গোকুলে বাড়িছে সে
বাঙালির বহুমুখী প্রতিভা বিশ্ববন্দিত। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাসের নানান ক্ষেত্রে বাঙালি তার সুচারু মেধা ও মননের স্পর্শ ছড়িয়ে রেখেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ উল্কার মতো আবির্ভূত হয়ে ক্ষণিক জীবনের আলোয় তাদের আশ্চর্য অবদানে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তাঁদের প্রতিভার আলো সামান্য কিছু গবেষকের আতশকাচের বাইরে বেরিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে, মনের নিত্য আসা-যাওয়ার আসনে অধিষ্ঠান পায়নি। কেউ কেউ আবার ভাগ্যের আশ্চর্য পরিহাসে অবিচারের শিকার হয়ে সুখ্যাতি সুনামের আলো থেকে বঞ্চিত থেকেছেন ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়কের মতো। এমনই এক স্বনামধন্য বাঙালি নায়ক বহির্বিশ্বে যাঁর পরিচয় আর ডি ব্যানার্জি হলেও আমাদের কাছে তিনি বহরমপুরের ভূমিপুত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি প্রায় একক দক্ষতায় ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার করলেন।
আরও পড়ুন-বিশ্ব পিতা তুমি হে প্রভু
সমসাময়িক বাঙালি মনীষীদের মধ্যে যখন সুভাষ বোস স্বদেশ চিন্তা এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন, সত্যেন বোস এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ঝুঁকলেন বিজ্ঞানে, নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায় বেছে নিলেন শিল্পকলা, শরৎচন্দ্র এবং কাজী নজরুল তুলে নিলেন সাহিত্যের কলম, রাখালদাস হাঁটলেন সম্পূর্ণ অন্য পথে। বাংলার ঐতিহাসিক নবাবের শহরের সন্তান ইতিহাসকেই বেছে নিলেন জীবনের ব্রত হিসেবে। ইতিহাসের প্রতি অগাধ ভালবাসা নিয়ে যাঁর পথচলা শুরু, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই ইতিহাসের কাছেই দায়বদ্ধ রইলেন। বহুদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র একবার দুঃখ করে বলেছিলেন— ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না…।’ সাহিত্যসম্রাটের এমন আক্ষেপের কথা আড়াল থেকে শুনে ঈশ্বর হয়তো রাখালদাসকে গোকুলে বড় করে তুললেন বাঙ্গালার ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে।
আরও পড়ুন-রাহানে-ঝড়ে হেলায়, মুম্বই জয় সিএসকের
জন্ম এবং শিক্ষাজীবন
১৮৮৫ সালে ১২ এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের কাছে কালীমাটি গ্রামে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি পেশায় বহরমপুর কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী ছিলেন। মাতা কালীমতী দেবী ছিলেন কোচবিহার রাজার দেওয়ানের মেয়ে এবং মতিলালের দ্বিতীয় স্ত্রী। রাখালদাস ছিলেন কালীমতীর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠে পরবর্তীতে তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। একই বছরে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদার নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে কাঞ্চনমালা দেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯০৩ সালে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। মাঝের বছরগুলিতে বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং নানান পারিবারিক অশান্তির কারণে তার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। সব বাধা অতিক্রম করে ১৯০৭ সালে তিনি ইতিহাসে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।
আরও পড়ুন-বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় : সুদীপ
ছাত্র হিসেবে রাখালদাস শিক্ষক এবং সহপাঠী মহলে সমাদৃত ছিলেন। এই সময় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ইতিহাসের নানান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেন। বিএ পাশ করার আগেই তিনি প্রাচীন লেখ ও মুদ্রা বিষয়ে প্রায় বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ‘বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি’ পত্রিকায় রাখালদাসের অনেকগুলো প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হয় যা পণ্ডিত ভিনসেন্ট ও স্মিথ কর্তৃক ভূয়সী প্রশংসিত হয়। পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতার কারণে রাখালদাসের চালচলন এবং জীবনযাপনে ছিল নবাবি ঠাঁটবাট। বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাণখোলা আড্ডা দিয়েছেন বহরমপুর থেকে কলকাতা সর্বত্র। শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিদ্যার দুনিয়ায় একটি পরিচিত নাম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
