পার্থসারথি গোস্বামী : দুর্গাপুজা আসা মানেই হারাধনবাবু পড়েন উভয়সংকটে। এমনিতে সারা বছর কোনও মান নেই, প্রায় গোটা বছর ধরেই গৃহিণী-কর্তৃক গদাইলশকর চাল, শালগ্রাম শিলা, অকর্মার ঢেঁকি প্রভৃতি উপনাম পেতে পেতে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামটি প্রায় ভোলারই শামিল। নিজের নামেরও তেমন একটা গরিমা নেই, নামটি নিয়েও যে টানাহ্যাঁচড়া হয় না এমনটাও না, গৃহিণী নাম নিয়েও মাঝেমাঝেই বলে থাকেন— আমাকে তো হারিয়ে যাওয়া মাল গছিয়ে দিয়েছে তোমার মা-বাপ, সে মালে আবার এত টান কীসের, আমি না হয় আমার মতো করেই তার সৎকার করি। আর কী যে ধন সে তো এত বছর ধরে আমিই বুঝলাম, ধন না ছাই অচল পয়সা আমি বলেই চালালাম।
আরও পড়ুন-ডিপ্রেশন
এ-হেন হারাধনবাবু খানিকটা মর্যাদা পান দুর্গাপুজার মাস দুই আগের থেকে পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত।
এখন তো পুজো কবে মনে রাখার দরকার পড়ে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় মাস ছয় আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ‘মা আসছেন’ মা যেন কেউকেটা কোনও ফিল্মস্টার, জলসা করতে আসবেন, তার প্রচার। তবে ওই মা আসছেন শব্দটা চোখে এলেই বুক ধড়ফড় করতে থাকে, আবার মাঝে মাঝে মন হয়ে ওঠে প্রফুল্ল, যেন এই রোদ তো এই মেঘছায়া। ধড়ফড়ানির কারণ হল গুচ্ছের খরচ, বউয়ের না হয় বাদই দিলেন, শ্বশুরের পাম্পশু, শাশুড়ির শান্তিপুরী, বড় শালার শেরওয়ানি, মেজ শালার ব্র্যান্ডেড স্ট্রেচবল জিনস, ছোট শালার স্মার্ট ওয়াচ, আবার শালা ত্রয়ীর গৃহিণীদের একখান করে শাড়ি, অবিবাহিত দুই শালির জন্য সালোয়ার স্যুট। যেন সারা শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত-মাংস খুবলে নেওয়ার মতো ব্যাপার। আর এত সবের বদলে, ফি-বছর একসেট জ্যালজেলে পাতলুন-পাঞ্জাবি। একবার বমকে গিয়ে স্ত্রী মাধবীলতাকে বলেই দিয়েছিলেন— আমাকে দেউলিয়া করে দিয়ে প্রতি বছর আমার বেলায় ওই থার্ডক্লাস পাজামা পাঞ্জাবি, বলি তোমার বাপের বাড়ির লোকদের কি শরীরে চামড়া বলে কিছু নেই?
