কেমন আছেন?
এখন আমার বয়স ৮২। শরীর খুব একটা সঙ্গ দিচ্ছে না। মনের জোরে কাজ করছি। এদিক-ওদিক যাচ্ছি। অবশ্য বাড়ির কেউ না কেউ সঙ্গে থাকেন। এই মুহূর্তে পুজোর লেখার ব্যস্ততা রয়েছে। উপন্যাস, গল্প। কিছু লেখা দিয়েছি, কিছু বাকি। সঙ্গে ধারাবাহিক লেখা।
আরও পড়ুন-নতুন বই
লেখালেখির জগতে এলেন কখন?
ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বই আমার হাতে এসেছিল। নাম ‘রামধনু’। ছোটদের জন্য লেখা অসাধারণ সব গল্প। পড়তে পড়তে মোহিত হয়ে যেতাম। তারপর পড়লাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। এইভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হল বই পড়ার নেশা। পাশাপাশি আমরা প্রচুর বেড়াতাম। বাবা-মা ছিলেন ভ্রমণ রসিক। দেশের বহু জায়গা তাঁদের সঙ্গে ঘুরেছি। ১৫ বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছিলাম কামাখ্যা। তখন কামাখ্যা বনময়। তার মধ্যেই আমি আপনমনে ঘুরে বেড়াতাম। ফিরে আসার দিন মনটা খুব খারাপ। বিকেলের দিকে পান্ডাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি, দূরে পাহাড় একেবারে লালে লাল। তখন মাঘের শেষ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। চারদিক শিমুলে-পলাশে ছেয়ে আছে। দেখতে দেখতে ভাবলাম, আমি যদি সাহিত্যিকদের মতো লিখতে পারতাম, কী যে ভাল হত। হঠাৎ মনের মধ্যে জন্ম নিল একটি বাক্য : ‘কে যেন রঙের আবির ছড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ের গায়ে’। তবে লেখা হল না কিছুই। ফিরে এলাম বাড়িতে। কয়েকদিন পর দৈনিক বসুমতীর পাতায় দেখলাম একটি বিজ্ঞাপন। ছোটদের পাতা ডাকঘর বিভাগের জন্য ছোটদের লেখা আহ্বান করা হয়েছে। পরিচালক বিশু মুখোপাধ্যায়। যাদের লেখা পছন্দ হবে, তাদের লেখা ছাপা হবে। এই বিজ্ঞাপন আমার মনের মধ্যে লেখার বীজ ঢুকিয়ে দিল। বাড়িতে এসে লিখে ফেললাম দুই পাতার ‘কামাখ্যা ভ্রমণ’। তারপর চটপট পোস্ট করে দিলাম। কিছুদিন পর ওই সংবাদপত্রে দেখলাম মনোনীতদের নামের তালিকা ছাপা হয়েছে। মিরাকেল ব্যাপার হল, তালিকার প্রথমেই আমার নাম। আনন্দের সীমা রইল না। কিছুদিন পর ছাপা হল লেখাটি। আমার প্রথম মুদ্রিত লেখা। সেই শুরু। কত বছর আগের কথা!
আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র
তারপর?
লেখার সুযোগ পেলাম দৈনিক বসুমতী পুজো সংখ্যায়। এইভাবে চলতে থাকল বছর বছর। লেখা ছাপা হলে দফতর থেকে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। একদিন চলে গেলাম মিত্র ও ঘোষ প্রকাশন সংস্থার দফতরে। আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোকের জন্য জলধর সেনের একটি বই কেনার জন্য। সেখানে আলাপ হল গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষের সঙ্গে। শারদীয়া দৈনিক বসুমতীতে আমার লেখা পড়ে তাঁরা খুব খুশি হলেন। প্রশংসা করলেন। লেখার সুযোগ দিলেন জনসেবক পত্রিকার ছোটদের বিভাগ সপ্তডিঙায়। ছাপা হতে থাকল একটার পর একটা লেখা। একদিনে আমার তিন-চারটে লেখাও বেরিয়েছে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল পরিচিতি। তারপর আনন্দবাজার পত্রিকায় পাঠালাম ‘মহাকবি অশ্বঘোষ’ শীর্ষক একটি লেখা। তখন আমরা থাকি হাওড়া শহরে। কিছুদিন পর আমাদের বাড়িতে হাজির ড. নিমাইসাধন বসু। জানতে চাইলেন আমি আনন্দবাজারে কোনও লেখা পাঠিয়েছি কি না। বললাম, ‘‘হ্যাঁ, পাঠিয়েছি।” উনি বললেন, ‘‘আজ বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। আগামিকাল তোমার লেখাটা প্রকাশিত হবে।” পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল লেখাটি।
আরও পড়ুন-এবার হয়তো হার্দিকের পালা, তোপ শাস্ত্রীর
‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র জন্ম হল কীভাবে?