আরও পড়ুন-৮ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ৮০ লক্ষ মহিলা কর্মীকে ঋণ এবং পরিশোধ, আবার রাজ্যের রেকর্ড
কর্মজীবন এবং লেখালেখি
পড়াশোনা শেষ করে রাখালদাসকে বসে থাকতে হয়নি। স্কুলজীবন থেকেই প্রাচীন লিপি পাঠোদ্ধারে তাঁর দক্ষতা ছিল পরবর্তী কর্মজীবনের পাথেয়। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘জুবিলি রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯১০ সালে কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেন তিনি। পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান বিভাগের সর্বভারতীয় ডিরেক্টর জেনারেল স্যার জন মার্শাল রাখালদাসের কাজকর্ম দেখে খুবই মুগ্ধ হন। এরপর ১৯১৭ সালে সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট পদে উন্নীত হয়ে ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হিসেবে পুণের অফিসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাখালদাস। এখান থেকেই প্রত্নতত্ত্ববিদ্যায় তাঁর সাফল্যের উড়ান শুরু। পশ্চিম ভারতের বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দূর-দূর অঞ্চলে তাঁর অনুসন্ধানী মনন খুঁজে বের করে প্রাচীন ভারতের অমূল্য ইতিহাস।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
১৯২২ সালের শুরুর দিকে রাখালদাস কর্মসূত্রে সিন্ধুদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো পরিদর্শনে যান এবং সেখানে খননকার্য চালিয়ে সিন্ধু সভ্যতার সেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে অবিনশ্বর কীর্তি স্থাপন করেন। এরপর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ১৯২৪ সালে তাঁকে ইস্ট সার্কেলে স্থানান্তরিত করে অধুনা বাংলাদেশের পাহাড়পুরে খননকার্য পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বদলি নয়, আসলে মার্শালের নির্দেশে চক্রান্ত করে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী অপ্রমাণিত একটি চুরির অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। আহত এবং ভগ্নহৃদয়ে ১৯২৬ সালে পুরাতত্ত্ব গবেষণা থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে ১৯২৮ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রফেসর’ হিসেবে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
আরও পড়ুন-মাঝ-আকাশে দরজা খোলার চেষ্টা বিমানযাত্রীর
রাখালদাস ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পুরনো লিপি পড়ে তার ব্যাখ্যা, প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মুদ্রার গুরুত্ব নির্ণয়, স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পকলা নিদর্শনের মূল্য বিচার ইত্যাদি মিলিয়ে প্রাচীন ভারতের প্রামাণিক ইতিহাস রচনা করা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসাবে খননকার্য চালানোর পাশাপাশি তিনি ইতিহাস বিষয়ের উপর লিখেছেন অজস্র বই। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষার আদি রূপ ‘প্রোটো বাংলা লিপি’ নিয়ে গবেষণা করেন। সমগ্র জীবনে তিনি ১৪টি মনোগ্রাফ, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনশোর বেশি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় ‘বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি’, ‘বিহার রিসার্চ সোসাইটি’, লন্ডনের ‘রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি’, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘Modern Review’, ‘Epigraphia Indica’, ‘Indian Antiquary’, ‘Annals of Bhandarkar Oriental Research Institute’ ইত্যাদি নানান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি— দুই খণ্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৯১৪ এবং ১৯১৭), দুই খণ্ডে ‘উড়িষ্যার ইতিহাস’ (১৯৩০ এবং ১৯৩১), ‘ভূমারার শৈবমন্দির’ (১৯২৪), ‘ত্রিপুরী হৈহায়াস জাতির ইতিহাস’ (১৯৩১) ইত্যাদি। এ-ছাড়াও, কুষাণ বংশের ইতিহাস বিষয়ে লেখা ‘পাষাণের কথা’ (১৯১৪), গুপ্ত বংশের বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস ‘শশাঙ্ক’ (১৯১৪), পাল বংশের ইতিহাস সম্পর্কিত ‘ধর্মপাল’ (১৯১৫), ‘ধ্রুব’ (১৯১৭) এবং ‘করুণা’ (১৯১৭) গ্রন্থগুলি ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।
