সমাজ সংস্কারকরূপে যে সকল মনীষী ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায় চিরশ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন, তাঁদের অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁরই অক্লান্ত প্রয়াসে ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি বিধবা বিবাহ আইন পাশ করেন।
ভারতে হিন্দু সমাজে যে সমস্ত কুপ্রথাগুলি প্রচলিত ছিল বাল্যবিবাহ তার মধ্যে অন্যতম। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হল বাল্যবিধবা। বৈধব্যের মর্মান্তিক যন্ত্রণা নিরসনে সমাজের সংবেদনশীল অংশ মাঝে-মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠলেও রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুদের চাপে সংস্কার আন্দোলনগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি তত্ত্ববোধিনী সভা, নব্যরঙ্গ গোষ্ঠী, সুহৃদ সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, সত্যশোধক সমাজ, প্রার্থনা সমাজ প্রভৃতি সংস্থা বিধবা বিবাহের প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমাচার দর্পণ, জ্ঞানান্বেষণ ইত্যাদি পত্রিকাতেও এর পক্ষে প্রচার চালানো হয়।
আরও পড়ুন-বাবাকে খুশি করতেই টাইটানে উঠেছিলেন সুলেমান
বিধবা বিবাহের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিধবাদের করুণ দশা ও যন্ত্রণাময় জীবন বিদ্যাসাগর মশাইকে ব্যথিত করে তোলে। এ-ব্যাপারে প্রথমে তিনি জনমত গঠনের চেষ্টা চালান। তিনি ১৮৫৫ সালে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এতে পরাশর সংহিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। এর আগেই তিনি বাল্যবিবাহের দোষ নিয়ে ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় নিবন্ধ লেখেন। এ-ছাড়াও তত্ত্বাবোধিনী পত্রিকায় বিধবা বিবাহের সমর্থনে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এগুলিতে বিধবাদের জীবনের দুর্দশা ও করুণ অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন তিনি। ১৮৫৫ সালে ৯৮৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত বিধবা বিবাহের পক্ষে লেখা একটি আবেদনপত্র তিনি সরকারের কাছে পাঠান। এর প্রতিবাদে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেব-এর নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। বিদ্যাসাগরের জোরালো দাবির ভিত্তিতে সরকার ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই ১৫ নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতি দেবীর প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র নিজপুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিধবা ভবসুন্দরী দেবীর বিবাহ দেন।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের প্রচারে কাল কোচবিহারে মুখ্যমন্ত্রী
বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেন ভারতীয় সমাজে হিন্দু নারীদের অকারণ বৈধব্যের অসহায়তা থেকে মুক্তি দিতে হবে। যৌন ব্যভিচার ও সামাজিক কলুষতা নিবারণের জন্যও বিধবা বিবাহের প্রচলন ভীষণ জরুরি বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। ভারতীয় হিন্দু সমাজে প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার বিকাশে ও সমাজকল্যাণে সংস্কারকের ভূমিকায় আরও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে পাশে পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ এঁদের অন্যতম। নারীদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, রুক্ষ, কঠোর বৈরাগ্যক্লিষ্ট নিরানন্দের জীবন থেকে মুক্তি এবং স্বাভাবিক সাংসারিক জীবন যাপনের দ্বারা সমাজ ও সংসারের ভারসাম্য ও সুস্থতা রক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভাবনাকে সমর্থন করেছিলেন উল্লেখ্য গুণী ও বিদ্বজ্জনেরা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এবার চোখ রাখা যাক বিশ্ব মানচিত্রে। আসা যাক আন্তর্জাতিক বিধবা দিবসের কথায়। প্রতি বছর ২৩ জুন উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস। ‘দ্য লুম্বা ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক এই আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস প্রথম পালিত হয় বৈধব্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে। ২৩ জুনের তাৎপর্য হল যে, ১৯৫৪ সালের এই দিনটিতেই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড লুম্বার মা পুষ্পাবতী লুম্বা বিধবা হয়েছিলেন।
সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য মহিলা আছেন যাঁরা জীবনসঙ্গী হারানোর পরে ভীষণ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন এবং নিজেদের মানবাধিকার, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম করতে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন-কংগ্রেস ও আপের মাঝে হস্তক্ষেপ নেত্রীর
প্রতি বছর ২৩ জুন বিশ্বব্যাপী বিধবা দিবস পালিত হয়। দিবসটি বিধবাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যও পালিত হয়। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস শুরু করেন যাঁরা, সেই লুম্বা ফাউন্ডেশন লক্ষ্য করেছিল যে, বিভিন্ন দেশের মহিলারা তাঁদের স্বামী মারা যাওয়ার পরে প্রচণ্ড কষ্টের সম্মুখীন হন। তাঁরা বেশ কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে যান। সরকার বা নানা অসরকারি ও বেসরকারি সংস্থা তাঁদের সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকে এবং সমাজও তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাঁরা চূড়ান্ত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে দিশাহারা বোধ করেন ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। অবশেষে, ২৩ জুন ২০১০-এ, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
এই দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য বিধবাদের সমস্যা ও দাবির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাঁদের সমস্যাগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা। বিধবা-জীবন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-পাটনায় বৈঠকের পর কী জানালেন দলনেত্রী
সাধারণ পরিষদে পেশ করা লুম্বা ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ৬ কোটির বেশি বিধবা-নারী স্বামী হারিয়ে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হন। আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ও যত্ন নেওয়া এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কেবলমাত্র তাঁরা বেঁচে থাকার উপায় থেকে বঞ্চিত তাই-ই নয়, পাশাপাশি উত্তরাধিকারের অধিকার এবং সমান মৌলিক অধিকার থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। বিশ্ব জুড়ে আনুমানিক ২৫৮ মিলিয়ন বিধবা রয়েছেন। বিধবা ভাতা ভারত ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে চালু থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। নাগরিক সচেতনতার অভাবেও বিধবারা সরকারি ও অসরকারি সংস্থাগত সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। সারা বিশ্বেই বিধবাদের সমস্যাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সমস্যা। সন্তান-সন্ততি-সহ অথবা একাকীর প্রধান প্রয়োজন খেয়ে-পরে জীবনধারণ, অর্থাৎ সেই আদি অকৃত্রিম অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা। যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন তাঁদের অসহায়তা আরও যন্ত্রণাময়। বিধবাদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শুধু সচেতনতা বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, সরকার, এনজিও এবং অন্যান্য সহৃদয় ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে একত্রিত করে সারা বিশ্বের দেশে-দেশে বিধবাদের পাশে দাঁড়ানো আজ ভীষণ প্রয়োজন। বিধবাদের প্রায় সকলেই অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মুখোমুখি হন প্রতিমুহূর্তে। তার স্থায়ী প্রতিকার কোথায়?