একটা সময় লেগে গেল চিন-ভারত যুদ্ধ। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সংবাদপত্রে লেখা। তখন গেলাম দেব সাহিত্য কুটীরে। পেলাম শুকতারায় লেখার সুযোগ। বিভিন্ন ধরনের লেখা। সঙ্গে ভূতের গল্প। একদিন সম্পাদক ক্ষীরোদচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। কথায় কথায় তাঁকে বললাম আমার কুকুর পঞ্চুর কথা। তিনি সব শুনে বললেন, ‘‘আপনাকে ছোটদের জন্য অ্যাডভেঞ্চার লিখতে হবে।” প্রথমে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। ভাবছিলাম পারব কি না। ক্ষীরোদচন্দ্রবাবু আমাকে সাহস দিলেন, উৎসাহিত করলেন। তাঁর পরামর্শ মেনেই পঞ্চুকে সামনে রেখে অ্যাডভেঞ্চার লেখা শুরু করলাম। সেটাই ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’। যা এখনও চলছে। আজও স্বীকার করি, ক্ষীরোদচন্দ্র মজুমদার উৎসাহ না দিলে ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র জন্ম হত না। এই লেখা আমাকে দিয়েছে অগণিত পাঠকের ভালবাসা। ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ শুকতারার পরে ছাপা হয়েছে আনন্দমেলা ও বর্তমানে। বেরিয়েছে সমগ্র।
আরও পড়ুন-ফের চিঠি মোহনবাগানের
কোন কোন সাহিত্যিকের স্নেহ পেয়েছেন?
কুড়ি বছর বয়সে আমি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করি। আমি তাঁর বীরভূমের লাভপুরের বাড়িতেও গেছি। পেয়েছি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের পরম স্নেহ। বলা যায়, একটা সময় আমি তারাশঙ্করের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলাম। আমার লেখা পড়ে উনি আশীর্বাদ করেছিলেন। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। এছাড়াও পেয়েছি সাহিত্যিক অবধূত, বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের স্নেহ। নিয়মিত তাঁদের বাড়ি যেতাম। আর একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি কবি সুনীল বসু। তাঁর উৎসাহেই আমি ভ্রমণ কাহিনি লেখা শুরু করি। তিনি আমাকে সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি যাই। তারপর থেকেই দেশ পত্রিকায় আমার ভ্রমণ কাহিনি ছাপা হতে থাকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, ভ্রমণ কাহিনি লিখেছি। সারা জীবনে লিখেছি বহু বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায়। আমার বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। পেয়েছি অনেক পুরস্কার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য অকাদেমি প্রদত্ত বাল সাহিত্য পুরস্কার। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাঠকের ভালবাসা। বিভিন্ন ধরনের লেখালিখি করলেও, পাঠকদের কাছে আমার পরিচয় মূলত ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র লেখক হিসেবেই। বিষয়টা আমাকে আনন্দ দেয়।
আরও পড়ুন-নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে গণধর্ষণ, গ্রেফতার চার রেলকর্মী
এখনকার সাহিত্যিকদের লেখা কেমন লাগছে?
নতুন প্রজন্মের অনেকেই লিখছেন। আমি নিয়মিত তাঁদের লেখা পড়ি। আমার তো বেশ ভালই লাগে। এখনকার সাহিত্য নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। প্রচুর পত্র-পত্রিকা বেরোচ্ছে, বই বেরোচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, ‘‘এখন বই পড়ার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে।” তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। এখনও প্রচুর মানুষ বই পড়েন। সেই কারণেই বছর বছর নতুন বই প্রকাশিত হয়। কলকাতায় এবং জেলায় জেলায় জমে ওঠে সরকারি ও বেসরকারি বইমেলা। আশা করি আগামী দিনে বইয়ের চাহিদা আরও বাড়বে।