রবিবার সকালের আড্ডা। চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে। আড্ডাবাজ তিনজনই বঙ্গজ। তবে দু’জনের প্রথম ভাষা, অন্তত উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত, ইংরেজি ছিল। তাদেরই একজনের স্পষ্ট অভিমত, ‘পানি’ শব্দে সাম্প্রদায়িক গন্ধ আছে। এই শব্দ শুদ্ধ বাংলায় জলচল হতেই পারে না। অপর একজনের অভিমত, ‘পানি’ একান্তভাবেই বাংলাদেশি শব্দ। এপার বাংলায় কলকাত্তাইয়া ভাষায় এই শব্দ প্রয়োগ করলে কারও জলপানি জোটার নৈতিক অধিকার থাকে না।
আরও পড়ুন-আলোকিত আলোচিত মহানায়কের নায়িকারা
‘কলকাত্তাইয়া ভাষা’ প্রসঙ্গটি এই আড্ডা বা আলোচনায় একেবারে ফেলনা নয়। সেটা বোঝানোর জন্য ওই বঙ্গজ স্বামী বিবেকানন্দের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেয়। ১৯০০ সালে এরকমই একটা ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে আমেরিকা থেকে ‘উদ্বােধন’ পত্রিকার তদানীন্তন সম্পাদককে একটি পত্র লেখেন স্বামীজি। সেই পত্রের একাংশ তাঁর লেখা ‘বাঙ্গালা ভাষা’ বিষয়ক প্রবন্ধ রূপে প্রচলিত। সেই পত্রে বা প্রবন্ধে বিবেকানন্দ সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘‘যদি বল… বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোন্টি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ, কলকেতার ভাষা।”
আরও পড়ুন-যুবভারতী ফের মোহনবাগানেরই, টানা আট ডার্বি জয়ের রেকর্ড
এটুকু বলেই থেমে থাকেননি বিবেকানন্দ। প্রত্যয়ী উচ্চারণে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন কলকাত্তাইয়া ভাষার ওপর তিনি এত জোর দিয়েছেন। ‘‘পূর্ব-পশ্চিম, যেদিক হতে আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়।… যত রেল এবং গতাগাতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব-পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ওই কলকেতার ভাষাই চলবে।”
সুতরাং, বিবেকানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে ওই আড্ডাবাজ বন্ধুটির বক্তব্য, যেহেতু কলকাতার ভাষায় ‘পানি’ চলে না, সুতরাং তা বর্জ্য। সে জানায়, বাংলাদশে নাকি এপার বাংলার বিখ্যাত লেখকদের লেখায় ‘জল’ শব্দটি থাকলে সেটিকে কেটে তার জায়গায় ‘পানি’ বসিয়ে তবে সেই বই ‘পাইরেসি’ হয় ওপার বাংলায়। সুতরাং, ‘পানি’ সর্বৈবভাবে বাংলাদেশি শব্দ এবং তার গায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গন্ধ বেশ টের পাওয়া যায়।
আড্ডাটা এ পর্যন্ত এগোনোর পর আজন্ম বাংলামাধ্যমে বাংলাকে প্রথম ভাষা হিসেবে পড়া ব্যক্তিটিকে আসরে নামতে হয়। একের পর এক অকাট্য যুক্তি সাজিয়ে তাকে দেখিয়ে দিতে হয় ‘পানি’ বাংলাদেশি শব্দ নয় এবং তার গায়ে কোনও সাম্প্রদায়িক গন্ধ আদপেই নেই। এবং এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দকে ভুলভালভাবে টেনে আনার কোনও যুক্তি নেই।
আরও পড়ুন-তিনে শেষ, খুশি দিমিত্রিরা
তার প্রথম কথা, ‘পানি’ কোনও আরবি-ফারসি শব্দ নয়। এর ব্যুৎপত্তি একেবারেই সংস্কৃত থেকে। জ্ঞনেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সংস্কৃত ভাষার ‘পানীয়’ শব্দ থেকে এসেছে ‘পানি’ শব্দটি। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, ওড়িয়া, গুজরাতি, মারাঠি এমনকী অসমীয়া ভাষাতেও ‘পানি’ প্রচলিত শব্দ। এক কথায়, বাংলায় পানি নিয়ে যতই ছুঁতমার্গ চাগিয়ে তোলার চেষ্টা হোক না কেন, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য নবীন ভারতীয় ভাষাগুলি দিব্যি ‘পানি’তে স্বচ্ছন্দ। এমনকী বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, যেটির রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনও সময়ে, সেখানেও ভুসুকপাদ লিখছেন, ‘‘তে ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পানি।” কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল লেখা হয়েছিল ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনও সময়ে। সেখানেও লেখা হয়েছে, ‘‘যদি দুগ্ধ উতলয়ে নাহি দেয় পানি। পাশা খেল সবে মিলি দিবস রজনী।”