আরও পড়ুন-নবান্নে জোরদার হচ্ছে নিরাপত্তা, বসানো হচ্ছে হেড কাউন্টিং ক্যামেরা
এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ— ১৯৯৮-’৯৯ অর্থবর্ষ থেকে বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতা মহিলা ভাতা চালু, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ক্ষমতায়ন-সহ আরও কিছু পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। মুসলিম বিশ্বে বিধবার হার তুলনামূলক কম। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাচীন ও বর্তমান অনেক ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় বিধবাদের জীবন অত্যন্ত মানবেতর। শুধুমাত্র বিধবা হওয়ার কারণে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে এমন দু্ঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি তাঁদের হতে হয় যা বর্ণনাতীত। হিন্দু ধর্মের নানাবিধ কুসংস্কার আজও বিধবাদের নিগৃহীত করে এবং তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কতিপয় মুসলিম সমাজেও বিধবাদের ‘অপয়া’ বলে মনে করা হয়। ফলে বৈধব্যজীবন কিছুতেই আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে না। তবে এটাও উল্লেখ করতে হয় যে, বিধবা-পরবর্তী নারীকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে পরবর্তী বিবাহের কোনও বিকল্প নেই, যা ইসলাম অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছে। বিধবাদের অসম্মান, অনাদর ও অবহেলায় যাতে জীবনযাপন করতে না হয়, তাঁদের প্রতি পদে যাতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে না হয়, সেই ব্যাপারেও ইসলাম সংবেদনশীলতা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন-তলিয়ে গিয়েছে টাইটান ডুবোযান, ৫ যাত্রীর মৃত্যু
বিধবা নারীদের নানা অমর্যাদাকর রীতি মানতে হয় দেশে-দেশে। তথাকথিত সভ্য ও উন্নত দেশগুলোও এর বাইরে নয়। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাদের প্রথম কোপ পড়ে পুষ্টিকর আহারে। বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, এটা অবশ্যই বাড়তি চাপ। স্বামীহারা মহিলাদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে অত্যন্ত অবমাননাকর ও বিপজ্জনক রীতি চালু আছে বিভিন্ন দেশে। কোনও কোনও দেশে এমনও ঘৃণ্য রীতি আছে যেখানে স্বামীর মৃতদেহকে যে জলে স্নান করানো হয় সেই জল খেতে দেওয়া হয় সদ্য বিধবাকে। শোনা যায় ঘানায় সদ্যবিধবাদের তাঁদের মৃত স্বামীর শরীরের অংশ দিয়ে বানানো স্যুপ বা খাবার খেতে দেওয়া হয়। এখানে খাবার বানানোর কাজে মৃতের নখ ও চুল ব্যবহার করা হয়। এখানে স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তি তাঁর পরিবারে ফেরত যায়, তার ফলে অনেক বিধবা জমি ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, যদি না তিনি মৃত স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যকে বিবাহ না করেন।
আরও পড়ুন-ভয়াবহ বন্যা অসমে, সরানো হল লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে
ধারণা করা হয়, সারা বিশ্বের বিধবাদের প্রতি দশজনের একজন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন এবং চরম লাঞ্ছনায় জীবন অতিবাহিত করেন। জাতিসংঘের হিসেবে অনেক দেশেই বিধবাদের সঙ্গে যেসব অমানবিক আচরণ করা হয় তা একেবারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমান। পেঁয়াজ ও রসুন-সহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার থেকে বিধবারা বঞ্চিত হন একথা যেমন সত্যি, ঠিক ততটাই সত্যি জৌলুসের পোশাক, উজ্জ্বল শাড়ি, গয়না ও অন্যান্য অলঙ্কার ইত্যাদি সবই একজন বিধবার জীবন থেকে বাতিল হয়ে যায়। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন অধিকাংশ বিধবা। চিন, ইউরোপ ও আমেরিকায় চালানো গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সেখানেও বিধবা নারীদের খাবারের মান ও বৈচিত্র প্রায়ই থাকে না এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ওজন কমে যায়। শরীর দুর্বল হয়ে ভেঙেও পড়ে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত সামাজিক প্রকল্প তুলে ধরে ভােট-প্রচার করলেন সেচমন্ত্রী
সত্তর এবং আশির দশকে কানাডার বিধবাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ এলিজাবেথ ভেসনাভার। উনি দেখেছেন, স্বামীর মৃত্যুর পরের দু’বছরের মধ্যে স্ত্রীর মারা যাওয়ার খুবই ঝুঁকি থাকে। তিনি মনে করেন এর পিছনে বড় কারণ খাবার। কম খাওয়া, পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া ও চিত্তবিনোদনের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক অবসাদ গ্রাস করে বিধবাদের। আনন্দহীন নীরস ও নিঃসঙ্গ জীবনে বেঁচে থাকার বাসনা তাঁদের দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। ফলে মৃত্যু আসে দ্রুত। বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক বিধবা দিবসে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ‘মোটিভেশন’, অর্থাৎ প্রেরণা বা বেঁচে থাকার জন্য নতুন উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার জন্য বিধবাদের পাশে দাঁড়ানো সভ্য সমাজের কর্তব্য। দিতে হবে আন্তরিক সাহচর্য। বাড়াতে হবে ভরসা ও আস্থার বিশ্বস্ত হাত। দিতে হবে সাহস। সবচেয়ে জরুরি মানসিক শুশ্রূষা। বিধবাদের বিপদে-আপদে ও যে কোনও সমস্যায় ছুটে এসে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করতে হবে। তাঁদের সবসময় বোঝাতে হবে যে, তাঁরা কখনওই একা নন এবং সমাজ ও সংসারে তাঁদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
আরও পড়ুন-আরও ৩১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে!
