বাংলার ছোট লাটসাহেব। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন। ক্লাসরুমে দেখতে পান, একটি ছেলে খাতার পাতায় পেনসিল দিয়ে কী সব আঁকিবুকি কাটছে! ছোট লাটসাহেব উঁকি মেরে দেখলেন, ছেলেটি সাদা পাতায় হুবহু তাঁর অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে! আঁকা দেখে রাগ করলেন না ছোট লাটসাহেব। বরং খুশি হয়ে ছেলেটির পিঠ চাপড়ে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে বললেন, খুব সুন্দর এঁকেছ। কোনও দিন এই চর্চা বন্ধ কোরো না। যখন বড় হবে, তখনও ছবি আঁকার চর্চা চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় দফায় বিশ্বভারতীর শোকজ ৭ অধ্যাপককে
ছেলেটি কে, জানতে ইচ্ছে করছে? তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ মে। নাম রাখা হয়েছিল কামদারঞ্জন। বাবা ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত শ্যামসুন্দর ওরফে কালীনাথ রায়। কামদারঞ্জন ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় পুত্র। তাঁদের আসল পদবি ছিল ‘দেও’। পরে হয়েছিলেন ‘দেব’। রায় তাঁদের উপাধি।
এই পরিবারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দত্তক নিয়েছিলেন পাঁচ বছরের কামদারঞ্জনকে। নাম দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তখন কি হরিকিশোর জানতেন, একদিন এই ছেলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র?
ছোট থেকেই উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন দারুণ মেধাবী। অসামান্য প্রতিভাবান। স্মরণশক্তি ছিল অকল্পনীয়। অঙ্ক এবং বিজ্ঞান ছিল তাঁর খুব প্রিয় বিষয়। তবে পড়াশোনা করতেন খুব কম। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু। যদিও ক্লাসে পড়ায় চটপট নির্ভুল উত্তর দিতেন। তাই কেউ কিছু বলতে পারতেন না।
আরও পড়ুন-রামমোহন রায় পুরস্কার ছৌগুরু হেমচন্দ্রকে
উপেন্দ্রকিশোর বেশি পছন্দ করতেন ছবি আঁকতে। পাশাপাশি ছিল তাঁর গানবাজনার শখ। আপনমনে বাজাতেন বাঁশি, বেহালা। জমিদারির দিকে বিন্দুমাত্র মন ছিল না তাঁর। সেসব সামলাতেন ভাই।
১৮৭৯ সাল। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে পনেরো টাকা বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করলেন উপেন্দ্রকিশোর। তারপর মসুয়া ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে লাভ করেন উচ্চশিক্ষা।
তখনই তিনি ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই নেন ব্রাহ্মসমাজের সভ্যপদ। গোঁড়া হিন্দু পরিবারের ছেলে ব্রাহ্ম হয়েছে, ভাল চোখে দেখেনি পরিবার। তাতে দমে যাননি উপেন্দ্রকিশোর। ১৮৮৬ সালে ব্রাহ্মকণ্যা বিধুমুখীকে নিজের পছন্দে বিবাহ করেন। তখন উপেন্দ্রকিশোরের বয়স ২৩ বছর।
আরও পড়ুন-নব জাগরণের প্রথম আলো নিভিয়ে উল্টো পানে চলো
উপেন্দ্রকিশোর নিয়মিত যেতেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। গভীর বন্ধুত্ব হয় ২ বছরের বড়, বিস্ময়-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। উপেন্দ্রকিশোর বহুবার বেহালায় সঙ্গত করেছেন
ঠাকুরবাড়ির মাঘোৎসবে বিভিন্ন গানের সঙ্গে। পাশাপাশি বেহালার পাশাপাশি বাজাতেন সেতার, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, বাঁশি। ক্যামেরায় তুলতেন ছবি।
শিশুসাহিত্য-অন্ত প্রাণ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ভাবতেন ছোটদের কথা। শিশুসাহিত্য পড়তেন এবং লিখতেন। সেইসময় ঠাকুরবাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথের মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত ‘বালক’ পত্রিকা। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন এই পত্রিকার পাঠক। পরে ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরোয় ‘মুকুল’, ‘সখা ও সাথী’ নামে শিশুপত্রিকা। উপেন্দ্রকিশোর পত্রিকা দুটিতে বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখতেন। এইভাবে ছড়াতে থাকে তাঁর নাম। তবে পত্রিকার মুদ্রণ তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারত না। কারণ বেশ কিছু সময় আগে থেকেই তিনি ছোটদের উপযোগী বিদেশি বইপত্র পড়ছেন, কীভাবে উন্নত মুদ্রণ ব্যবস্থা দেশে আনা যায় ভাবনাচিন্তা করছেন। ১৮৯৫ সালের মধ্যেই তিনি ছবি এনগ্রেভ করা, ছাপার কাজ নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন। তখনই তিনি পেয়েছিলেন হাতেকলমে মুদ্রণের কাজ শুরু করার আত্মবিশ্বাস।
একদিন বিলেত থেকে নিজের খরচে যন্ত্রপাতি আনিয়ে বসালেন নিজস্ব ছাপাখানা। নাম দিলেন ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। ভারতে সেই প্রথম শুরু হল হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং। এইভাবে উপেন্দ্রকিশোর মুদ্রণশিল্পে সৃষ্টি করেছিলেন নতুন ইতিহাস।
আরও পড়ুন-৩১ মে বন্ধ রেল?
