সবকিছুই কি হিসাব মতো হয় সবসময়? মনে হয় না। ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখতে পাই পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত আবিষ্কার হঠাৎ করেই হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি এমন অনেক মানুষকে আমরা খুঁজে পাই, ছোটবেলা থেকে নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা শুধু সফলই হননি, পৃথিবীর বুকে বিশেষ কৃতিত্ব স্থাপন করে গেছেন। সামান্য কোনও ঘটনা কিংবা কারও ছোট্ট একটা কথা তাঁদের জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। তেমনই একজন কীর্তিময়ী নারী হলেন প্রেমলতা আগরওয়াল। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে যিনি সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করেছেন।
আরও পড়ুন-বল বীর…
প্রেমলতার সাফল্যের এই যাত্রাপথ বেশ চমকপ্রদ। যাকে এককথায় বলা যায় ‘হেরো থেকে হিরো।’ যে মেয়ে কোনওদিন পাহাড় চড়ার স্বপ্ন দেখেনি, উচ্চতাকে ভয় পেত যে মেয়ে, সেই তিনিই কিনা ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেন সাত মহাদেশের সপ্তশৃঙ্গ জয়ী মহিলা হিসেবে। এর থেকে চমকপ্রদ আর কী হতে পারে!
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার এক ছোট্ট গ্রাম সুখিয়াপোখরিতে প্রেমলতার জন্ম। বাবা রাম অবতার গর্গ আর মা সারদাদেবী। তিরিশ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবারের নয় শিশুর সঙ্গে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন প্রেমলতা। পাহাড়ি এলাকার মেয়ে প্রেমলতা। ছোটবেলা থেকে পাহাড়ের প্রতি ভালবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনওদিন ভাবেননি পর্বতারোহণের কথা। তবে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলোর প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। স্কুলের সমস্ত খেলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। দুর্ভাগ্য তাঁর, জিততে পারতেন না। তবে কখনওই আশা ছাড়তেন না। প্রত্যেকবার ভাবতেন এবার হয়নি, পরেরবার ঠিক হবে। বন্ধুরা ঠাট্টা করত। সেসব গায়ে মাখতেন না। ভাইয়েরা খেলাধুলোয় ভাল। ঘরে তাঁদের অনেক ট্রফি, মেডেল সাজানো থাকত। সেগুলো দেখে একটা তীব্র আফসোস জেগে উঠত মনে। ভাবতেন, এসবের মধ্যে তাঁর একটা ট্রফি বা মেডেল যদি থাকত! কিন্তু সে বাসনা পূর্ণ হয়নি।
আরও পড়ুন-শুরু হল বিধানসভার বাদল অধিবেশন, নজিরবিহীনভাবে শোকপ্রস্তাব পর্বেও থাকল না বিজেপি
দার্জিলিঙের স্কুলে তাঁর পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরপরই মাত্র আঠারো বছর বয়সে প্রেমলতার বিয়ে হয়ে যায় বিমল আগরওয়ালের সঙ্গে। এত কম বয়সে বিয়ে করতে চাননি তিনি। চেয়েছিলেন আরও পড়াশোনা করতে। কিন্তু বাড়ির লোক রাজি হননি। একপ্রকার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের পর আসেন ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে। শুরু হয় সাদামাঠা গৃহবধূর জীবন। উনিশ বছর বয়সে প্রথম মেয়ে প্রিয়াংকা আর তেইশ বছর বয়সে দ্বিতীয় মেয়ে রাজশ্রীর জন্ম হয়। পুরোপুরি সংসার জীবনে ডুবে যান তিনি। যে জীবনে খেলাধুলো দূরে থাক, নিজের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবার অবকাশও ছিল না। তবে খেলার প্রতি ভালবাসা হারিয়ে যায়নি।
প্রেমলতা নিজে খেলাধুলোয় সফল হতে পারেননি। চাইতেন তাঁর মেয়েরা খেলাধুলো করুক। জামশেদপুরের টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ছোট মেয়েকে টেনিসে ভর্তি করে দেন। একদিন মেয়েকে নিয়ে স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যাওয়ার পথে দলমা ট্রেকিং-এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সেটা দেখে কিছু করার যে বাসনা তাঁর মনের মধ্যে সুপ্ত ছিল সেটা জেগে ওঠে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে আবেদনপত্র জমা দেন।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় দলের বিধায়কদের ১০০ শতাংশ উপস্থিতিতে জোর তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে
পাঁচশ জন প্রতিযোগী দলমা ট্রেকিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হন তিনি। সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে দেখা হয় প্রথম ভারতীয় মহিলা এভারেস্ট শৃঙ্গজয়ী বাচেন্দ্রী পালের সঙ্গে। অফিসের দেওয়ালে বাচেন্দ্রী পালের এভারেস্ট জয়ের ছবি দেখে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। স্থির করেন মেয়েদের পর্বতারোহণের কোর্স করাবেন। বাচেন্দ্রী পালকে সে কথা বলেন তিনি। তাঁকে অবাক করে দিয়ে বাচেন্দ্রী পাল বলেন, ‘মেয়েরা কেন? আপনি কেন নন?’ একথা শুনে চমকে ওঠেন প্রেমলতা। বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। দুই সন্তানের মা তিনি। তাঁর পক্ষে পর্বতারোহণ সম্ভব? বাচেন্দ্রী তাঁকে বলেন, একদমই অসম্ভব নয়। তিনি তাঁকে উৎসাহিত করেন।
বাচেন্দ্রী পালের ওই ছোট্ট কথা নাড়িয়ে দেয় প্রেমলতাকে। তাঁর জীবন নিয়ে ভাবনাকে একেবারে উল্টো খাতে বইয়ে দেয়। প্রেমলতা খুব উৎসাহী হয়ে পড়েন। বাড়ির লোকের সমর্থন আদায় করেন। নেহরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে মেয়ের সঙ্গে একুশ দিনের ট্রেনিং কোর্স করেন। তাঁর শারীরিক ফিটনেস দেখে বচেন্দ্রী পাল তাঁকে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করার উপদেশ দেন। দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে আঠাশ দিনের বেসিক কোর্সে ভর্তি হন তিনি।
আরও পড়ুন-পার্ক সার্কাস: মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন আত্মঘাতী কনস্টেবল, জানালেন পুলিশ কমিশনারের
তিনি পর্বতারোহণের জন্য ট্রেনিং করছেন, এই খবর জানার পর পরিচিত বৃত্তের মানুষেরা নেতিবাচক কথা বলতে শুরু করে। এমনকী ক্যাম্পেও তাঁকে বেশ কিছু অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। এখানকার ইনস্ট্রাকটরও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। প্রেমলতার কাছে তিনি জানতে চান তাঁর পূর্ব কোনও অভিজ্ঞতা আছে কি না। তিনি দলমা ট্রেকিংয়ের কথা বললে ইনস্ট্রাকটর কিছুটা পরিহাসের ছলে জানান, দলমা ট্রেকিং আর পর্বতারোহণের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। তিনি তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। এমনকী ফিরে যাওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু প্রেমলতা ছিলেন মরিয়া। পাছে ইনস্ট্রাক্টর তাঁকে বাদ না দিয়ে দেন সেজন্য তিনি যে বিবাহিত, দুই মেয়ের মা এই ব্যাপারটা প্রকাশ করেন না। ইনস্ট্রাক্টরের নেতিবাচক কথাবার্তা তাঁর জেদকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ট্রেনিংয়ে নিজেকে নিংড়ে দেন তিনি। ক্যাম্পে পঞ্চাশ জনের মধ্যে মাত্র বাইশ জন ট্রেনিং সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। প্রেমলতা কেবল সফলভাবে ট্রেনিং শেষ করেননি, বেস্ট ট্রেনির পুরস্কার পান।
আরও পড়ুন-হাসপাতাল থেকে ছেলের দেহ পেতে ভিক্ষা দম্পতির, বিজেপি জোট শাসিত বিহারে
বাধা যে কেবল বাইরে ছিল এমনটা নয়। প্রথম প্রথম পরিবারের দিক থেকেও একটু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। একেবারে শুরুর দিকে বাড়ির লোক সেভাবে রাজি ছিলেন না। একে বয়স হয়েছে, তার ওপর দুই সন্তান। কিন্তু তিনি পরিবারের লোকেদের বোঝান। তাঁর গভীর আগ্রহ দেখে বাড়ির লোকেরা আর অমত করেননি। তবে বাড়ির বউ ট্র্যাকসুট পরে অনুশীলন করছে, এটা নিয়ে আশেপাশের মহিলারা শাশুড়িকে কথা শোনাত। শাশুড়ির খারাপ লাগত। মন থেকে তিনি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতেন না। ধীরে ধীরে সেই অবস্থা স্বাভাবিক হয়। তবে এগিয়ে যাওয়ার পথে স্বামী আর শ্বশুরের পুরোপুরি সমর্থন ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সবসময়।
