সংবিধানের বিপ্রতীপে নাগরিক প্রহর যাপন ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় স্পষ্টতর সেই কৃষ্ণ-ছায়া। প্রত্যর্থীর অনুভব তীক্ষ্মতর হচ্ছে একটি বইয়ের পাতা ওলটালেই। জাতির বিবেকের বারুদ খুঁজছে সেই বইয়ের লিপি ও অক্ষর। লিখছেন দেবাশিস পাঠক
‘The long shadow of the Emergency years’ আমাদের সসসাময়িক ভারত-জীবনেও বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বইয়ের পাতায় এরকম বাক্য পড়লে চমকে উঠতে হয়। দেখে নিতে ইচ্ছে করে, এই বইয়ের প্রকাশকাল ১৯৭৫-‘৭৭ – এর আশেপাশে কি না। সেই তারিখ জানলে বিস্ময় আরও গাঢ় হয়। বইটি সদ্য প্রকাশিত। ২০২২-এর ১০ জানুয়ারিতে।
গাঢ়তর বিস্ময়ের কারণ দুটি।
আরও পড়ুন-বাঁচানো গেল না নাজমা বিবিকে
এক, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, আজ থেকে ৪৭ বছর আগে এদেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। দিনক্ষণ দেখে বললে, ১৯৭৫-এর ২৫ জুন। ২১ মাস জারি ছিল তা, ইন্দিরা জমানায়। প্রত্যাহৃত হয়েছিল ২১ মার্চ, ১৯৭৭-এ। অর্থাৎ, গত সোমবার, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ৪৫ বছর পূর্ণ হল।
দুই, এটা ইন্দিরা গান্ধীর জমানা নয়। ভারত এখন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর গেরুয়া সংঘ শাসিত দেশ। মোদি জমানায় এখনও সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা মোতাবেক কোনও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি।
এবং, তাক লেগে যায় তখন, যখন এই বইয়ে তুলে ধরা ছ’টি লক্ষণ যে বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিসরে ফুটে বের হচ্ছে না, সে কথাটা জোর দিয়ে বলার মতো তাকত জোটে না কিছুতেই।
আরও পড়ুন-গ্যাস-পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ পথে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ
কী সেই ভয়ানক, অকাট্য আধ ডজন লক্ষণ, যা নিশ্চিত প্রত্যয়ে ঘোষণা করছে জরুরি অবস্থার প্রলম্বিত ছায়া এখনও এদেশ ছেড়ে যায়নি?
কী সেই ষড় বৈশিষ্ট্য, যা এদেশে বিরাজিত থাকায় বেশ বোঝা যাচ্ছে, ভারত সংবিধান শাসিত অবস্থার উলটো দিকে চলাটা ক্রমশ রপ্ত করে ফেলছে এবং এমন প্রগাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রহর আমাদের সমাজ-রাজনীতির পরিমণ্ডলটিকে এভাবে, আস্তে আস্তে কিন্তু নিশ্চিতভাবে, আলোক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে ?
ছটি লক্ষণের প্রথম লক্ষণ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কাঁথায় আগুন দেওয়া। মোদি জমানার তাবৎ সিদ্ধান্তে অন্তর্লীন হিন্দুত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা। ইতিপূর্বে, ক্ষীণ হলেও, এদেশের যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্তে মিশে থাকত সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের কল্যাণের প্রতি সুনির্দিষ্ট পক্ষপাত। হয়ত নিছক দেখনদারি। তবু ওই আবডালটুকূ ছিল। এখন সেই পক্ষপাতিত্ব বেহায়ার মতো নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি। এখানেই সংবিধান থেকে নড়ে যাওয়া বা সরে যাওয়া। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত, ভারতকে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশ হিসেবে নির্মাণ করার কথা। সংবিধানের প্রস্তাবনা আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও অনস্বীকার্য যে, সংবিধানের আদর্শ ও দর্শন, নীতি ও পথ, প্রস্তাবনা অংশেই বিবৃত। তাই প্রস্তাবনার কোনও কিছু অগ্রাহ্য করা মানে সাংবিধানিক মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এখন, সেই উল্টো পথে হাঁটাই চলছে।
আরও পড়ুন-গণতন্ত্রের মন্দিরের গরিমা নষ্ট করলেন বিরোধীরা
দ্বিতীয় লক্ষণ, সরকারি ব্যবস্থাপনাকে সক্রিয় রাখতে আগে সহায়ক শক্তি ছিল সুশীল সমাজ, তাদের মতামত, তাদের চিন্তাভাবনা। এখন সেই সুশীল সমাজের জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-এর নেটওয়ার্ক।
