পাঠকের কাছে দীপান্বিতা রায়ের পরিচয় দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। দীপান্বিতা শুধু প্রতিষ্ঠিত শিশু সাহিত্যিক নন। উনি এখন ছোট-বড় সকলের খুব প্রিয় লেখিকা। অনেক বই তাঁর, নানান রকমের।
তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা দীপান্বিতার। এখনও সাংবাদিকতা করেন। তাঁর বইয়ের মধ্যে সবথেকে যেটা বড় বৈশিষ্ট্য সেটা হল, তাঁর একটা বৃহত্তর জীবনবোধ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার’ পেয়েছেন, ‘গজেন্দ্রকুমার মিত্র সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার’ পেয়েছেন, ভূমধ্যসাগর পত্রিকার তরফ থেকে ‘সাধনা সেন পুরস্কার’ পেয়েছেন, ‘নীল দিগন্ত পুরস্কার’, ‘দশভুজা পুরস্কার’ এবং আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সবথেকে বড় পুরস্কার তিনি যেটা পেয়েছেন সেটা হল পাঠকের পুরস্কার। তাই দীপান্বিতার লেখাকে এত ভালবাসেন পাঠকেরা।
আরও পড়ুন-কাজের মানুষ, কাছের মানুষ
এবার নববর্ষে প্রকাশিত হয়েছে তার নতুন উপন্যাস ‘আধার বৃত্ত’। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখিকা জানালেন, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। এটা শুধু আমাদের সমাজে নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এটা সভ্যতার একটা যন্ত্রণা বলে তাঁর মনে হয়েছে। তিনি বলেন, আসলে পরিবারের মধ্যে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন এখনও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কিন্তু এই একই প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। যার ফল সারাজীবন ভোগ করে বেড়াতে হয় একজন সহজ-সরল নিষ্পাপ শিশুকে। কিন্তু বই পড়াটা যে কমেছে এটা তিনি মনে করেন না। বরং তিনি বলেন, বই পড়াটা একটা অভ্যাস এবং সেটা কিছুটা হয়তো কমেছে। কিন্তু সাহিত্যপাঠ এখনও বজায় আছে এবং মানুষ এখন বইটা বরং বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ছেন।
আরও পড়ুন-দুই চ্যানেলে দুই নতুন ধারাবাহিক
সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিন্তু স্রষ্টার একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। কারণ, যে কোনও সাহিত্যই সৃষ্টি হোক না কেন, যিনি এটি সৃষ্টি করুন না কেন, তিনি একজন ঔপন্যাসিক হতে পারেন, তিনি একজন ছোটগল্পকার হতে পারেন, তাঁর লক্ষ্য কিন্তু সবসময় থাকা উচিত মানুষকে দিশা দেখানো।
আমার শিল্প সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যদি আমি মানুষকে পিছিয়ে যেতে শেখাই তাহলে তো আমি সার্থক শিল্প সৃষ্টি করলাম বলে আমি মনে করি না। সব শিল্পীরই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। তাঁর চারপাশের মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, তাঁর সময়ের প্রতি।
এখনকার প্রজন্মের অনেকেই ভাল লিখছেন বলে তিনি মনে করেন। একটি কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন, এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ কিন্তু এখন তন্ত্র-মন্ত্র, ডার্ক ফান্টাসি— যেটা জীবনের অন্ধকার দিক নিয়ে লেখা সেগুলো তাঁর পছন্দ নয়।
লেখাটা পেশা নয়, কিন্তু তবু তিনি লেখেন। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যেই লেখেন। যদি কেউ তাঁকে লেখার অনুরোধ করে। সে ছোটদের জন্য লেখা হতে পারে অথবা বড়দের জন্য অথবা থ্রিলার গল্প কিংবা ভূতের গল্প। কারণ, লেখার জগতেই তাঁর বিচরণ। তিনি কিশোর ভারতীর সহ-সম্পাদক চুমকি চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-দুই চ্যানেলে দুই নতুন ধারাবাহিক