যাই হোক, দীর্ঘ দুই দশকের বেশি নিপাট গৃহবধূর জীবন কাটানো প্রেমলতার জীবনের শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। ২০০৪ সালে তিনি নেপালের আইল্যান্ড পিক অভিযান করেন। ২০০৬ সালে কারাকোরাম পাস আর মাউন্ট সালতেরো কাংরি অভিযান করেন। ২০০৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী মহিলাদের জন্য মরুভূমি অভিযানের আয়োজন করেন। চল্লিশ দিনের এই ক্যামেল ডেজার্ট এক্সপিডিশন-এ অংশ নেন প্রেমলতা। দু হাজার কিলোমিটারের এই অভিযান শুরু হয়েছিল গুজরাতের ভুজ থেকে ওয়াঘা বর্ডার পর্যন্ত। এই অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করে লিমকা বুক অব রেকর্ড-এ নিজের নাম নথিভুক্ত করে নেন প্রেমলতা।
আরও পড়ুন-‘উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন’: মুখ্যমন্ত্রী
২০০৮ সালে তিনি আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারো জয় করেন বাচেন্দ্রী পালের নেতৃত্বে। সেখান থেকে অবতরণের সময় বাচেন্দ্রী পাল তাঁকে এভারেস্ট অভিযানের কথা বলেন। তাঁকে বোঝান এভারেস্ট জয় করার সমস্ত দক্ষতা তাঁর মধ্যে আছে। এর আগে এভারেস্ট অভিযানের কথা ভাবেননি প্রেমলতা। বাচেন্দ্রী পালের কথায় তিনি শিহরিত হয়ে ওঠেন। এভারেস্ট জয় করার বাসনা তাঁকে তাড়িত করে ঠিকই কিন্তু সহসা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বড় মেয়ে প্রিয়াংকার বিয়ের ভাবনা, ছোট মেয়ে রাজ্যশ্রীর এমবিএ পড়া, এইসব কারণে এভারেস্ট অভিযানের ভাবনা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়। ২০১০ সালে বাচেন্দ্রী পাল যখন আবারও তাঁকে এভারেস্ট জয়ের কথা বলেন তখন তিনি আর না করতে পারেননি। ইতিমধ্যে প্রিয়াংকার বিয়েও হয়ে গেছে। প্রেমলতা এভারেস্ট অভিযানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।
বেশ ভয়ে ভয়ে তিনি বাড়িতে জানান তাঁর পরিকল্পনার কথা। শ্বাশুড়ি প্রথমটা রাজি হননি। তখন প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স প্রেমলতার। নিজেও শ্বাশুড়ি হয়ে গেছেন। প্রেমলতার শ্বাশুড়ির বক্তব্য ছিল, অনেক পাহাড় চড়া হয়ে গেছে। এবার ঘর সামলাও। প্রেমলতার স্বামী আর শ্বশুর কিন্তু তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। শ্বশুরমশাই বাচেন্দ্রী পালকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বলেন, ‘বাচেন্দ্রী পাল যখন বলেছেন তখন না করা উচিত নয়।’ স্বামীও তাঁকে সাহস জুগিয়ে বলেন, ঘর-সংসারের কথা ভুলে এভারেস্ট নিয়ে ভাবতে।
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিকের ফলে জেলার জয়জয়কার, ৪৯৮ পেয়ে প্রথম দিনহাটার অদিশা
এভারেস্ট অভিযান ব্যাপারটা সহজ নয় মোটেই। তাঁর পক্ষে ছিল আরও কঠিন। ইতিমধ্যে শরীরে বাসা বেঁধেছে আর্থারাইটিস। সঙ্গে কোমরের যন্ত্রণা। এসব অগ্রাহ্য করে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
২০১১ সালের ২৫ মার্চ ইকো-এভারেস্ট অভিযানে সুযোগ পান তিনি। দলে ছিলেন বাইশ জন সদস্য। এঁদের মধ্যে আটজন ভারতীয়, সাতজন আমেরিকান, তিনজন ব্রাজিলীয় ছাড়া জাপান, স্পেন, মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ডের একজন করে প্রতিনিধি। ৪৭ বছর বয়সে তিনি এভারেস্ট অভিযান করতে এসেছেন জেনে প্রথমটা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রেমলতার মেয়ে তাঁকে ছাড়তে এসেছিল। গাইড তাঁকেই অভিযাত্রী বলে ভেবেছিলেন। প্রেমলতা ভুলটা ভেঙে দেওয়ার পর তিনি শুধু অবাকই হননি প্রেমলতাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করেন অভিযান থেকে সরে যাওয়ার জন্য। এই বয়সে কোনও ভারতীয় মহিলার পক্ষে এভারেস্ট অভিযান পুরোপুরি অসম্ভব মনে হয়েছিল তাঁর। শুধু তাই নয়, পুরো অভিযানে যেখানে গাইডের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ একটা বড় প্রেরণার কাজ করে, বাড়তি মনোবল জোগায়, সেখান তিনি বারে বারে উল্টোটাই করেছেন। কিন্তু এসব দমাতে পারেনি প্রেমলতাকে।
