহাস। পাশাপাশি ইতিহাস গড়ল ইন্ডিয়াস অল উইমেন ট্রাই সার্ভিসেস কন্টিজেন্ট ঐতিহাসিক ত্রয় অর্থাৎ এবার প্রথম এই কুচকাওয়াজে অংশ নিল তিন বাহিনী ইন্ডিয়ান আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সের মহিলাদের একটি যৌথ দল। আর তার নেতৃত্বও দিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহিলা অফিসার ক্যাপ্টেন শরণ্যা রাও। কুচকাওয়াজে ছিলেন মিলিটারি নার্সিং সার্ভিসের নার্স এবং মহিলা চিকিৎসকের দলও।

আরও পড়ুন-নজরে এবার নীতীশ, আপের পর ক্ষুব্ধ এবার জেডিইউ প্রধান

এই প্রথমবার বিএসএফের মহিলা বাহিনীর ১৪৪ জন মহিলা জওয়ান কুচকাওয়াজে অংশ নিলেন। নেতৃত্বেও ছিলেন মহিলা লেফটেন্যান্ট। দেশ তথা বাংলার ট্যাবলোরও এদিনের থিম ছিল নারীশক্তি। ডিআরডিও, নৌসেনা ও বায়ুসেনার ট্যাবলোয় মহিলাদের অংশীদারিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ট্যাবলোয় ছিলেন সব মহিলা আধিকারিকরা। দিল্লি রাজপথে সব নারীশক্তি মিলেমিশে একাকার হল। পুরুষ যে নারী ছাড়া অসম্পূর্ণ তারও এক অনন্য নজির দেখল এবারের সাধারণতন্ত্র দিবস। সেই নজির গড়লেন ক্যাপ্টেন সুপ্রীতা সি টি এবং মেজর জেরি ব্লেইজ। তাঁরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। দুটি আলাদা বাহিনীর সদস্য হিসাবেই কুচকাওয়াজে পা মেলালেন মেজর জেরি ব্লেইজ এবং ক্যাপ্টেন সুপ্রীতা সি টি। সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের ইতিহাসে এর আগে কোনও দম্পতিকে একসঙ্গে অংশ নিতে দেখা যায়নি। দুটো বিভাগে নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা। একদিকে ক্যাপ্টেন সুপ্রীতা কর্নাটকের মাইসুরুর বাসিন্দা। সেখানকার জেএসএস আইন কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে নাম লেখান সেনাবাহিনীতে। অন্যদিকে, মেজর ব্লেইজ তামিলনাড়ুর বাসিন্দা। তিনি বেঙ্গালুরুর জৈন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এখন দু’জনেই দিল্লি নিবাসী। শুধু দিল্লি কেন, কলকাতার রাজপথেও বিগত কয়েকবছরে একই দৃশ্যের দেখা মিলছে। এই রাজ্যে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে গর্বের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে রাজ্যেরই মহিলা সামরিক বাহিনী। স্বাধীনতা দিবসে রাজ্যের কুচকাওয়াজেও প্রতিবছরের মতোই এবার ‘মুখ’ হয়ে উঠলেন প্রমীলারা! কলকাতা পুলিশের প্রমীলা বাহিনী উইনার্স গ্রুপ-সহ আরও বেশ কিছু প্যারেডে অংশগ্রহণ করল। প্রতি বছর শুধু প্যারে়ডেই থেমে থাকেন না তাঁরা। মোটরসাইকেলে চেপে তাক লাগানো স্টান্টও দেখান। ট্যাবলোয় নজর কেড়েছে কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর মেয়েরা। এবং সবচেয়ে আনন্দের আর গর্বের বিষয় হল, তাঁদের পতাকা তুলে প্রতি বছর অভিবাদন নেন যিনি, তিনিও একজন মহিলা! আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন-নিখোঁজের দেহ উদ্ধার পুলিশের