এবার বইমেলাতেও তাঁর একটি ছোট গল্পের সংকলন ‘খোলস’ পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বললেন, ‘এই সংকলনে ১৩টি নানান স্বাদের ছোটগল্প আমি লেখার চেষ্টা করেছি।’
গত দু-তিন বছর ধরে তিনি কিশোর ভারতীর কার্যনির্বাহী সম্পাদক। এরই পাশাপাশি পত্রভারতীতে যাঁরা বই প্রকাশের জন্য পাণ্ডুলিপি জমা দেন তাঁদের প্রত্যেকটি লেখা কিন্তু তিনি আপাদমস্তক পড়েন এবং কোনও লেখা ভাল লাগলে সেটি আরও দু-তিন জনের কাছে পাঠান। ৫৪ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে কিশোর ভারতী সাহিত্য পত্রিকা। আর তারই গুরুদায়িত্বভার বর্তমানে সামলাচ্ছেন চুমকি চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘শুকতারা’ ছোটদের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে ৭৫ বছর ধরে, আর আমাদেরটা কিশোরদের জন্য। তবু এই কর্মকাণ্ডের মধ্যেও তাঁর আক্ষেপ, আজকের দিনে বাংলা ম্যাগাজিন চালানো কিন্তু অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, বিজ্ঞাপনের অভাব। তবুও তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং শারদীয়া সংখ্যাটি যতটা সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁরা বিজ্ঞাপন পাওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি কিন্তু অকপটে জানান, বিজ্ঞাপন ছাড়া একটা ম্যাগাজিন চালানো সহজ কথা নয়। নিশ্চয়ই ভাবছেন, তবে কিশোর ভারতী কীভাবে চলছে? তা-ও অকপটে জানালেন তিনি। বললেন, শারদ সংখ্যায় যেটুকু বিজ্ঞাপন আমরা পাই তা দিয়েই প্রতি মাসের কিশোর ভারতীর সারা বছরের সংখ্যাগুলি আমরা প্রকাশ করার চেষ্টা করি। এটা বলতে পারেন সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা। একটা সময় এটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু এর ঐতিহ্যের কথা ভেবে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা।
আরও পড়ুন-বিরাট-রোহিত ঠিক রানে ফিরবে : সৌরভ
তিনি বলেন, আমরা আগে একটি গোটা উপন্যাস ছাপতাম। এখন সেটাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ পাঠকরা চান একটি গোটা উপন্যাসের বদলে অনেকগুলি গল্প পড়তে। তাই চৌষট্টি পাতার এই পত্রিকায় গল্পেরই প্রাধান্য।
ধারাবাহিক গল্প তো থাকেই। এরই পাশাপাশি আমরা প্রচুর সংখ্যায় গল্প দেওয়ার চেষ্টা করি, পাঠকরা সেটা বেশি পছন্দ করেন।
তাঁর সাফ কথা, যাঁরা তথাকথিত নামী লেখক তাঁরা তো নিয়মিত লিখছেনই। আমাদের এই পত্রিকায় এরই পাশাপাশি আমরা যেটা চেষ্টা করি, প্রচুর সংখ্যায় নতুন লেখক-লেখিকারা আমাদের কাছে যে পান্ডুলিপি জমা দেন প্রকাশের জন্য আমরা কিন্তু প্রত্যেকটি লেখা মন দিয়ে পড়ি এবং বোঝার চেষ্টা করি সেটির গুণগত মান। যদি আমাদের মনে হয় যে সত্যিই তার মধ্যে কোনও গুণগত মান আছে, আমরা কিন্তু তাঁকে হতাশ করি না। এভাবে কিন্তু বহু লেখক-লেখিকা আজ কিশোর ভারতীর হাত ধরে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন।
এই প্রজন্মের লেখিকাদের মধ্যে দেবারতি মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা সরকার, পল্লবী সেনগুপ্তর মতো অনেকেই জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু কিশোর ভারতীতে লিখছেন এখনও।
আরও পড়ুন-দুঃসময়ে চাহাল ছিল : কুলদীপ
