বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনার শুরুতেই আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত জাতি বিষয়ক ধারণা। তিনি যে জাতির বিষয়ে কথা বলেছেন সেটির কৌমগত, ভৌগোলিক ও সামাজিক উপাদানের ব্যাপারে ধোঁয়াশা আছে। কখনও কখনও তিনি ‘ভারতীয়’ শব্দটি যে অর্থে আমরা শব্দটি বর্তমানে ব্যবহার করি, সেই অর্থে ব্যবহার করেননি। তাঁর বিচারে ‘ভারতীয়’র পরিধিতে কেবল ‘বাঙালি’ ও ‘হিন্দু’ও কখনও কখনও ঢুকে পড়েছে।
আরও পড়ুন-নতুন মুখ অনেক, তাই ভোটকৌশল শেখাতে বৈঠক
এই পরিধির ব্যাপ্তির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুদীপ্ত কবিরাজ তাঁর ‘দ্য আনহ্যাপি কনশাসনেস’ গ্রন্থে (প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) লিখেছেন, যে এটাই হল কল্পনাপ্রসূত ইতিহাস (imaginary history) লেখার সুবিধা। ধ্যানধারণাগত অনির্ণেয়তা (Conceptual indeterminacy)-র বালাই সেখানে নেই। সুদীপ্ত কবিরাজ লিখেছেন, “Such writers use fuzziness of the community to give their audience a community which had not existed before, by gradually conceiving a community called the nation.” [এ ধরনের লেখকরা কৌম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা বজায় রাখেন যাতে সম্প্রদায়টির অস্তিত্ব সুসংজ্ঞাতভাবে অতীতে না-থাকলেও আস্তে আস্তে জাতির সংজ্ঞাটি অধিগত করে ফেলে।
আরও পড়ুন-আজ নামছে ডায়মন্ড হারবার, লিগের উদ্বোধনী ম্যাচে কিবুর দলের সামনে সাদার্ন
এক্ষেত্রে একটা বিষয়ের অনুল্লেখ আলোচনাটিকে অসম্পূর্ণ রাখতে পারে। সেটি হল, বঙ্কিমের জাতি বিষয়ক ধারণার পরিসরে মুসলমানকে স্থান না দেওয়া। এমন কথা কিছুতেই বলা যাবে না যে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর লেখায় মুসলমান শাসন (তুর্কি শাসন বা মুঘল শাসন)-কে বিদেশি শাসন বলে গণ্য করেননি। একথা বলাটাও অসঙ্গত নয় যে, বঙ্কিমের জাতি সংক্রান্ত ভাবনায় মুসলমানকে জায়গা দেওয়া নিয়ে সংশয় ও জটিলতা ছিল। আসলে বঙ্কিমের সমসমায়িক সব লেখকই শতাব্দীর পর শতাব্দী মুঘল শাসনকে পরাধীনতা বলেই গণ্য করে এসেছেন। এবং মুসলমান শাসকের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হয়ে হিন্দুদের লড়াইকে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ বলে গণ্য করে এসেছেন। তপন রায়চৌধুরীর ‘ইউরোপ রিকনসিডার্ড’ (প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)-এ এই ধারণা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র এক্ষেত্রে কোনও ব্যতিক্রম নন, এবং সম্ভবত ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার ইচ্ছাও তাঁর ছিল না।
আরও পড়ুন-ফের ট্রেন দূর্ঘটনা, এবার ঘটনাস্থল বাঁকুড়া
ঐতিহাসিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল জাতীয়তাবোধ জাগরণের অন্যতম উপায় হল কল্পিত ঐতিহাসিক বিষয়ের প্রতি জনমানসের মনোযোগ আকর্ষণ। অতীতের স্বর্ণযুগের সঙ্গে (যেটা বহুলাংশে কল্পিত কিংবা ঐতিহাসিক নথি কর্তৃক সমর্থিত নয়) বর্তমানের হতশ্রী দশার তুলনা করলে পরম্পরা ও ঐতিহ্যের প্রতি জনগণের একটা আস্থাবাচক আকর্ষণ তৈরি হয়, যেটা জাতীয়তাবাদের বিকাশে বড্ড কাজে লাগে। স্বর্ণালি অতীতের অংশীদার ছিলাম আমরা সবাই, এই বোধের জাগরণ ও বিস্তার জাতীয়বাদের অঙ্কুরকে সামর্থ্য দান করে।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় রেলের অমানবিকতা বেআব্রু হল বালাসোরে
