স্মারক বক্তৃতা
সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। শুধু আজ নয়, বরাবর। বিভিন্ন সময় এই বক্তৃতা দিয়েছেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। শ্রোতাদের প্রবল আগ্রহ থাকে অনুষ্ঠানটি ঘিরে।
এই বছর বক্তৃতা দিলেন তিনবার জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সুধীর মিশ্র। বিষয় ছিল ‘ওটিটি তথা ওয়েব সিরিজের জমানায় সিনেমার ভবিষ্যৎ’।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের ভেটুরিয়ায় আহত কর্মীদের দেখে কর্মসূচি ঘোষণা কুণাল ঘোষের
তাঁর কথা শোনার জন্য ১৮ ডিসেম্বর শিশির মঞ্চে উপচে পড়েছিল ভিড়। কথা সমন্বয় করেন অনন্যা চক্রবর্তী। তিনি দর্শকদের সঙ্গে বক্তার আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেন।
শুরু করেন সুধীর। তিনি পণ্ডিত, জ্ঞানী। তবে বক্তৃতাটি কখনওই অকারণে ভারী করে তোলেননি। যেখানে যেটুকু প্রয়োজন, সেখানে সেটুকু প্রয়োগ করেছেন। ছাড়েননি মজা করতেও।
আলোচনায় উঠে এসেছে বিবিধ প্রসঙ্গ। বলেছেন সত্যজিৎ রায়ের কথা। ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় কীভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে এসেছে তরকভস্কি, বার্গম্যান, গোদার থেকে শুরু করে মৃণাল সেন, বাদল সরকার, মহেশ ভাট, সঞ্জয় লীলা বনশালী প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন-রাজ্যকে নিশানা করতে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বিপাকে দিলীপ ঘোষ
তাঁর মনে হয়েছে, সত্যজিৎ রায় যে কোনও সময় নতুন মাধ্যমকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি একজন মুক্তমনা। এই সময়ে থাকলে নির্দ্বিধায় স্বাগত জানাতেন ওটিটিকে। তবে তরকভস্কি, বার্গম্যান, গোদার ওটিটিতে অসম্ভব।
সুধীর মনে করেন, বাদল সরকার মানে আপামর বাংলা। তাঁর সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। এ-ও জানান, বাদল সরকারের বিভিন্ন নাটকের মুহূর্ত সিনেমার ফ্রেমকে বুঝতে বিশেষ সাহায্য করে।
কনটেন্ট নিয়ে তিনি বলেছেন কিছু কথা। তাঁর মতে, বদলে গেছে সব। এখন আর রেণু সালুজার মতো সম্পাদকের দেখা পাওয়া দুষ্কর। মুম্বইয়ের সবাই ব্যস্ত কনটেন্ট নির্মাণে। এমনকী একজন সাধারণ ক্যামেরাম্যানও।
আফসোস ঝরে পড়েছে গলায়। তিনি বলেন, ওটিটি ভরপুর স্বাধীনতা দিয়েছে নির্মাতাদের। তবু সবাই পিছনের দিকে হাঁটছে। নির্ভর করছে গোয়েন্দা কাহিনি, ভৌতিক কাহিনি, যৌনতা এবং জটিলতার উপর। প্রতি মুহূর্তে কাজ করে দর্শক হারানোর প্রবল চাপ।
দীর্ঘ বক্তৃতা। তবে শ্রোতারা বিন্দুমাত্র বোর ফিল করেননি। কারণ শুরু থেকে শেষ নিজস্ব স্টাইলে সুধীর উচ্চারণ করেছেন তাঁদের মনের কথা। সব মিলিয়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে আসরটি।
আরও পড়ুন-জেনারেল সেক্রেটারি কাপ ঘিরে তুমুল উদ্দীপনা নয়াগ্রামে, লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম জয়ের বার্তা
দুই সেরা ছবি
মুহাম্মদ কাইয়ুম পরিচালিত ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’। বাংলাদেশের ছবি। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি হতদরিদ্র কৃষক পরিবারকে। অনিশ্চিত জীবন তাদের। কোনও বছর ঘরে ফসল ওঠে, কোনও বছর চলে যায় জলের তলায়। সুখ-দুঃখকে সঙ্গী করেই দিন গুজরান। পরিবারের বৃদ্ধ কর্তার কাছে কাজের আশায় আসে দূর গাঁয়ের এক নিরীহ যুবক। নিজের সংসারে ঠাঁই নেই। ধীরে ধীরে আপন করে নেয় পরকে। গায়ে-গতরে খাটে। ঘাম ঝরায়। জড়িয়ে যায় মায়ায়। এগিয়ে যায় নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। একটা সময় কৃষক পরিবারের বিধবাকে বিয়ে করে। এইভাবেই পাকাপোক্তভাবে জুড়ে যায় পরিবারটির সঙ্গে। তবে অভাব, অনটন একদিন তাদের বাধ্য করে ঘরে তালা ঝুলিয়ে অন্যত্র বেরিয়ে পড়তে।
ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এও এক পথের পাঁচালী। বাস্তবতার বড় কাছাকাছি। বড়বেশি নির্মম। কাহিনিচিত্র হলেও ছবিটিতে আছে প্রামাণ্যচিত্রের উপাদান। সামাজিক পরিস্থিতি, ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, চাষাবাদ, মিথ, গ্রামীণ উৎসব, মেলা, আচার-অনুষ্ঠান আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন-বাম বঞ্চনার জবাব মিলেছে
জানা যায়, পরিচালক ২০০০ সালের দিকে ছবিটি তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু আর্থিক কারণে সম্ভব হয়নি। কয়েক বছরের অপেক্ষা। ২০১৭ সালে প্রাক-প্রযোজনা শুরু। চিত্রগ্রহণের কাজ হয় বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলায়।
অভিনয় করেছেন জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সামিয়া আক্তার বৃষ্টি, সুমি ইসলাম, বাদল শহিদ, মাহমুদ আলম, আবুল কালাম আজাদ। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই থিয়েটারের শিল্পী।
প্রিমিয়ার হয়েছে ২০২২-এর ২৯ অক্টোবর। একটা সময় মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কারণ অসামান্য নির্মাণ হলেও ছবিটি বাণিজ্যিক ধারার বিপরীতে। অনেক চেষ্টায় নভেম্বরে মুক্তি পায়। তারপর সোজা ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। নানাভাবে উপেক্ষিত সেই ছবিই এই চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পুরস্কার।
আরও পড়ুন-চাপ আমার সেরা খেলা বের করে আনে : শ্রেয়স
আরও একটি ছবি সেরা ছবি হিসেবে পেয়েছে গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পুরস্কার। স্পেনের ‘আপঅন এন্ট্রি’। আলেজান্দ্রো রোজাস এবং জুয়ান সেবাস্তিয়ান ভাসকুয়েজ রচিত এবং পরিচালিত এই ছবির কাহিনি একটু অন্যরকম।
ভেনিজুয়েলার নাগরিক দিয়েগো, বার্সেলোনার নাগরিক নৃত্যশিল্পী এলেনা। নতুন জীবন শুরু করার জন্য অনুমোদিত ভিসা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উড়ে যায়। উদ্দেশ্য, কেরিয়ারের উন্নতি এবং সুন্দর জীবনযাপন। কিন্তু নিউ ইয়র্ক বিমানবন্দরের অভিবাসন অঞ্চলে পা রাখার পর, দু’জনকেই সেকেন্ডারি পরিদর্শন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মুখোমুখি হতে হয় সীমান্ত অফিসারদের নানারকম অপ্রীতিকর প্রশ্নের।
এই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে এমন কিছু গোপনীয়তা সামনে আসে, যা তারা আগে একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করেনি। ফলে চরম অস্বস্তিতে পড়ে দু’জন। কালো মেঘের মতো অবিশ্বাস নেমে আসে তাদের সম্পর্কে। তৈরি হয় জটিলতা। যদিও শেষপর্যন্ত তারা আমেরিকায় প্রবেশের অধিকার পায়।
আরও পড়ুন-বাংলার মুকেশ ৫ কোটিতে দিল্লিতে কেকেআরে শাকিব ও লিটন
টানটান উত্তেজনা ছবি জুড়ে। দুর্দান্ত চিত্রনাট্য, চোখা চোখা সংলাপ সেইসঙ্গে আলবার্তো আমম্মান, ব্রুনা কুসি, বেন টেম্পেল, লাউরা গোমেজের স্মার্ট অভিনয় ছবির মস্তবড় সম্পদ।
ইন্টারন্যাশন্যাল কম্পিটিশন অন ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস ক্যাটেগরিতে ছিল এই দুই ছবি। সেরার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছে ৫১ লক্ষ টাকা পুরস্কার মূল্য।
আড্ডা, আলোচনা
নন্দন চত্বরের একতারা মুক্তমঞ্চ। প্রতিদিন মুখরিত হয়ে উঠেছিল জমজমাট ‘সিনে আড্ডা’য়।
১৭ ডিসেম্বরের বিষয় ছিল ‘চরিত্র না তারকা’। ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বনি সেনগুপ্ত, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, ইশা সাহা, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাজ চক্রবর্তী, সৌরভ দাস এবং বাংলাদেশের দুই তারকা চঞ্চল চৌধুরি ও নাজিফা টুসি। শুরুতেই বক্তব্য রাখেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ভাত এবং বিরিয়ানির উদাহরণ টেনে বলেন, আমি চরিত্র এবং তারকা দুটোরই পক্ষে। চঞ্চল চৌধুরি বলেন, আমি চাই দর্শকরা আমার অভিনীত চরিত্রটি মনে রাখুন। স্টারডম পছন্দ করি, তবে আমার কাছে অভিনয়ের গুরুত্ব বেশি।