আরও পড়ুন-অতিরিক্ত ওষুধ আর নয়
দ্বিতীয়ত, ‘পানি’ শব্দে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ এই শব্দের প্রয়োগ ইতিমধ্যে উল্লিখিত। বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ ‘জল’ ও ‘পানি’, দুটো শব্দই স্বচ্ছন্দে প্রয়োগ করেছেন, একেবারে পাশাপাশি। ‘‘তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পানি। উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণি।” এটা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর যমুনাখণ্ডের পঙ্ক্তি। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যে আদি-মধ্যযুগের নিদর্শন। ‘চর্যাপদ’-এর পর এটিই বাংলাভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ।
তৃতীয়ত, ‘পানি’ শব্দটি ব্যবহার করতে যেমন পরম বৈষ্ণব কবি লোচনদাস তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ কোনও দ্বিধা করেননি, তেমনই মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওলও তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে ‘জল’ শব্দটি প্রয়োগ করতে ইতস্তত করেননি। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ পাচ্ছি, ‘‘মুখে নাহি সরে বাণী দুনয়নে ঝরে পানি”, আবার ‘পদ্মাবতী’-তে পাচ্ছি, ‘‘শীর্ষের সিন্দুর নয়ানের কাজল সব ভাসি গেল জলে” কিংবা ‘‘না ভিজয় জলত অগ্নিত না পোড়য়।” সুতরাং ‘জল’ কিংবা ‘পানি’র প্রয়োগ অনুসারে শব্দটি প্রয়োগকারীর ধর্ম-সম্প্রদায় চিহ্নিতকরণ অযৌক্তিক, অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে।
আসল কথাটা হল, লোকসাহিত্য যখন যেটাকে জুতসই মনে করেছে তখন সেটাকে ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে হিন্দু মুসলমানের বালাই রাখেনি। এ-জন্যই বাংলা প্রবাদে যেমন আছে ‘হাতি ঘোড়া গেল তল / মশা বলে কত জল’, আবার এটাও তথায় স্বমহিমায় বিরাজমান ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি।’
আরও পড়ুন-মেডিসিন অ্যাডহেয়ারেন্স, সাইড এফেক্ট দূর করুন
সুতরাং বাংলা ভাষায় ‘বৃত্তি’ অর্থে ‘জলপানি’র সহাবস্থানে যাঁদের অপরিসীম আপত্তি তাঁরা ‘পানিপানি’ বা ‘জলজল’ ব্যবহার করে ‘বৃত্তি’ বোঝানোর চেষ্টা করুন এবং হাস্যকর ব্যক্তিত্বে পরিণত হোন। শুভেচ্ছা রইল।
একই ভাবে, যাঁরা ‘জল’ স্পর্শ করলে ভাষা সন্ত্রাসের শিকার হবেন বলে সদা আতঙ্কে ভোগেন তাঁরা ‘জলীয়’ আর ‘পানীয়’-কে অভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হোন। তাঁদের জন্যও শুভেচ্ছা রইল।
বাংলা বাঁচুক আপন সাবলীল প্রবহমানতায়, নিজস্ব ছন্দে। সেই ছন্দিল ঔদার্যের আবহেই তো বীথি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিরা অক্লেশে লিখতে পারেন,
‘পানির ওপর জল নাকি সে জলের ওপর পানি? / রবীন্দ্রনাথ আকাশ দেখে লিখেছেন আসমানী।
আরও পড়ুন-বুমেরাং সমালোচনা, দুরবস্থা ডবল ইঞ্জিন বিজেপি রাজ্যের শিক্ষায় শীর্ষে বাংলা
…
এসব কথা খুবই সহজ, আমরা সবাই জানি/ সুনীলদা জল লিখলে সেটা হুমায়ুনের পানি।”
এই প্রায় সর্বজ্ঞাত সহজ সত্যটা যখন কেউ আপন সামাজিক প্রতিপত্তির সৌজন্যে, পণ্ডিতি-বলের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চান, তখনই জল হোক বা পানি, সেটা ঘোলা হয়ে যায়। আর সেই ঘোলাজলে মাছ ধরার লোকের অভাব হয় না।
নাঃ! ঘোলাজলে মৎস্য-শিকারিদের জন্য কোনও শুভেচ্ছা বার্তা দেওয়া গেল না।