আরও পড়ুন-‘উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন’: মুখ্যমন্ত্রী
যাই হোক, অভিযান শুরু হয়। তেইশ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প থ্রিতে পৌঁছনোর পর আবহাওয়া মারাত্মক খারাপ হয়ে পড়ে। নীচের ক্যাম্পে নেমে আসতে হয়। ডিহাইড্রেশনও হয়ে যায় তাঁর। সবমিলিয়ে একেবারে খারাপ অবস্থা। শেরপা তাঁকে পরামর্শ দেন ফিরে যাওয়ার জন্য। একসময় তিনিও মনে মনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ফেরার আগে স্যাটেলাইট ফোনে বাড়িতে যোগাযোগ করেন। আবহাওয়া বিপর্যয়ে তাঁদের আটকে পড়ার খবর ইতিমধ্যে খবরের মাধ্যমে সবাই জেনে গিয়েছিল। স্বামী, ভাই তাঁর ফিরে আসার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেও তাঁদের মন চাইছিল না। ‘যদি কোনওভাবে সম্ভব হয়…’ এমন অভিব্যক্তি ছিল তাঁদের। কিন্তু বড় মেয়ে তাঁকে ফেরার কথা মন থেকে মুছে দিতে বলে। উৎসাহ দিয়ে বলে, তিনি পারবেন। আর তাঁর বাবা ফিরে আসার সিদ্ধান্তকে একদমই মানতেই পারেন না। বলে দেন, ‘ফিরবে কেন? মরতে হয় তো কিছু করে মরো।’ প্রেমলতা বুঝতে পারেন, কেউ চান না তিনি হার মেনে নিক। সেটাই তাঁকে আবার চাঙ্গা করে তোলে। সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন তিনি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রী তার মডেল, তাঁরই লেখা গান গায় দেবাঙ্কিতা
সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতায় ওঠার পর আবারও সমস্যায় পড়েন তিনি। তাঁর অক্সিজেন মাস্কে বরফ জমে যাচ্ছিল। সেটা ঠিক করতে গিয়ে ভুলবশত এক হাতের গ্লাভস খুলে ফেলেন। আর ঝড়ে গ্লাভস উড়ে যায়। এমন ঠান্ডায় হাতের গ্লাভস খুলে ফেলা বোকামি। গ্লাভস ছাড়া এগোনো মানে জেনেশুনে মৃত্যুকে ডেকে আনা। শেরপা তাঁকে বলেন ফিরে যেতে। এত কাছে এসে ফিরে যাবেন? মন কিছুতেই চাইছিল না। ঈশ্বরেরও বোধহয় সেরকম ইচ্ছে ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেমলতা সেখানে কারও ফেলে যাওয়া একজোড়া গ্লাভস দেখতে পান। সেটা পরে আবারও অভিযান শুরু করেন তিনি। অবশেষে ২০ মে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে এভারেস্টের চুড়োয় পা রাখেন। তৈরি করেন এক নতুন নজির। কোনও ভারতীয় মহিলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বয়সে এভারেস্ট জয় করেন তিনি। যদিও পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে জম্মু-কাশ্মীরের মেয়ে সঙ্গীতা সিন্ধি ভাল তিপান্ন বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করে প্রেমলতার রেকর্ড ভেঙে দেন। যা-ই হোক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঝাড়খণ্ডের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব প্রেমলতার।
এভারেস্ট জয় প্রেমলতার মনে পর্বতারোহণের নেশা বাড়িয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নেন সাত মহাদেশের সাত সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করবেন। ইতিমধ্যে কিলিমাঞ্জারো জয় হয়ে গেছে। এভারেস্ট জয় করার পর যান উত্তর আমেরিকার মাউন্ট মিকেনলে শৃঙ্গ জয় করতে। এটি ডেনালি নামে পরিচিত। তুলনামূলকভাবে এটি কম উচ্চতার। এভারেস্ট জয় করার পর মনে আত্মবিশ্বাস একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। কাজটা খুব সহজ ভেবেছিলেন কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা ছিল না। এখানে সমস্ত কাজ নিজে করতে হয়। কোনও কুলি পাওয়া যায় না। প্রায় ষাট কেজি ওজনের বোঝা নিজেকে বইতে হয়। কিছুটা শ্লেজ গাড়িতে, বাকিটা পিঠে। ডেনালি অভিযানকালে আবহাওয়া এতটাই খারাপ হয় যে এক হাজার ফুট বাকি থাকতে তাঁকে ফিরে আসতে হয়।