আরও পড়ুন-আমেরিকায় প্রবল তুষারঝড়ের শঙ্কা, বাতিল হল চার হাজার উড়ান
১৮ ডিসেম্বরের ছিল সুরেলা আড্ডা। বিষয় ছিল ‘সুর আগে না গান’। ছিলেন হৈমন্তী শুক্লা, সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়, জোজো, লগ্নজিতা, রণজয়, অন্বেষা, অর্ক। সঞ্চালনা করেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। কথা বলার পাশাপাশি প্রত্যেকেই শোনান গান।
১৯ ডিসেম্বরের বিষয় ছিল ‘সমালোচক না বক্স অফিস’। ছিলেন হরনাথ চক্রবর্তী, পথিকৃৎ বসু, ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত সেন, শম্পালি মৌলিক, দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায়, শময়িতা চক্রবর্তী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন অরিন্দম শীল।
হরনাথ চক্রবর্তী বলেন, সেই সময়ে ভিড় সামলে দশ সপ্তাহ না চললে হিট বলা হত না। এখন তার ব্যাপ্তি দাঁড়িয়েছে তিন সপ্তাহে। আগে ডিস্ট্রিবিউটররা সিনেমা প্রচারের জন্য যুদ্ধ করত। এখন সেটা প্রোডাকশন হাউসের কোর্টে দাঁড়িয়েছে।
২০ ডিসেম্বর বিষয় ছিল ‘হাস্যকৌতুক কি শারীরিক ভঙ্গিমা না টাইমিং’। উপস্থিত ছিলেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, খরাজ মুখোপাধ্যায়, পার্থসারথি চক্রবর্তী, অনির্বাণ চক্রবর্তী। সঞ্চালনায় ছিলেন বিশ্বনাথ বসু।
আরও পড়ুন-বন্ধুর টানে মেসির বাড়িতে সুয়ারেজ
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, শারীরিক ভঙ্গিমা এবং টাইমিং, হাস্যকৌতুকের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়েই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।
তাঁকে সমর্থন করেন অন্যান্য অতিথিরা। আলোচনায় হাসি ছড়ানোর পাশাপাশি তর্কাকর্কিও হয়েছে। নানা প্রসঙ্গে উঠেছে রবি ঘোষ, ভানু বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের নাম। ওঁদের অভিনীত বেশ কিছু মূল্যবান ছবির প্রসঙ্গ তোলা হয় এবং সেই সঙ্গে সেই ছবিতে ব্যবহৃত হাস্যকৌতুকটি কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, সেই নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়।
২১ ডিসেম্বর সিনে আড্ডায় স্মরণ করা হয় উস্তাদ আলি আকবর খাঁকে। ‘স্বরসম্রাট তোমারে সেলাম’ শীর্ষক আসরে উপস্থিত ছিলেন পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত তন্ময় বসু, পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। কথা সমন্বয়ে ছিলেন স্বপন সোম। বাংলা আকাদেমি সভাঘরে আয়োজিত হয় মাস্টার ক্লাস। ১৭ ডিসেম্বর মুখোমুখি বসেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায় এবং অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। একটি ভাবনা কীভাবে চলচ্চিত্রের রূপ নেয়, সেই বিষয়ে জমে ওঠে তাঁদের আলোচনা। ১৯ ডিসেম্বর ছিলেন অভিনেতা নীরজ কবি। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন সোহিনী সেনগুপ্ত। একজন ব্যক্তি কীভাবে অভিনেতা হয়ে ওঠেন, কথাবার্তায় বলেন নীরজ। ২০ ডিসেম্বর ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক শাজি এন কারুন। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে ছিলেন অতনু ঘোষ। নিজের কাজ নিজের কথা বলার পাশাপাশি শাজি বলেন, শিল্পের অন্যতম বড় দায় কালসীমার প্রসঙ্গে সৎ থাকা।
আরও পড়ুন-গদ্দার, বেইমান-মুক্ত জেলা গড়ার ডাক
পাশাপাশি আয়োজিত হয় টক শো। অংশ নেন চলচ্চিত্র জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ। নন্দন-৪-এ প্রতিদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দেশ-বিদেশের বহু বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রযোজক-পরিচালক। তাঁরা বলেন নিজেদের ছবি সম্পর্কে।