এখানেই থেমে থাকলেন না। চলতে থাকল মুদ্রণ নিয়ে তাঁর নিত্যনতুন গবেষণা। লিখতে থাকলেন একটার পর একটা ইংরেজি প্রবন্ধ। পাঠাতে থাকলেন বিলেতের বিখ্যাত মুদ্রণ এবং ফোটোটেকনিক সংক্রান্ত পত্রিকা ‘পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল’-এ। তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হলেন সাহেবরা। প্রকাশিত হতে থাকল প্রায় প্রতিটি লেখা। অস্বীকার করার উপায় নেই, উপেন্দ্রকিশোরের উন্নত ও আধুনিক ভাবনাচিন্তায় বদল ঘটেছিল সারা পৃথিবীর মুদ্রণশিল্পে।
পাশাপাশি জোরকদমে চলছিল সাহিত্যচর্চা। ছোটদের জন্য সহজ সরল ভাষায় উপেন্দ্রকিশোর লিখলেন রামায়ণ ও মহাভারত। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’। লুফে নিল কচিকাঁচারা।
ছোটদের জন্য আরও লিখলেন ‘টুনটুনির বই’, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ প্রভৃতি। পরবর্তী সময়ে তাঁর নাতি সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রায়িত করেন। সেই ছবি মন জয় করে নেয় সব বয়সের দর্শকদের।
আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক, এবার ভারতেও জারি সতর্কবার্তা
ছোটদের পাশাপাশি উপেন্দ্রকিশোর বড়দের জন্য লিখলেন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, সংগীত ও চিত্রকলা বিষয়ে প্রবন্ধ, ব্রহ্মসংগীত, ধর্মসংগীত।
পঞ্চাশ বছর বয়সে, ১৯১৩ সালে, উপেন্দ্রকিশোর প্রকাশ করলেন ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’। আরও একবার তাঁর হাত ধরে রচিত হল নতুন ইতিহাস। যেমন লেখা, তেমন ঝকঝকে ছাপা। তাঁর সম্পাদনায় অল্প দিনেই জনপ্রিয়তা অর্জন করল ‘সন্দেশ’। এই পত্রিকায় লিখেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, কুমুদরঞ্জন মল্লিক প্রমুখ।
আরও পড়ুন-সংখ্যালঘু ভেবে হিন্দু প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারল বিজেপি নেতা
উপেন্দ্রকিশোর ২ বছর ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর, ৫২ বছর বয়সে তিনি পাড়ি দেন না-ফেরার দেশে।
আজও থেকে গেছে তাঁর সৃষ্টি, তাঁর অসংখ্য লেখা। মুদ্রণশিল্পে তাঁর অবদান বিনম্রচিত্তে স্মরণ করা হয়। আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা? তিনি চলে যাবার পর হাল ধরেন পুত্র কবি সুকুমার রায়। পরবর্তী সময়ে সুবিনয় রায়, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, নলিনী দাশ প্রমুখ পালন করেছেন সম্পাদকের দায়িত্ব। বর্তমান সম্পাদক সন্দীপ রায়। এইভাবেই উত্তরসূরিদের হাত ধরে আজও এগিয়ে চলেছে উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষ অতিক্রান্ত পত্রিকাটি।
যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততদিন পাঠকদের মনে থেকে যাবে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর অসামান্য স্রষ্টার নাম।