আরও পড়ুন-শীতলকুচিকাণ্ডে নেপথ্যে কারা, তদন্ত শুরু
এছাড়াও ‘পক্ষান্তর’ (১৯২৪), ‘ব্যতিক্রম’ (১৯২৪), ‘অনুক্রম’ (১৯৩১) উপন্যাসগুলি রাখালদাস লেখেন বেশ কিছুদিন পরে। বাংলা ভাষায় ভারতীয় মুদ্রার উপর লেখা প্রথম গ্রন্থ ‘প্রাচীন মুদ্রা’ (১৯১৫) তাঁর অন্যতম সফল প্রচেষ্টা। শাহ্জাহান আমলে পর্তুগিজদের নৃশংসতার ইতিহাস-বিষয়ক ‘ময়ূখ’ (১৯১৬), ফারুকশিয়ার-এর আমলে বাংলার পরিস্থিতি-বিষয়ক ‘অসীম’ (১৯২৪) গ্রন্থে তাঁর গবেষণার তারিফ করতে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনায় দুটি উল্লেখযোগ্য পাঠ্যবই লেখেন ‘History of India’ (1924) এবং ‘A Junior History of India’ (1928)। এ-ছাড়াও ‘The Origin of the Bengali Script’ (1919), ‘Palas of Bengal’ (1915) বাংলার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। নাদির শাহের দিল্লির প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর শেষ উপন্যাস ‘লুৎফুল্লাহ’ (১৯২৯)। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস-বিষয়ক ভাষণগুলো একত্রিত করে ‘The Age of the Imperial Guptas’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। বাংলায় লেখা রাখালদাসের গ্রন্থ এবং প্রবন্ধগুলি পরবর্তীতে নানান ভারতীয় ভাষায় অনূদিত এবং সমাদৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন-উত্তর থেকে দক্ষিণ, সপ্তাহান্তেও ট্রেন বাতিল অব্যাহত
বিখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় লিখলেন— ‘স্বর্গত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ইংরেজি ভাষায় রচিত বাঙলার পাল রাজবংশের কাহিনী এবং তাহার বাঙ্গালার ইতিহাস বহুদিন প্রাচীন বাংলার প্রামাণিক ইতিহাস বলিয়া গণ্য। কয়েক বৎসর আগে শেষোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে; এখনও যে সে গ্রন্থের মূল্য পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত ইহাই তাহার প্রমাণ…। একথা স্বীকার করিতেই হয় যে অনেক গবেষকদের সম্মিলিত চেষ্টা ও সাধনার ফলে আজ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আমাদের কাছে অল্প বিস্তর সুপরিচিত; অন্তত মোটামুটি কাঠামো সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা কিছু নাই।’
আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার সংযুক্তি থাকলেই এবার মিলবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার এবং ঐতিহাসিক ট্রাজেডি
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয়দের কৃতিত্ব এবং মেধাকে ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা সর্বজনবিদিত। ১৮৬৫ সালে পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ এভারেস্টের নামকরণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ‘রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি’ কর্তৃক পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপকারী ভারতীয় গণিতজ্ঞ রাধানাথ শিকদারের কৃতিত্বকে অস্বীকার করার ঘটনা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ১৯২২ সালে যখন বাঙালি ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ৫০০০ বছরের পুরনো সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। কিন্তু রাখালদাসের সেই কৃতিত্বকে ধামাচাপা দেন তৎকালীন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার ডিরেক্টর জেনারেল স্যার জন মার্শাল। পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বের কাছে জন মার্শাল নিজেকে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক হিসেবে মিথ্যে প্রচার করে সুনাম অর্জন করলেন। আহত রাখালদাস দিশাহারা হয়ে বাঙালি মনীষী ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সাহায্যের হাত পাতলেন। তিনি সদুপদেশ দিলেন। রাখালদাসের গবেষণালব্ধ প্রচুর প্রবন্ধ ‘মডার্ন রিভিউ’ এবং ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর নামে এবং বেনামে ধারাবাহিক প্রকাশ হতে লাগল। কিন্তু কেউ সে-কথা বিশ্বাস করলেন না। এমনকী জওহরলাল নেহরু তাঁর লেখা ‘The Discovery of India’ গ্রন্থে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক হিসেবে স্যার জন মার্শালের নাম উল্লেখ করেন। বাঙালি আরও একবার তাঁর কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হল।