বঙ্কিমচন্দ্র অনুভব করেছিলেন, হিন্দুরা কখনও অতীত নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, স্মৃতিকে লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। ফলে হিন্দুর কোনও ইতিহাস সার্থকভাবে গড়ে ওঠেনি। সেই ইতিহাস নির্মাণের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বঙ্কিম। তিনি বললেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী তাহাকেই লিখিতে হইবে।“ তিনিই জানালেন, “সাহেবেরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই।“
আরও পড়ুন-নির্জনতা ছড়িয়ে রয়েছে অক্ষরের ভাঁজে-ভাঁজে
এখানে লক্ষণীয়, ‘বাঙ্গালা’ ও ‘বাঙ্গালী’ এখানে ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘ভারতবাসী’র সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই যে ক্ষুদ্রর দর্পণে বৃহৎকে অবলোকন, এটাই বঙ্কিমী জাতীয়তাবাদের কাঠামো। নরসিংহ শীল যথার্থই দেখেছেন, বঙ্কিম যে কিংবদন্তি নির্ভর অতীত গৌরবগাথাকে ইতিহাস বলে চিনলেন ও চেনালেন, সেটা হিন্দুর অতীত (Hindu past)। ফলত, সেই ইতিহাসের নায়ক চরিত্ররা মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শহিদ হওয়া বাঙালি, মারাঠা, রাজপুত হয়ে রইলেন, তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়ত্বের ভাগিদার হতে পারল না।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ফের বিজেপিতে ভাঙন, উন্নয়নের প্রচার গ্রাম থেকে গ্রামে, বাংলা জুড়ে তৃণমূল ঝড়
পার্থ চ্যাটার্জি তাঁর ‘ন্যাশনালিস্ট ডিসকোর্স অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড: আ ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স’ (প্রকাশক জেড বুকস, লন্ডন) বইতে দেখিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ভারতীয়দের পরাধীনত্বর কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে শনাক্ত করেছিলেন। এক, ভারতীয়রা স্বভাবগতভাবে স্বাধীনতাকামী নয়। শাসক যদি কিছুটা হলেও অনুকূলে থাকে, যদি শাসকের আচরণে নির্যাতন, অত্যাচার ও প্রতারণার বহিঃপ্রকাশ তীব্র ভাবে না-ঘটে, তবে, বঙ্কিমের মনে হয়েছিল, ভারতীয়রা (কিংবা, বলা ভাল, ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুরা) স্বাধীন না পরাধীন তা নিয়ে বেশি একটা মাথা ঘামায় না। তারা মনে করে, স্বাধীনতা লাভের হ্যাপায় না গিয়ে পরাধীন থেকে সুখী জীবন কাটানোই শ্রেয়। এজন্যই তিন সহস্র বছর ধরে সংখ্যাগুরু ভারতীয়র মনে স্বাধীনতা স্পৃহা জাগ্রত হয়নি। দুই, হিন্দুদের মধ্যে ঐক্যবোধের অভাবও তাদের পরাধীনত্ব দান করেছিল বলে মনে হয়েছিল বঙ্কিমের। এক্ষেত্রে কেবল ঐক্যচেতনা নয়, ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখার প্রবণতাও স্বাধীনতা-আকাঙক্ষা উজ্জীবিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা রচনা করেছে বলে অনুভব করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রধানত এই দুই কারণের প্রাবল্যেই বাঙালি বা হিন্দু বা বৃহত্তর অর্থে সমগ্র ভারত কখনও স্বাধীনতার খিদেটা টের পায়নি। এটা বঙ্কিমের অনুভব। যেখানে ইউরোপীয়রা সংস্কৃতিগতভাবে ক্ষমতার ক্ষুধায় তাড়িত, সেখানে ভারতীয় চেতনা সাংখ্যে বর্ণিত বৈরাগ্য-দর্শনে মোহিত।
আরও পড়ুন-এটাই কি গণতন্ত্র?