আরও পড়ুন-রেড রোডে বিদায় বেলায় আনন্দের সুর
—চক্ষুলজ্জা তো তোমার নেই দেখছি, পেনশন হোল্ডার বুড়ো শ্বশুর, এর বেশি আশা করো কী করে, যা পাচ্ছো ওটাই ভাল মনে আশীর্বাদস্বরূপ গ্রহণ করতে হয়, ওতে বিলাসিতা না থাক ভালবাসা আছে।
হারাধনবাবু ভাবলেন বলবেন, তা হলে তার দেওয়া ভালবাসার মাল এত পরখ করে কেনা হয় কেন, ভালবেসে একটা করে গামছাও তো দেওয়া যায়, কিছু না হোক বুকের ভারটা তো লাঘব হবে। সে না বলে বললেন— তোমার বাবার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, তিন তিনটে চাকরি করা ভাই আছে, তাদেরই বা কেমন আক্কেল।
—এ মা! জয়েন্ট ফ্যামিলি, মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো বাবা আছেন, তাঁকে ডিঙিয়ে তোমাকে শালারা দিলে তাঁর মান যাবে সে-হুঁশটা তোমার আছে? এই বয়সে লোকটাকে মর্মাহত করবে, তেমন আহাম্মক আমার ভাইয়েরা নয়।
আরও পড়ুন-ভূস্বর্গে যাবেন না: মার্কিনিদের পরামর্শ বাইডেন প্রশাসনের
হারাধনবাবু মনে মনে ভাবলেন ওটাই যদি কারণ এত ঝড় আসে বটবৃক্ষ উৎপাটিত হলেই তো হয়, অন্তত দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা একটু ব্যালেন্স হত। পরক্ষণেই ভাবলেন ছিঃ, নশ্বর ক’টা বস্তুর কারণে পাপ ভাবনা মনে স্থান না দেওয়াই শ্রেয়।
তবে বাজারের খরচায় বাপের নাম ভুলে গেলেও, এই সময়টা অন্তত একটু মান পাওয়া যায়। পিতৃগৃহে ওইরূপ ভেট পাঠাতে হলে মাধবীলতার এই হারানো ধন অচল পয়সাই ভরসা, তাই এই সময়টা তাকে চটাতে চান না মাধবীলতা, বরং উল্টে একটু তোয়াজ করেন। অফিস থেকে ফেরা মাত্রই সিরিয়াল ছেড়ে উঠে লেবু চা বানিয়ে দেওয়া, বারবার শরীরের খোঁজ নেওয়া, অফিসের ভাতে সেই চিরাচরিত ছ্যাঁকাপোড়া মাছভাজার বদলে কাতলার কালিয়া— এ-সব টানা চলতে থাকে এই সময়টায়। হারাধনবাবুও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকেন ব্যাপারটাকে, হুড়হুড় করে টাকা বেরোলে বুকটা খালি খালি লাগে না এমনটাও নয়, তখন মনে মনে অমৃতবাণী আউড়াতে থাকেন, ‘টাকা মাটি-মাটি টাকা’।
আরও পড়ুন-বাসে আগুন, মৃত ১২
ক’দিন আগেই সবার সব বাজার কমপ্লিট আজ বাদে কাল মাধবীলতা সবাইকে নিয়ে মায়ের বাড়ি যাবেন, যদিও তিনি হারাধনবাবুকে একা কৈলাসে না রেখে বগলদাবা করে সঙ্গেই নিয়ে যান। আর শ্বশুরবাড়ি যেতে নেহাত মন্দ লাগে না তাঁর। আর কিছু না হোক, পুজো ক’দিন তিনবেলা একটু উন্নতমানের জলযোগ জোটে কপালে, তা ছাড়া বাপের বাড়ি গেলে মাধবীলতার ঝাঁজও কমে যায় বেশ খানিকটা। সবার সামনে মাধবীর যেন পতিই পরম গুরু। পুজো ক’দিন এই সত্যিকারের পুরুষসিংহের রোলে অভিনয় করতে বেশ ভালই লাগে।
ষষ্ঠীর প্রত্যুষেই মাধবীলতা পিতৃগৃহে গমন করবেন, তার আগের দিন রাত্রে সব কেনাকাটা একপ্রস্থ মিলিয়ে নিতে বসলেন, ভাল করে দেখে নিতে হবে কোনওকিছু বাদ পড়লো কিনা। সব মালপত্র মেঝেতে নামিয়ে লিস্ট ধরে মেলাতে মেলাতে বারবার খুতখুঁত করতে থাকলেন মাধবীলতা, বড়দার শেরওয়ানিটা তাঁর মোটেই পছন্দ হয়নি, বললেন— কত করে বললাম বড়দাকে এ-বছর একটা সাফারিস্যুট দেব, এমন কিপটে মানুষ তিন হাজারের বেশি কোনও মতেই বের করল না, ওই দিয়ে আর কী হবে এই শেরওয়ানি ছাড়া!