তৃতীয় লক্ষণ, বর্তমান শাসক শক্তির অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা। চুপচাপ সরকারি সিদ্ধান্তের সবকিছু মেনে নেওয়ার প্রবণতা। স্বাধীন মুক্ত চিন্তার দেশে, গণতান্ত্রিক আবহে এমনটা হয় না। সেখানে দ্রোহ থাকে, প্রতিবাদ থাকে, বিরুদ্ধ ভাবনার সোচ্চার উদ্ গীরণ থাকে। কিন্তু এদেশে ইদানিংকালে তেমনটা কোথায়? যেমন ধরা যাক নভেম্বর, ২০১৬-র কথা। নরেন্দ্র মোদীর তুঘলকি সিদ্ধান্ত। নোটবন্দির সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি কার্যকর হল। এটিএম-এ লাইন পড়ল। এবং সেই লাইন থেকে সেভাবে কোনও গণক্ষোভ জন্ম নিল না। দারুণ উপল্লবের আগুনে নিজেকে সেঁকল না জনজীবন।
চতুর্থ লক্ষণ, বেপরোয়া, কান্ডজ্ঞানহীন, হিতাহিত শূণ্য জনতার সশক্তিকরণ। এর স্পষ্ট প্রমাণ, দেশের নানা প্রান্তে (পশ্চিমবঙ্গ বাদে) গণপিটুনির ঘটনা, যেখানে ধর্মবিদ্বেষ প্রকাশ্যে শারীরিক হিংসার চেহারা নেয় অনায়াসে। অপছন্দের ধর্ম যাদের অবলম্বন তাদের যেকোনও ছুতোয় মেরে ফেলা যায়, এই বেপরোয়া প্রত্যয়।
আরও পড়ুন-বিজেপির তাণ্ডবে রেহাই পেলেন না মহিলা কর্মীরা
পঞ্চম লক্ষণ, আইন করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেওয়া। সংবিধানের প্রস্তাবনাতে ওই দুটি বিষয়ই উল্লিখিত। কিন্তু সিএএ বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং রাজ্যে রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গ নয়) পাস হওয়া ধর্মান্তরকরণ বিরোধী আইনে ওই দুই আদর্শ নিঃসন্দেহে বিসর্জিত ।
এবং ষষ্ঠ তথা অন্তিম লক্ষণ, কর্পোরেটের প্রতি প্রীতিপক্ষপাতমূলক আইনের সহায়তায় ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি।
এই লক্ষণসমূহের কথা বর্ণিত হয়েছে যে বইটিতে সেটির নাম ‘India’s Undeclared Emergency: Constitutionalism and the Politics of Resistance’। লেখক অরবিন্দ নারেন।
আরও পড়ুন-কালো দিন বিধানসভা রক্তাক্ত, নাকে রক্তক্ষরণ নিয়ে পিজিতে ভর্তি অসিত
লেখকের বক্তব্য, ১৯৭৫-১৯৭৭-এ যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল তাতে সংবিধানের সিলমোহর ছিল। এ কে গোপালন মামলায় (মে, ১৯৫০) শীর্ষ আদালতে বিচারপতি ভিভিয়ান বোস যতই নিবর্তনমূলক আটককে ‘আইনের তুচ্ছাতিতুচ্ছকরণ’ (pettifogging of law) বলে অভিহিত করুন কিংবা নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত মামলার আইনজীবী কে জি কান্নাবিরান যতই জরুরি অবস্থার সময় ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারি আইনজীবীদের দৃষ্টিতে কোনও কিছুই ‘অসঙ্গত’ (incongruous) মনে হয় না বলে ক্ষোভ ব্যক্ত করুন, এ কথা অনস্বীকার্য যে ওই কালপর্বে যা কিছু অন্যায় হয়েছে, যেটুকু স্বৈরতান্ত্রিকতা প্রদর্শিত হয়েছে, সবই সংবিধানের গন্ডির ভেতরেই। সংবিধানের বেড়া টপকিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি সে জমানায় ঘটেনি। এখন কিন্তু ঘটছে।
আরও পড়ুন-পাহাড়কে নিয়ে নতুন গান লিখলেন দূর্বা
লেখক আরও বলছেন, রাষ্ট্রশক্তি তখনও আদালতকে সমীহ করত। এখন তা বেপরোয়া। এই বক্তব্যের সমর্থনে নারেন উল্লেখ করেছেন প্রতিবাদী হলেই তার ওপর ইউএপিএ-র খাঁড়া নামিয়ে আনার প্রসঙ্গ। এতে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসরটি সংকুচিত হচ্ছে বলেই তিনি মনে করেন।
এরই পাশাপাশি সমগ্র বিচারব্যবস্থা তথা শীর্ষ আদালতের ভূমিকা লক্ষ করে তিনি হতবাক। বিশেষ করে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, নাগরিক আইনের সংশোধন ও ইলেকটোরাল বন্ডের ব্যবহারের মতো ইস্যুগুলোতে সু্প্রিমকোর্টের ভূমিকায় তিনি যারপরনাই বিস্ময়াবিষ্ট।
নভেম্বর, ১৯৪৯-এ গণ পরিষদে দাঁড়িয়ে আম্বেদকর বলেছিলেন, স্বাধীনতা সাম্য আর ভ্রাতৃত্ব সামাজিক পরিসরে গণতন্ত্র রক্ষার তিনটি আবশ্যিক শর্ত। এই শর্তগুলো পূরণের লক্ষ্যে ভারতকে তার একনায়কতান্ত্রিকতার অতীত থেকে বের করে আনার উদ্দেশ্যেই সংবিধান প্রণীত হল।
কিন্তু মোদি জামানায় সংবিধানের বেড়া টপকানো দাপাদাপি, কর্তৃত্ববাদের ঘন ঘন হুংকার আর তুঘলকি সিদ্ধান্তের বাড়বাড়ন্ত আম্বেদকরের হুঁশিয়ারিটাকেই পুনঃ পুনঃ মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আ-মোদি-ত, অঘোষিত জরুরি অবস্থার ফাঁদে পড়ে সংবিধান প্রণয়নের মুখ্য লক্ষ্যটাই আজ বেপথু। সেটাই ভয়ের। ভাবনারও।