গতবছর থেকেই শোনা যাচ্ছিল এই বছর সাধারণতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথে এক বড় ভূমিকা গ্রহণ করবে সামরিক প্রমীলা বাহিনী। মেয়েদের ক্ষমতায়নের এক নজির তৈরি হবে এই দিন। হলও ঠিক তাই। ৭৫তম সাধারণতন্ত্র দিবস গোটা বিশ্বের কাছে হয়ে রইল স্মরণীয়। বিগত বছরগুলোয় ২৬ জানুয়ারিতে তিন বাহিনীর মহিলা সদস্যরা অংশগ্রহণ করলেও এতদিন পর্যন্ত কুচকাওয়াজে পুরুষদেরই আধিপত্য ছিল। শুরুটা এমন ছিল না। সালটা ১৯২৯। পূর্ণ স্বরাজ ঘোষণা হয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে ভারতের প্রতীকী স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করল দেশবাসী। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২৬ জানুয়ারির পরিবর্তে এই দিনটাই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন হল। কিন্তু শুধু দেশ স্বাধীন হলেই তো হবে না, দেশ চালাতেও হবে। তার জন্য চাই নাগরিক আইনকানুন। ফলে দরকার পড়ল সংবিধান রচনার এবং সংবিধান রচনার পরে তা ভারতের গণপরিষদে কার্যকর করার জন্যও একটি দিনের প্রয়োজন ছিল। তখন সেই ঐতিহাসিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েই ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই সাধারণতন্ত্র দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হল। সেই দিন সকাল ১০টা বেজে ১৮ মিনিটে কার্যকর হয় ভারতীয় সংবিধান। ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র দিবসে প্রথম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হল আরউইন স্টেডিয়ামে যা বর্তমানে জাতীয় বা ন্যাশনাল স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ হিন্দি এবং ইংরেজি দুটো ভাষাতেই এই দিন দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন।

আরও পড়ুন-গলল বরফ? সাধারণতন্ত্র দিবসে ভারতকে শুভেচ্ছা কানাডার

এ ছাড়া সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হন ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেদিন সশস্ত্রবাহিনী ৩১ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে গান স্যালুটের মাধ্যমে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে বরণ করে নেয়। সশস্ত্রবাহিনীর তিনহাজার সদস্য সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। ওই বছর প্রথম প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ড. সুকর্ণ। এ ছাড়া পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এরপর তিন বছর কিংসওয়ে, লালকেল্লা ও রামলীলা ময়দানে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবার ১৯৫৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে দিল্লির রাজপথে অনুষ্ঠিত হতে থাকে এই কুচকাওয়াজ। প্রত্যেক বছরের কুচকাওয়াজের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত থাকেন এক বা একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। নিয়মমতোই থাকেন একজন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথমে আসেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির অশ্বারোহী দেহরক্ষীরা জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানান এবং শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত। তাঁকে জানানো হয় গান স্যালুট।
দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সাধারণতন্ত্র দিবসের এই কুচকাওয়াজ বা সামরিক মহড়া হল দেশের ঐতিহ্য ও গর্ব। যদিও বরাবর সেখানে পুরুষতন্ত্রের ছাপটাই ছিল স্পষ্ট। কিন্তু সৃষ্টির ইতিহাস হোক বা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস নারী জুড়ে রয়েছে সেই আদি থেকে অন্ত অবধি। বিনা সীতায় যেমন রাম অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনই নারীশক্তি ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজও অসম্পূর্ণ। তাই ‘কদম কদম বড়ায়ে যা, খুশি কে গীত, গায়ে যা’ মার্চপাস্টের এই সুরমন্ত্রে আজ শুধু পুরুষ নয়, নারীও পায়ে পা মেলায়। আজ কুচকাওয়াজ শুধু দেশের গর্ব নয়, তাতে অংশগ্রহণকারী প্রমীলা বাহিনীও আমাদের গর্ব। নারী ক্ষমতায়নের নিদর্শন রাখল দিল্লির রাজপথ। এমন অসাধ্যসাধন ঘটল তার কারণ হল কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন সামরিক বিভাগে লক্ষণীয়ভাবে মেয়েদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ। বিগত কয়েকবছরের মধ্যেই ইন্ডিয়ান আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে প্রমীলা বাহিনীর মোতায়েনের উদাহরণ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি কর্নেল গীতা রানা সেনাবাহিনীর প্রথম মহিলা আধিকারিক যিনি লাদাখে একটি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। সেটি ভারত-চিন আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে অবস্থিত৷ এ ছাড়া বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে ঠান্ডা সিয়াচেনে মহিলা আধিকারিক ক্যাপটেন শিবা চৌহানকে মোতায়েন করেছে সেনাবাহিনী৷ এটিও ভারতের সেনার ইতিহাসে প্রথম৷ সুদানের আবেয়িতে উপদ্রুত এলাকায় প্রথম মহিলা শান্তিবাহিনীকে পাঠিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী৷ এতে ২৭ জন মহিলা রয়েছেন৷ কাজেই সেনাবাহিনীতে এখন মহিলার ছয়লাপ।

আরও পড়ুন-সাধারণতন্ত্র দিবসে সম্প্রীতির বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর, সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তারা হাঁটলেন কুচকাওয়াজে