আরও পড়ুন-মহিলাদের পোশাক বিতর্কে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, তুলনা টানলেন শূর্পণখার সঙ্গে, প্রতিবাদ তৃণমূল কংগ্রেসের
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব গবেষণায় মার্শালের কৃতিত্ব কম ছিল না। ১৯০২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত একটানা তিনি ডিরেক্টর পদে আসীন ছিলেন। আসলে জহুরি মার্শাল রাখালদাসকে প্রথম দেখাতেই জাত চিনেছিলেন। সামনে প্রশংসা করলেও ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে পারতেন না। লিপি লেখ এবং মুদ্রা-বিশারদ হিসেবে রাখালদাসকে মার্শাল নিজে এক কলম সুপারিশ লিখে দেননি। এত কম বয়সে একজন বাঙালির এমন কৃতিত্বকে মার্শাল ঈর্ষা করতেন। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাখালদাসকে তিনি পূর্ব-পশ্চিম বিভিন্ন অভিমুখে সমগ্র ভারতবর্ষ ছুটিয়ে মেরেছেন।
‘Rakhal Das Banerji : The Forgotten Archeologist’ গ্রন্থে পি কে মিশ্র দাবি করেন— ‘Marshall took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee had done all the work a discovered should have done.’ অর্থাৎ ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সালে অন্যায়ভাবে অপসারণ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার সংক্রান্ত সমস্ত খননকার্য, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছবি সংগ্রহ, লেখালেখি ইত্যাদি নানান দায়িত্ব পালন করেন। অপ্রকাশিত এই কাজগুলি তিনি তাঁর বস মার্শালের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই মারাত্মক ভুল করে বসেন। ধুরন্ধর মার্শাল বুঝে যান সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে অথচ ১৯২৪ সালের মে মাসের আগে পর্যন্ত মার্শাল সিন্ধু সভ্যতার এই নিদর্শন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অনতিবিলম্বে ১৯২৫ সালে মার্শাল মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়েন কৃতিত্বের লোভে। গোটা পৃথিবী চিনল মার্শালকে কিন্তু বাঙালি তথা ভারতীয় মননে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক হিসেবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম চির উদ্ভাসিত হয়ে রইল।
আরও পড়ুন-মোবাইলের সঙ্গে লড়াই ফটোগ্রাফারদের
রাখালদাসের শেষ জীবন এবং পরবর্তী অধ্যায়
চাকরি হারিয়ে, সম্মানহানি বুকে নিয়ে, পরিশ্রমসাধ্য নিজের কৃতিত্ব খুইয়ে আহত বিধ্বস্ত রাখালদাস ভীষণ আর্থিক অনটনের শিকার হন। জীবনের শেষ দিনগুলিতে অধ্যাপনায় যেটুকু সম্মান ছিল তার তুলনায় আর্থিক সচ্ছলতা ছিল কম। দুশ্চিন্তার আড়ালে শরীরকে গ্রাস করে ফেলে নীরব প্রাণঘাতী মধুমেহ রোগ। এছাড়াও সন্তানের অকালপ্রয়াণ তিনি মেনে নিতে পারেননি। অবশেষে ১৯৩০ সালে ২৩ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতায় রাখালদাস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভারত সরকারের তরফ থেকে মরণোত্তর বা অন্য যেকোনও সম্মান অকালপ্রয়াত ঐতিহাসিক আবিষ্কারক এই বাঙালি যুবকের কপালে আজও জোটেনি। ইতিহাসের বইয়ের পাতায় তিনি থেকে গেছেন ট্র্যাজিক মহানায়ক হয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে কোথাও তাঁর নাম উল্লেখিত হল না। ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো মহেঞ্জোদারোকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। ২০২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩৭তম জন্মবার্ষিকীতে কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘরে প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রত্নতত্ত্বের এই ট্র্যাজিক মহানায়ককে সম্মান জ্ঞাপন করা হয়।