একটা বিষয় তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি, এখন ডিজিটাল মাধ্যমে খুব সহজেই যে কোনও লেখক-লেখিকার বই মানুষ পড়তে পারছেন, হয়তো সেখানে জনপ্রিয়তাও পাচ্ছেন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার নিরিখে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় আদৌ সেই লেখা কতটা পাঠক-পাঠিকার কাছে গ্রহণযোগ্য হল। কারণ তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, যখন প্রিন্ট মিডিয়ায় তাঁর বই কোনও গ্রাহক সংগ্রহ করেন, তখন সেই বই বিক্রির সংখ্যা দিয়ে কিন্তু বুঝতে পারা যায় যে সত্যিই তিনি পাঠক-পাঠিকার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।
সায়ন্তনীর গড়িয়ায় বাস। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শখ। কবিতা ও গদ্য দুইই চর্চা করছেন। ক্লাস সেভেনে প্রথম প্রকাশ সংবাদ প্রতিদিনের শনিবাসরীয় পাতায় ‘চশমা’ ছোট গল্প। তারপর প্রতিদিন, বর্তমান, সুখী গৃহকোণ, আর ছোটদের পত্রিকা সাহানা আর বাংলা দেশের পত্রিকা ভোরের কাগজে লাগাতার লিখে যাওয়া।
লেখা নিয়েই থাকতে ভালবাসেন। লেখার মধ্যেই খুঁজে পান জীবনের বাঁচার রসদ। তাই তাঁর সৃষ্টি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহিলা লেখিকাদের নতুন প্রজন্মের স্বাদ পেতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কার পর এবার নেপালও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকছে
২০১১ থেকে টানা লিখে চলেছেন তিনি। প্রথম বই ‘আনন্দধারা’। পাঠকদের কাছ থেকে এই বই নিয়ে যে সাড়া তিনি পান, তার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর তাগিদে নিরন্তর লিখছেন, নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করছেন সায়ন্তনী। যদিও তিনি সাহিত্যের কোনও সীমারেখা আছে বলে মনে করেন না। কারণ, সাহিত্য মানুষের জীবন থেকে উঠে আসে। মানুষের জীবনবোধের কথা বলে, সাহিত্য মানুষের আদর্শের কথা বলে, এমনই বলছেন সায়ন্তনী।
নিজের লেখার মধ্যে তিনি সামাজিক সমস্যাকে হাইলাইট করার চেষ্টা করেন। তাঁর সব সময় লক্ষ্য থাকে পাঠকের কাছে এমনভাবে তিনি পৌঁছবেন যাতে তাঁর লেখা সামাজিক সমস্যাগুলি তিনি তাঁদের কাছে সহজেই তুলে ধরতে পারেন সাহিত্যের মাধ্যমে। তিনি বলছেন, সেটা কাশ্মীর সমস্যা হতে পারে, ভ্রুণহত্যা হতে পারে। এমনই নানান সমস্যার কথা, তা নিয়ে তাঁর চিন্তাধারার কথা তিনি প্রকাশ করেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে। এবারের বইমেলায় দুটি বই প্রকাশিত হলেও ‘ডেয়ার আর ডাই’ বইটি পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু কী আছে এই বইয়ের মধ্যে? আসুন শুনে নিই খোদ লেখিকার মুখ থেকে।
আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কার পর এবার নেপালও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকছে
তিনি জানান যে, থ্রিলারধর্মী এই লেখার মধ্যেই মূলত ভয় নিয়ে যে মানুষের ফোবিয়া এবং তার থেকে যে একের পর এক খুন করা হচ্ছে, তারই বিশ্লেষণ তিনি তুলে ধরেছেন এই লেখনীর মাধ্যমে।
নিজের লেখা নিয়ে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী কখনও কিন্তু কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন নতুন প্রজন্মের এই লেখিকা বরং তিনি বলছেন এবং এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন তাঁর একটি বই ‘একদিনের ঈশ্বর’ যেটি প্রথম প্রকাশের পর সমাদৃত হয়নি বরং সমালোচনার ঝড় উঠেছিল যদিও পরবর্তী সময়ে সেই বইটি কিন্তু পাঠকদের কাছে রীতিমতো সমাদৃত হয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু একদিনের ঈশ্বরের মধ্যে বর্তমান রাজনীতির কিছু কথা ছিল, ফলে অনেকেই অনেক কথা বলেছিলেন অনেকে অনেক সমালোচনা করেছিলেন, আমি কিন্তু আমার নিজের যে এক্সপেরিমেন্ট নিজের যে বোধ, চিন্তা-ভাবনার কথা— সেই জায়গা থেকে কিন্তু সরে আসেনি। কোনও লেখা যখন পাঠকমহলে সমাদৃত হয় জনপ্রিয়তা পায় তখন যে শুধুমাত্র সেটা তার গুণগতমানের জন্যই পায় সে-কথা কিন্তু মানতে নারাজ সায়ন্তনী। বরং তিনি বলছেন, কোন লেখা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেটা নির্ভর করে কোন চোখ দিয়ে আপনি সেই লেখাটা দেখছেন।
