মহানায়ক উত্তমকুমার। বাংলার ম্যাটিনি আইডল। তাঁকে ঘিরে কৌতূহলের শেষ নেই। বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডায় আজও তিনি প্রাসঙ্গিক। চর্চা হয় তাঁর বিভিন্ন ছবি নিয়ে।
চলচ্চিত্র জীবন শুরু ১৯৪৭ সালে। যদিও প্রথম ছবি ‘মায়াডোর’ মুক্তি পায়নি। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দৃষ্টিদান’। ১৯৪৮ সালে। টানা ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চুটিয়ে কাজ করেছেন। অসংখ্য ছবি। ফুটিয়ে তুলেছেন নানা চরিত্র। যদিও তাঁর প্রধান পরিচয়, তিনি নায়ক।
নিজের সময়ের প্রায় সব নায়িকার সঙ্গেই কাজ করেছেন। উত্তমকুমারের নায়িকাদের নিয়ে একটি চমৎকার বই লিখেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ। শিরোনাম ‘মহানায়কের নায়িকারা’। এই গ্রন্থে তিনি জনপ্রিয় নায়িকাদের পাশাপাশি লিখেছেন এমন কয়েকজনের কথা, যাঁরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। কিশলয় প্রকাশন প্রকাশিত বইটির উপর সামান্য আলোকপাত করা যাক।
আরও পড়ুন-যুবভারতী ফের মোহনবাগানেরই, টানা আট ডার্বি জয়ের রেকর্ড
শুরুতেই রাখা যাক সুচিত্রা সেনের অংশটি। উত্তম-সুচিত্রা যেন রূপোলি পর্দার রাজা-রানি। এই জুটির সাদাকালো রোমান্স পর্দায় রচনা করেছিল আশ্চর্য মহাকাব্য। তাঁরা মোটরবাইক ছোটালে দর্শকরা হয়ে যান অনন্তপথের যাত্রী। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অসংখ্য হিট উত্তমকুমারের। ‘হারানো সুর’, ‘শাপমোচন’, ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’র নাম জানেন না, এমন বাঙালি মেলা ভার। অন্য নায়কদের সঙ্গেও চুটিয়ে কাজ করেছেন সুচিত্রা। বাংলার পাশাপাশি হিন্দিতে। পেয়েছেন সাফল্য। অভিনয় করেছেন মহানায়ক প্রযোজিত ছবিতেও। তবে পাননি সত্যজিৎ রায়ের ডাক। বিষয়গুলো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বইটিতে।
এবার সুপ্রিয়া দেবী। ১৯৫২ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘বসু পরিবার’। সুপ্রিয়ার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমারের বোনের চরিত্রে। যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁকে দেখা গেছে উত্তমকুমারের নায়িকা হিসেবে। বইটি থেকে জানা যায়, উত্তম- সুপ্রিয়া জুটির আকর্ষণের সূত্রপাত মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালিত ‘সোনার হরিণ’ ছবিতে। অজয় করের ‘শুন বরনারী’র পর থেকে এই আকর্ষণ এমন একটা জায়গায় পৌঁছয় যে, এই জুটির ছবি মানেই সুপারহিট। পরবর্তী সময়ে তাঁরা উপহার দিয়েছেন অসংখ্য হিট ছবি। পরিচালক উত্তমকুমারের ‘শুধু একটি বছর’, ‘বনপলাশির পদাবলী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’র নায়িকা ছিলেন সুপ্রিয়া। অন্য নায়কদের সঙ্গেও ছিলেন সাবলীল। বাদ পড়েনি সেই প্রসঙ্গ। এসেছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কথাও।
আরও পড়ুন-তিনে শেষ, খুশি দিমিত্রিরা
একটি অধ্যায় আছে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। উত্তমকুমারের পছন্দের এক নায়িকা। কমেডি এবং সিরিয়াস দুই ধরনের চরিত্রে অনবদ্য। ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’র পাশে ‘শেষ অঙ্ক’ রাখুন। মেলানো কঠিন। যদিও ‘শেষ অঙ্ক’ ছবিতে নায়িকা ছিলেন না। উত্তমকুমারের পাশাপাশি অন্যান্য নায়কের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন। বৈচিত্র্যময় ছিল তাঁর কেরিয়ার। এককথায়, তিনি ছিলেন হাসিকান্নার হীরাপান্না। তাঁকে ঘিরে জানা-অজানা বিষয়ের উপস্থিতি লেখাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
সুমিতা সান্যাল উত্তমকুমারের সঙ্গে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। দর্শকরা দুটি ছবি স্মরণ করতে পারেন। প্রথমটি ‘দেয়া নেয়া’। ছবিতে তিনি নায়িকা তনুজার বান্ধবী। আরেকটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘নায়ক’। সুমিতাকে দেখা গিয়েছিল একটি মাত্র দৃশ্যে। কেঁদে-হেসে মাতিয়ে তুলেছিলেন। অনেকেই জানেন না সুমিতার অভিনয় জীবন শুরু উত্তমকুমারের বিপরীতেই। ছবির নাম ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। প্রসঙ্গটি সযত্নে তুলে ধরেছেন লেখক। এ-ও জানা যায়, তখন তিনি সুমিতা নন, সুচরিতা। যদিও তাঁর প্রকৃত নাম মঞ্জুলা।
আরও পড়ুন-গিরগিটি