আমাদের দেশে বৃন্দাবনকে বিধবানগরী বলা হত দীর্ঘকাল। এখন সেখানকার ছবি কিছুটা পাল্টালেও সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত স্তরে বিধবাদের তেমন উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এখনও ঘটেনি। এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই চিত্র শুধু ভারতেই নয়, যে কোনও উন্নয়নশীল দেশে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিধবাদের দুর্দশা কম-বেশি একইরকম। তবে প্রথম বিশ্বের তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও বিধবারা যে খুব সুখে আছেন তা-ও নয়।
আরও পড়ুন-তলিয়ে গিয়েছে টাইটান ডুবোযান, ৫ যাত্রীর মৃত্যু
যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বন্যা, ভূমিকম্প, দুর্ঘটনা, মহামারী ও অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে অথবা দারিদ্র ও অপুষ্টিজনিত কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে স্বামীদের অকালমৃত্যুর জন্য বিশ্বে বিধবাদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, আফগানিস্তান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে বিধবাদের অবস্থা বেশ করুণ। আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিতে মানুষের দারিদ্র ও অভাবজনিত নিদারুণ ও অনিশ্চিত জীবনযাত্রা এবং নিরাপত্তাহীন জীবিকার দরুন মৃত্যুও অকালবৈধব্যের অন্যতম কারণ। চরম অভাবে বিধবাদের চুরি, মাদকপাচার ও নানা অসামাজিক কার্যকলাপ, এমনকী বেশ্যাবৃত্তির মতো নির্মম পথ বেছে নিতে হয় নানা সময়ে। সন্তান-সহ পরিবার প্রতিপালনের জন্য এইসব বিভীষিকাময় জীবন বেছে নেওয়া সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অত্যন্ত লজ্জার। তাই সারা পৃথিবীর সমস্ত বিধবাদের চাই মর্যাদাময় পুনর্বাসন। চাই আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, চাই সমাজের সর্বস্তরের সহানুভূতি, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব। চাই বিভিন্ন কাজে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে জীবনের মূলস্রোতে টেনে আনার স্থায়ী বন্দোবস্ত। একইসঙ্গে চাই বিধবাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রতি নজর দেওয়া এবং তাদের অবস্থার কতটা উন্নতি হচ্ছে তার পরিসংখ্যান রাখা।
আরও পড়ুন-ফাইনালে সবুজ-মেরুন
শেষ পর্যবেক্ষণ, এখনও কাটেনি তমসা। এখনও জয় অধরা। দিবস পালনের প্রচলিত প্রতিশ্রুতির প্লাবনে সমস্তটা সঁপে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার প্রয়াসে মূল সত্যকে আড়াল করা অপরাধের শামিল। আড়াল করা অসম্ভবও। মনে রাখতে হবে বিশ্বের নারীশক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিধবা নারীরা। তাঁদের অন্ধকারে রেখে কতদূর এগোতে পারবে মানবসভ্যতা? অতএব অবিলম্বে তাঁদের জন্য নিরুদ্বেগ ও মর্যাদাময় বেঁচে থাকার সুবন্দোবস্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকেই। তবেই সফল, সার্থক ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক বিধবা দিবস।