একটু পিছন ফিরলেই দেখতে পাওয়া যাবে কীভাবে সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে মিথ ভেঙে নারীশক্তি তাঁদের উত্থানের ধারাকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। যার সূচনা ২০১৫ সাল থেকে। এই বছরেই প্রথমবার সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে প্রথমবার তিন সেনাবিভাগেই শুধুমাত্র মহিলারাই কুচকাওয়াজ করেন।
এরপর আবার ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারিতে উল্লেখনীয়ভাবে কুচকাওয়াজে অংশ নেন প্রমীলারা। এই দিন সকালের কুচকাওয়াজে দিল্লির রাজপথে ‘সীমা ভবানী’ বাহিনীর সামরিক কসরত দেশ-বিদেশের অতিথিদের মুগ্ধ করেছিল। চলন্ত বাইকে এক অভূতপূর্ব স্টান্টের প্রদর্শন করে এই প্রমীলা বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে স্যালুট জানিয়েছিল।

আরও পড়ুন-দুই বিচারপতির বিতর্কে আজ সুপ্রিম শুনানি

২০১৮ সালটা এই বঙ্গের জন্যও বেশ স্মরণীয় কারণ কলকাতাতেও সেবার নারীরাই কুচকাওয়াজের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতার রেড রোডে বায়ুসেনার ট্যাবলোয় যুদ্ধবিমানের চালকের আসনে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জ্যোৎস্না চিকারাকে দেখা গিয়েছিল। জ্যোৎস্না নিজে যুদ্ধবিমানের পাইলট নন। তাঁকে প্রতীকী হিসেবেই ওই দিন উপস্থাপন করা হয়েছে। বিএসএফের পাশাপাশি দিল্লির রাজপথে সেনা, বায়ুসেনা এবং নৌবাহিনীর ট্যাবলো এবং প্যারেডে মহিলারা অংশগ্রহণ করেছিল। বায়ুসেনার ট্যাবলোয় ছিলেন তিন মহিলা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছন্দা, অদিতি এবং অমরদীপ। ছিলেন ফ্লাইং অফিসার শ্রুতি। স্থলসেনার ক্যাপ্টেন শিখা যাদব এবং নৌসেনার সাব-লেফটেন্যান্ট রূপা অংশ নিয়েছিলেন কুচকাওয়াজে।
উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং আইটিবিপির কুচকাওয়াজেও সেবার মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে প্রতিরক্ষায় মহিলাদের ক্ষমতায়নই যেন ফুটে উঠল।
২০১৯ সালে ৭০তম প্রজাতন্ত্র দিবসের সেনা কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অসম রাইফেলসের মহিলারা। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কুচকাওয়াজেও সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই প্রমীলারা। এইদিন ক্যাপ্টেন শিখা সুরভি প্রথম মহিলা অফিসার, যিনি সেনাবাহিনীর ডেয়ারডেভিল দলের বাইক স্টান্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাইকে চড়ে অবিশ্বাস্য স্টান্টের প্রদর্শনের জন্য বিখ্যাত সেনার ‘ডেয়ারডেভিল টিম’-এর বয়স ৮৪ বছর হলেও ২০১৯ সালেই প্রথম তাদের টিমে কোনও মহিলা অফিসার যোগ দিয়েছিলেন। শুধু নামে নয়, শিখা কাজেও ছিলেন ‘ডেয়ারডেভিল’। তথ্য-প্রযুক্তিতে বি-টেক হলেও খেলার মাঠে ছিলেন লড়াকু তাই মাত্র তিনমাসে বাইক কসরত শিখে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন শিখা সুরভি। সুরভির মতোই বায়ুসেনার দলের সামনে ছিলেন এক মহিলা ফ্লাইং অফিসার রাগি রামচন্দ্রন। সেবারের প্যারেডে অন্যান্য বাহিনীতেও মহিলা অফিসারদেরই জয়জয়কার ছিল। ইতিহাস তৈরি করেছিল অসমের মহিলা বাহিনী। তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর খুশবু কানোয়ার। ২০১২ সাল থেকে অসম রাইফেলসে কর্মরত ৩০ বছরের খুশবু দেশের প্রাচীন আধা সামরিক বাহিনীর মহিলা বিভাগের কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করলেন।
নৌসেনার কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার অম্বিকা সুধাকরণ। ভারতীয় সেনার পুরুষবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট ভাবনা কস্তুরী। প্রথম মহিলা অফিসার হিসাবে সেই সম্মানের অধিকারী হন তিনি।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