আরও পড়ুন-১০ জন মানুষ মেরেছিল, শেষে গুলিতে মরল বাঘ
হারাধনবাবু কাছেই ছিলেন, বলে উঠলেন— তিন হাজার টাকাটা কম, টাকা কি গাছে ধরে নাকি! পছন্দ না হলে বল ফেরত দিয়ে আসছি।
মাধবীলতা খানিকটা সংযত হয়েই বললেন— না গো, খারাপ না, আসলে গতবছর বড়দাকে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা রদ্দিমার্কা সাফারি দিয়েছে, তাতেই দেমাকে বৌদির বৌদির পা পড়ে না, ভেবেছিলাম একটা ব্র্যান্ডেড সাফারি-স্যুট দিয়ে দেখিয়ে দেব সাফারি কাকে বলে।
—তাহলে শুধু বড়দা কেন গুষ্টিশুদ্ধ সবার জন্যই একটা করে কিনে নিতে পারতে।
—পারলে তাই নিতাম। উঁ, সব্বাইকে সাফারি পরাবে, বলি সে মুরোদ আছে তোমার!
—নেই কেন, বিয়েতে সোনার যে চূড়-জোড়া দিয়েছে, সেগুলো বিক্রি করে দিলেই হত।
সেদিন আর কেউ কোনও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। হারাধনবাবু দেখলেন সকাল সকাল বেরোতে না পারলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড়ও বাড়বে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াই ভাল।
আরও পড়ুন-রোনাল্ডোকে ধৈর্য ধরতে হবে : রুনি
সপ্তমীর দুপুর, মায়ের আরতি শুরু হবে, মাধবীলতার বাপের বাড়ির নিজেদের পুজো। খোঁজ শুরু হয়ে গেল জামাইয়ের, তিনি তখন ঘরের ভেতরে ড্রেস চেঞ্জ করছেন। ষষ্ঠীর দিন আসামাত্রই যেন মেঘ না চাইতে জল, হঠাৎ করেই বড় শালাবাবু এসে একখান জিনসের প্যান্ট দিয়ে বলল— জামাইবাবু, দেখুন তো এটা আপনার পছন্দ হয় কিনা। আসলে অন লাইনে অর্ডার করেছিলাম, আসার পর দেখি এটা লুজ ফিট, আমি একেবারে স্লিম ফিট ছাড়া পরি না, দেখুন আপনার পছন্দ হলে রেখে দিন, নইলে রিটার্ন করব।
ছোঁ মেরে প্যান্টটা শালার হাত থেকে নিয়ে হারাধনবাবু বললেন— বাহ্ বেশ সুন্দর তো, দিব্যি হবে।
ভাবলেন এই সুযোগে যা উশুল হয় সেটাই লাভ, কোমরে একটু না হয় বড় হবে, শালার কোমর ৩৬ আর নিজের ৩২, এ আর এমন কী। ডেনিম কালার, সঙ্গে আবার একটা বেল্টও আছে।
আরও পড়ুন-১০ লক্ষ ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য ফাঁস হয়েছে, জানাল মেটা
সেই প্যান্ট পরতে গিয়েই শুরু হল বেশ বিড়ম্বনা, এক্সট্রা চার ইঞ্চি ম্যানেজ করা চাট্টিখানি ব্যাপার না, তা ছাড়া ওই ফ্রি বেল্টে যে ফুটোগুলো তাতে কোমরের মাপ ম্যাচ করছে না, শেষে একটা কাঁচি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সঠিক জায়গায় মস্ত একটা ফুটো করে তাড়াতাড়ি করে ড্রেস করে মণ্ডপের উদ্দশ্যে পা বাড়ালেন।