আলোচনায় এসেছেন অনীতা গুহ। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ছিল এই নায়িকার অবাধ বিচরণ। ‘সম্পূর্ণ রামায়ণ’ এবং ‘লব কুশ’ ছবিতে তিনিই সীতা। উত্তমকুমারের সঙ্গে একাধিক ছবিতে অভিনয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে মানু সেন তৈরি করেছিলেন ‘হারজিত’। ছবিতে উত্তমকুমারের বিপরীতে ছিলেন। দেবকীকুমার বসু পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’য় উত্তম-অনীতাকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল। মনে পড়ছে ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির কথাও। যদিও তিনি নায়িকা ছিলেন না।
‘স্ত্রী’ ছবির নায়িকা আরতি ভট্টাচার্য। একদিকে উত্তমকুমার, অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দুই মহান অভিনেতার মধ্যে পড়েও নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন আরতি। উত্তমকুমারের সঙ্গে আরও কয়েকটি ছবি। উল্লেখযোগ্য ‘আমি সে ও সখা’, ‘আনন্দমেলা’। একটি বড় অংশ রাখা হয়েছে তাঁকে ঘিরে। তিনি ছবি আঁকতেন, গল্প লিখতেন। পরিচালনা করেছেন ছবি। তাঁর বিবিধ গুণের কথা জানা যায় বইটি পড়ে।
মহানায়কের ‘নায়িকা সংবাদ’-এর নায়িকা অঞ্জনা ভৌমিক। এ ছাড়াও তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘চৌরঙ্গী’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘কখনো মেঘ’, ‘শুকসারী’, ‘রৌদ্রছায়া’ ছবিতে। ‘থানা থেকে আসছি’ ছবিতে স্ক্রিন শেয়ার করলেও ছিলেন না নায়ক-নায়িকা। উঁচু মানের এই অভিনেত্রীকে লেখক অনেকটাই জায়গা দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-মেডিসিন অ্যাডহেয়ারেন্স, সাইড এফেক্ট দূর করুন
কাগজে-কলমে উত্তমকুমারের শেষ নায়িকা সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শ্যুটিং করতে করতেই অসুস্থ হয়ে মারা যান মহানায়ক। এই জুটিকে দেখা গেছে ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘নব দিগন্ত’, ‘আরও একজন’ ছবিতেও। বইটি থেকে জানা যায়, সুমিত্রা নানা সময় উত্তম-সুচিত্রার কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। লক্ষ্য করতেন, উত্তমকুমার শ্যুটিং-এর ফাঁকে চলে যেতেন সেটের আড়ালে। আপন মনে সংলাপ বলে যেতেন। হাঁটাচলা করে সিনটা ঝালিয়ে নিতেন। একবার উত্তমকুমার তাঁকে বলেছিলেন, ‘পাঁচশোটা ছবিতে অভিনয় করলেও আজকে যে ছবিটার জন্য কাজ করছ সেটা নতুন। সিকোয়েন্সটা নতুন। তাই রিহার্সাল দিতেই হবে।’ অসাধারণ শিক্ষা। তবে উপযুক্ত তথ্যসূত্র বক্তব্যটিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারত।
আরও পড়ুন-বুমেরাং সমালোচনা, দুরবস্থা ডবল ইঞ্জিন বিজেপি রাজ্যের শিক্ষায় শীর্ষে বাংলা
বইটিতে আছে উত্তমকুমারের আরও কয়েকজন নায়িকার কথা। যেমন— মালা সিনহা, সন্ধ্যা রায়, বাসবী নন্দী, সুলতা চৌধুরি, সবিতা বসু, কণিকা মজুমদার, দীপ্তি রায়, কাবেরী বসু, সুমিত্রা দেবী, ভারতী দেবী, অনুভা গুপ্ত, সন্ধ্যারানি, ললিতা চট্টোপাধ্যায়, তনুজা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, অরুন্ধতী দেবী, মঞ্জু দে, অপর্ণা সেন। তুলে ধরা হয়েছে এঁদের জীবনের নানা দিক। এ ছাড়াও শেষের দিকে কয়েকজন নায়িকাকে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে বইটি তথ্যসমৃদ্ধ।
আরও পড়ুন-বাংলাই মডেল বলল এবার নীতি আয়োগ, নাকাশিপাড়া আইটিআইকে কেন্দ্রের স্বীকৃতি
একটি কথা, আলোচ্য নায়িকাদের সঙ্গে মহানায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল এবং সেইসঙ্গে বিশেষ কিছু ঘটনার উল্লেখ রাখা গেলে সম্ভবত বইটি আরও মনোগ্রাহী হত। খুব একটা কঠিন ছিল না। কারণ লেখক নিজে দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। অভিনয় করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গেও। অন্যান্য বিষয়কে স্থান দিতে গিয়েই হয়তো মহানায়কের অংশ খানিকটা সীমিত থেকে গেছে। এটা পাঠকের অতৃপ্তির জায়গা হতে পারে। নায়িকাক্রমেও অনুসরণ করা যেত নির্দিষ্ট কোনও পথ। কোন ভাবনায় অনীতা গুহ, সুমিতা সান্যাল, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় শুরুর দিকে আসেন, সুচিত্রা সেন প্রমুখ আসেন শেষদিকে, বোধগম্য হল না। বইটা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। কারণ রুপোলি পর্দার মহানায়ক এবং তাঁর নায়িকাদের ঘিরে আজও বাঙালির আবেগের শেষ নেই।