আরও পড়ুন-ফের আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলায় মৃত কমপক্ষে ৯
তিনি বলছেন, এই জনপ্রিয়তায় কিছুটা তো ভাগ্যের বিষয় আছে, আর কিছুটা জনচেতনার ওপর নির্ভর করে। এমন অনেক লেখা আছে যেগুলো গুণগত মানের দিক থেকে হয়তো অনেকটাই উঁচুস্তরের, কিন্তু পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। তাই জনপ্রিয়তার সঙ্গে গুণগতমানের সেভাবে কোনও সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। উৎকৃষ্ট জিনিস যে জনপ্রিয় হবে তার কিন্তু কোনও মানে নেই বরং এর উল্টোটাই হয়। এ-প্রসঙ্গে খুব সুন্দর একটি উদাহরণ তিনি তুলে আনেন।
লেখিকা স্বয়ং মনে করেন— এখন বিনোদনের নানান মাধ্যম। এই ডিজিটাল মাধ্যমের দৌলতেই যেভাবে সহজে একজন পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারছেন, তাতে কোনও ভাবেই বইয়ের প্রতি আকর্ষণ কমছে না। বরং অনেক বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে এখন বই পড়তে পারেন পাঠকরা। সেটা অডিও মাধ্যম হতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়া হতে পারে, পিডিএফ ডাউনলোড করে হতে পারে।
তিনি বলেন, এখন নতুন প্রজন্ম প্রথমে অডিও স্টোরিতে গল্পটা শুনছে। ভাল লাগলে তারপর কিন্তু সেই শ্রোতাই বইটি কিনে পড়ছে। ফলে এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিন্তু বই পড়ার পদ্ধতিও অনেকটাই বদলে গিয়েছে। লেখিকা স্পষ্ট বলছেন— বইপাগল মানুষ আগেও ছিল এখনও আছে। তাঁদের সংখ্যাটা কিছুটা কমলেও বইপ্রেমীরা কিন্তু আজও আছেন।
আরও পড়ুন-ফের আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলায় মৃত কমপক্ষে ৯
নিজের পরিবারের মধ্যে শিশুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়। এই নির্যাতনের ঘটনা একজনকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। আর তার চেয়েও বেশি কষ্টকর যেটা, যেটা যন্ত্রণার সেটা হল পরিবারের লোকজন পুরো ঘটনাটাকে চেপে যেতে চান ধামাচাপা দিতে চান। পরিবারের লোকজন মনে করেন, এতে তাঁদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে। যার ফলে তাঁরা বিষয়টি বাইরের লোকজন যাতে জানতে না পারে সেই জন্য পুরোপুরি চেপে যান। এর ফলে একটা ভীষণ রকমের অন্যায় করার গোপনীয়তার ভার ছোটদের মনের মধ্যে ভীষণ রকমের চাপ সৃষ্টি করে।
এমনও হয়েছে বাচ্চাটির কাছের মানুষ যাঁরা, বাবা-মা-দাদা-দিদি তাঁরা যদি বিষয়টি জানতে পারেন, তাঁদের মধ্যেও কিন্তু এই বিষয়টিকে গোপন রাখার জন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করে। যত রকমের জিনিস আমরা অনুধাবন করি, অনুভব করি, তার প্রত্যেকটা দিকের প্রতিফলন কিন্তু সাহিত্যে পড়তে পারে। সাহিত্য সবসময় জীবনের নানান ক্ষেত্রের প্রতিফলন। তাই সাহিত্যের কোনও সীমারেখা নেই। বিষয়ের দিক দিয়েও নেই, কোনও দিক দিয়েই নেই। আমি যখন কোনও গল্প লিখব, নাটক লিখব, উপন্যাস লিখব, কবিতা লিখব, যাই লিখি না কেন, তার ওপর নির্ভর করে বিষয় নির্বাচন। তার ওপর নির্ভর করে শব্দ চয়ন। তাই তার কোনও সীমারেখা হতে পারে না।