মাধবীলতা না দিক, শ্বশুরবাড়িতে হারাধনবাবু বিরাট পাত্তা পেয়ে থাকেন, নাটক থেকে আবৃত্তি, গান এমন কিছু নেই যা তিনি পারেন না, সেই কারণেই পুজো চারদিনের সব স্পটলাইট যেন তাঁরই ওপর ফোকাস করা থাকে, সবাই মুহূর্তে মুহূর্তে চোখে হারায় তাঁকে, পুরো ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করেন তিনি, একেবারে যেন স্বপ্নসম।
আরও পড়ুন-হার্দিকের মতো ক্রিকেটার বহু বছরে একবারই আসে, প্রশংসা পোলার্ডের
মাধবীলতার বাপের বাড়ির পুজোর সপ্তমীর দুপুরের ট্র্যাডিশন হল মায়ের আরতির সময় ধুনো নাচ, আর এই নাচে হারাধনবাবু একেবারে ওস্তাদ। মণ্ডপে আসতেই সব পাড়াতুতো শালা-শালিরা তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়ে দু হাতে ধরিয়ে দিল দুই ধুনুচি, প্রথমে একটু কপট অনিচ্ছা দেখিয়ে তারপর শুরু করলেন তাঁর বিখ্যাত ধুনুচিনৃত্য। মুহূর্তেই সবাই গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল, ঢাকিও নতুন উদ্যমে শুরু করল বাজনা, হারাধনবাবুর তখন সে এক অন্য রূপ, মাথার ওপর অদ্ভুত কায়দায় চক্রাকারে ঘোরাচ্ছেন দুই ধুনুচি। হঠাৎ করেই বিপর্যয়, নাচের চাপ সহ্য করতে না পেরে, প্যান্টের সেই ফ্রি বেল্ট হঠাৎ করেই কুটুস করে দ্বিখণ্ডিত, চার ইঞ্চি বড় প্যান্ট কোমর ত্যাগ করে সোজা পায়ের গোড়ালিতে। গোল করে ঘিরে থাকা দর্শকের প্রত্যেকে দু’হাতে মুখ ঢাকলো, থেমে গেল ঢাকের বাদ্যি। দু হাতে দুই ধুনুচি ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হারাধনবাবু দেখলেন দু চোখে আগুন নিয়ে মাধবীলতা এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, হতভম্ব হয়ে তিনি কোনও মতেই মনে করতে পারছেন না, তাড়াহুড়ো করে প্যান্ট পরতে গিয়ে আন্ডারওয়ার পরেছেন কিনা, হঠাৎ করেই গোঁ-গোঁ করে জ্ঞান হারালেন তিনি। উপস্থিত সবাই পড়িমরি করে ছুটে এসে কেউ বাতাস করতে লাগলেন তো কেউ দিচ্ছেন জলের ছিটে, কিছুতেই চোখ খুলছেন না হারাধনবাবু, শুধু বিড়বিড় করে বেল্টের উদ্দেশ্যে বলে চলেছেন, বিশ্বাসঘাতক, বিশ্বাসঘাতক…
আরও পড়ুন-রান করেও ভারতীয় দলে ডাক না পেয়ে হতাশ পৃথ্বী
একটা জোর ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খুলে দেখলেন, জলের মগ হাতে সামনে দাঁড়িয়ে জলের ছিটে দিচ্ছে মাধবীলতা, হারাধনবাবু চোখ খুলতেই সে বলে উঠল— বলি সকাল সকাল কে বিশ্বাসঘাতকতা করল, নিশ্চয়ই আমার বাপ-ভাইদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে!
কিছুটা হকচকিয়ে উঠে হারাধনবাবু বললেন, আ — আ — আমি কোথায়!
—মরণ, তুমি জাহান্নামে, বলি আর স্বপ্ন না দেখে এবার ওঠো। ফার্স্ট ট্রেন মিস হলে বাপের বাড়ি পৌঁছাতে যে সেই দুপুর গড়িয়ে যাবে।