আরও পড়ুন-জীবন খাতার প্রতি পাতায়, এক অন্য কাহিনি
এরপর তিনি চার মহাদেশের চারটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করেন। ২০১২-এর ১০ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আমেরিকার আঙ্কারাগুয়া। ওই বছরের ১২ অগাস্ট ইউরোপের মাউন্ট এলব্রুশ। পরের বছরের ৫ জানুয়ারি আন্টার্টিকার মাউন্ট ভিনসন। ২০১২-এর ২২ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার পুনকাকজায়া জয় করেন। এটি কার্স্টেন পিরামিড নামেও খ্যাত। এই অভিযানে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। এর পথ ছিল খুব বিপদসংকুল। এখানে যত্রতত্র আদিম মানুসের বাস। যখন তিনি নেমে আসছিলেন তখন রেনফরেস্টের পাশ দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল। একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল। টানা ৬ দিন হাঁটার পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন প্রেমলতা। শরীর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এই সময় একটি বড় পাথর এসে পড়ে পায়ে। সঙ্গে থাকা ওষুধপত্রে কাজ হয় না। দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। হেলিকপ্টার কিংবা অন্য কোনও মাধ্যমে তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। পাঁচ-ছ দিন ওই ভাঙা পা নিয়ে হেঁটে, কখনও শরীর টেনে টেনে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছোন। ২০১৩-এর ১৩ মে দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টায় ডেনালি জয় করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি এমন অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করেন।
আরও পড়ুন-বাঙ্ক থেকে ছিটকে পড়ল লাগেজ, অন্ডালের বদলে বিমান নামল দমদমে, এয়ার টার্বুল্যান্সে জখম যাত্রী
অসামান্য কৃতিত্বের জন্য বেশকিছু সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২০১৩ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে তেনজিং নোরগে ন্যাশন্যাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড।
পর্বতারোহণের ব্যাপার সবসময়ই বেশ বিপজ্জনক। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। যে সমাজে মেয়েদের দুর্বল মনে করা হয়, সেখানে প্রেমলতা পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বাচেন্দ্রী পালের একটি কথা তাঁর জীবন নিয়ে ভাবনাকে একেবারে বদলে দিয়েছিল ঠিকই, তবে প্রেমলতার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে নিজের জেদ, হার না মানা মানসিকতা, অদম্য মনোবল আর অসম্ভবকে সম্ভব করার দুর্বার প্রয়াস। জীবনের একটা দীর্ঘ অধ্যায় যে মহিলা সাধারণ গৃহবধূর জীবন কাটিয়েছেন স্বামী-সন্তান আর সংসারের পরিমণ্ডলে, সেই মহিলাই বদ্ধ ঘরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে অসাধ্যসাধন করেছেন। সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীরাও কোনও অংশে কম নয়।
বিখ্যাত লেখক আইবর বলেছিলেন, “Age is just a number. It carries no weight.” সেই কথাকে সত্যি প্রমাণ করেছেন প্রেমলতা। সেই সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন সাফল্যের খিদে, কিছু করার মানসিকতা আর তা পূরণের জন্য সৎ প্রচেষ্টা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসাধ্যসাধন করা যায়।