আরও পড়ুন-বাথটব-ওআরএস-পাখা-শাওয়ার-মিষ্টি জল, বাঘ বাঁচাতে পদক্ষেপ
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। মনে করুন, একটা উপন্যাস। সেই উপন্যাসটা যখন তার স্বাভাবিক গতিতে এগোতে থাকে, তখন তার বিষয়ের প্রয়োজনে সেখানে যদি কোনও নারীসংসর্গের কথা আসে, কোনও যৌনদৃশ্যের কথা আসে। সেটা যদি স্বাভাবিকভাবে আসে এবং লেখক সেটাকে যেভাবে মনে করবেন পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য উপস্থাপিত করবেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু সত্যিই কোনও সীমারেখা নেই। কিন্তু যদি মনে হয় যে সেটা অপ্রয়োজনীয় শুধুমাত্র কাউকে আকর্ষণ করার জন্য, কারও কাছে পৌঁছানোর জন্য সেটাকে সেখানে যোগ করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে কিন্তু আমি সেটাকে বলব সাহিত্যের জন্য অপ্রয়োজনীয়।
তিনি জানিয়েছেন, কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন। রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর কিছু সচেতনতা রয়েছে। সাধারণ মানুষ অর্থাৎ আমজনতার যে মতামত সেটা অগ্রাহ্য করা উচিত নয় বলে মনে করেন। আমি আমার লেখার মধ্যেও রাখার চেষ্টা করি, মানুষের সমস্যার কথা, মানুষের ভাল লাগার কথা, মানুষের যন্ত্রণার কথা। এটা আমার লেখার মধ্যে থাকে।
আরও পড়ুন-পুড়ছে দিল্লি, বহু রাজ্যে কমলা সতর্কতা
আমি কখনও এমন লেখা লিখতে চাই না যেটা নেতিবাচক। যেমন মনে করুন, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, হিংসা-মারামারি, কুসংস্কার যা মানুষকে পিছনের দিকে ঠেলে দেবে। আমি এগুলোকে আমার লেখার মধ্যে অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করি।
তাই ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আমার একটা ঝোঁক ছিল এবং বলতে পারেন স্কুলেও আমার লেখার জন্য আমি বেশ জনপ্রিয় ছিলাম। পরবর্তী সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং নবনীতা দেব সেন, ড. অমিয় দেব, মানবেন্দ্রবাবু এঁদের সংস্পর্শে এসেছি। সাহিত্য কী, কোন সাহিত্যটা ভাল, কোনটা ভাল নয়— এটা বিচার করার যে ক্ষমতা তা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁদের সংস্পর্শে এসে আমার মধ্যে একটা বোধ তৈরি হয়েছিল। আমি কিন্তু তখনই লেখা শুরু করিনি। আমি লেখা শুরু করি আরও কয়েক বছর পর ২০০৮ থেকে। নিয়মিত লেখা শুরু করেছি ২০১০ থেকে।
আরও পড়ুন-বহরমপুর ও জঙ্গিপুরে পথে নামল ‘উইনার্স স্কোয়াড’
তিনি কিন্তু স্পষ্ট জানিয়েছেন, যে আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর পরও যদি তাঁর লেখা মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়, মানুষ তাঁর লেখাকে গ্রহণ করে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁর লেখার সার্থকতাকে তিনি স্বীকার করে নেবেন। তার কারণ, তিনি আজও টলস্টয় পড়েন, আজও তিনি বিভূতিভূষণ পড়েন, আজও তিনি তারাশঙ্কর পড়েন। তিনি বলেছেন, আমার লেখা যদি আমার সমসাময়িক পাঠকদের অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের কাছে পৌঁছতে পারে সেক্ষেত্রে আমি বুঝব যে আমি যা সৃষ্টি করেছি তা অনেক বেশি সার্থক। আমার লেখাটা কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে।
তাঁর স্পষ্ট কথা, বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশক, সম্পাদকের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী তাঁদের অনুরোধে তিনি বিষয়টি বদলেছেন কিন্তু তাঁর লেখার ধারায় কোনও কম্প্রোমাইজ তিনি করেননি। এখন এন্টারটেনমেন্টের নানান মাধ্যম।