২০২০ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসে প্রথমবারের জন্য সিআরপিএফ মহিলাদের ডেয়ারডেভিলস টিম দিল্লির কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে। যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন সহকারী সাব ইন্সপেক্টর সুজাতা গোস্বামী।
দিল্লির বুকে প্রথম মহিলাদের বাইক র‍্যালি দেখা গেল ২০২০ সালেই। সিআরপিএফের ২১ মহিলা কর্মী পাঁচটি মোটরবাইকের উপর মানব পিরামিড বানালেন, নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর অনিতা কুমারী। মহিলাদের আরেক বাইক র‍্যালির নেতৃত্বে ছিলেন র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের ইনস্পেক্টর সীমা নাগ।
২০২১-এর কুচকাওয়াজে ফ্লাইপাস্ট প্যারেডের নেতৃত্ব দিলেন মহিলা পাইলট, এয়ার লেফট্যানেন্ট স্বাতী রাঠোর। যা দেশের মধ্যে এই প্রথম। রাজস্থানের নাগৌর জেলার একটি গ্রামে মেয়ে স্বাতীর দাদা ছিলেন ভারতীয় নৌসেনায় কর্মরত এবং বাবা উচ্চপদস্থ আধিকারিক। আইএএফ-এর কমন অ্যাডমিশন টেস্টে ২০১৩ সালে স্বাতী উত্তীর্ণ হন। পরের বছর তিনি ডাক পান দেরাদুনে, এয়ারফোর্স সিলেকশন বোর্ডের ইন্টারভিউয়ে। বাছাই পর্বের পরে ২০০ জন মহিলার মধ্যে শেষ অবধি স্বাতী-সহ মাত্র ৫ জন ছিলেন। স্বাতীর মতোই অচলায়তন ভেঙেছেন আর একটি মেয়ে, তিনি বায়ুসেনার ভাবনা কান্থ। শৈশবেই আকাশে ডানা মেলার স্বপ্ন জাঁকিয়ে বসেছিল। এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মানসবিহারী বর্মা ছিলেন ভাবনার প্রতিবেশী। এলসিএ তেজস-এর নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন মানসবিহারী। তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত হন ভাবনা। চাকরি ছেড়ে ভাবনা ভারতীয় বায়ুসেনায় যোগ দেন ২০১৬ সালে। স্বদেশপ্রেমী নিজেই স্বদেশের এই বর্ণময় গৌরবের অংশ হয়ে উঠলেন একদিন।

আরও পড়ুন-চার কন্যার কথা

দেশের ৭৩তম কুচকাওয়াজের দিন অর্থাৎ ২০২২-এর সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা যুদ্ধবিমান ফাইটার শিবাঙ্গী সিং, যিনি রাফাল যুদ্ধবিমান উড়িয়েছেন। শিবাঙ্গী হলেন দ্বিতীয় মহিলা যুদ্ধবিমানের পাইলট, যিনি বায়ুসেনার ট্যাবলোতে অংশ নিয়েছেন। এর আগেই ছিলেন ভাবনা কান্ত, যিনি বায়ুসেনার ট্যাবলোতে মহিলা যুদ্ধবিমান পাইলট হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। রাফাল যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার আগে শিবাঙ্গী মিগ-২১ বাইসন বিমান উড়িয়েছিলেন। শিবাঙ্গী বারাণসীর বাসিন্দা। পাঞ্জাবের আম্বালায় অবস্থিত আইএএফকে-এর গোল্ডেন অ্যারোস স্কোয়াড্রনের অংশ তিনি। ২০২০ সালে শিবাঙ্গী সিং খুব কঠিন সিলেকশনের মধ্যে দিয়ে সফল হন এবং রাফাল পাইলট হিসাবে নির্বাচিত হন।
২০২৩ অর্থাৎ গত বছর ৭৪তম সাধারণতন্ত্র দিবসে কুচকাওয়াজে আত্মনির্ভরতার বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছিল নারীশক্তিকেও। গত বছর প্রথম বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের উট-সওয়ারি মহিলা দলটি প্যারেডে অংশ নেয়। এই ক্যামেল বাহিনী রাজস্থান ফ্রন্টিয়ার এবং বিকানের ট্রেনিং সেন্টার দ্বারা প্রশিক্ষিত ছিল। উল্লেখনীয় যেটা ছিল তা হল শুধু ভারতে নয়, এটা হল বিশ্বে প্রথম নারী ক্যামেল বাহিনী। এই প্রথম দেশের রাষ্ট্রপতিকে স্যালুট জানাতে প্যারেডে অংশ নিয়েছিল মহিলা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স বা সিআরপিএফ। যে রাঁধে সে চুল বাঁধে এমন প্রবাদ যতই থাকুক, আজ শুধু চুল বেঁধে মেয়েরা ক্ষান্ত নন। জগদ্দল পাথরের অচলায়তন ভেঙে নতুন পথের দিশারি। আজ তাঁরা মিথ ভেঙে ফ্যাক্টের দলে। তাই নারীময় সাধারণতন্ত্র দিবস আমাদের গর্ব।

Latest article