১৮৬৪-তে আবির্ভূত হল কার্ল মার্ক্সের ‘ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল’। রাশিয়ায় শিক্ষিত যুবকরা বিপ্লবী ভাবধারায় আকৃষ্ট হতে শুরু করল। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জেলা ও প্রাদেশিক পরিষদ গঠনকে স্বীকৃতি দান করলেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে ফেললেন ‘বীরবাহু’। এই সময়েই বঙ্কিমচন্দ্র বদলি হয়ে এলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর মহকুমায়। হাতে এল ‘বীরবাহু’। উপ্ত হল স্বদেশপ্রেমের বীজ।
১৮৬৫তে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেমে গেল। প্রকাশিত হল মিলের Comte and Positivism। এই সময় কাঁঠালপাড়ায় চট্টোপাধ্যায় পরিবারে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ চরমে উঠল। সম্পত্তি ভাগাভাগি হল। বঙ্কিম বঞ্চিত হলেন। এসব তাঁকে বেশ কষ্ট দিয়েছিল।
আরও পড়ুন-এবছর সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেলেন বাংলার তিন লেখক
১৮৬৬-তে বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানির একীভবনের প্রয়াস দেখা গেল। অস্ট্রিয়া আর এশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। রাশিয়াতে জার আলেকজান্ডারকে প্রাণে মারার চেষ্টা করল বিপ্লবীরা। দেশে তখন দেখা দিল ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ ওড়িশায়। সেখানে সেবা ও ত্রাণকার্যের জন্য এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগর, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ। স্বদেশ ও বিদেশের এসব ঘটনা বঙ্কিমচন্দ্রের নজর এড়ায়নি।
১৮৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত হল চৈত্র মেলা বা হিন্দুমেলা। প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্র। ১৮৬৮-তে কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা শুরু করলেন নগর সংকীর্তন। ‘এতদিনে দুঃখের নিশি হল অবসান, নগরে উঠিল ব্রাহ্মনাম’, এই গানে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক।
আরও পড়ুন-বুমরাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো নয়, সতর্ক করলেন শাস্ত্রী
ওদিকে যশোহর থেকে শিশিরকুমার ঘোষ প্রকাশ করতে শুরু করলেন অমৃতবাজার পত্রিকা। আর ইউরোপে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘Subjection of Women’ নারী স্বাধীনতার ধ্বজা তুলে দিল। এই ঘটনাগুলোও ছাপ পড়েছিল বঙ্কিম-মানসে। অনেকে বলেন, ‘Subjection of Women’-এর ছায়া পড়েছিল ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের শান্তিচরিত্রে।
১৮৭০-এ ফ্রান্সের সঙ্গে এশিয়ার যুদ্ধ বেধে গেল। ওদিকে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণে আয়ার্ল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হল হোমরুল লিগ। ইতালি গর্জে উঠল পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু হল সেদেশে। স্বদেশের সাঁওতাল পরগনায় তখন কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এরই মধ্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে ফেললেন ‘ভারত সঙ্গীত’। বঙ্কিমচন্দ্র ততদিনে এসে গিয়েছেন বহরমপুরে। তাঁর মনোলোকে জাতীয়তাবোধ তখন পল্লবিত।
আরও পড়ুন-বিকেল থেকেই পরিবর্তন আবহাওয়ার, বৃষ্টি কখন
১৮৭১। প্যারী কমিউন তৈরি হল, আবার ভেঙেও গেল। নতুন জার্মান সাম্রাজ্য তখন প্রতিষ্ঠার পথে। এই সময়েই বিদেশে প্রকাশিত হল চার্লস ডারউইনের ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ এবং স্বদেশে বিদ্যাসাগরের ‘বহু বিবাহ’। আর পরের বছরেই প্রকাশিত হল হার্বাট স্পেনসরের প্রিন্সিপলস অব সাইকোলজি’। বঙ্কিম আধুনিক ভাবনার আঁচ পেতে শুরু করলেন।
এল ১৮৭৩। এল ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বা দেশীয় সংবাদপত্র আইন। এই আইনের বিরুদ্ধে মত জ্ঞাপন করলেন বঙ্কিম।
আর এসবের মধ্যেই, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ঘটে গেল সেই ঘটনা।
আরও পড়ুন-মণিপুরে আগুন মন্ত্রীর গুদামে
বঙ্কিমচন্দ্র তখন বহরমপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে পালকি চেপে আসছিলেন মাঠের ভেতর দিয়ে। রোজকার মতো। মাঠে তখন ক্রিকেট খেলছিল গোরা সৈন্যের দল। তাদের পান্ডা কর্নেল ডাফিন বঙ্কিমচন্দ্রকে অপমান করতে উদ্যত হলেন। বঙ্কিমকে তিনি ফিরে যেতে বলেছিলেন। বঙ্কিম সে কথা-না শোনায় ডাফিন পালকি থেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে নামতে বাধ্য করলেন। অপমান করলেন। বঙ্কিম উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে বললেন, দেখলেন তো, কী হল, কেমন বেয়াদপি। জজ বেনব্রিজ বললেন, অত দূরে কী হচ্ছে, দেখতে পাইনি। কিন্তু রেভারেন্ড বার্লো, লালগোলার মহারাজ যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়, দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য, রবার্ট হ্যান্ড প্রমুখ বললেন, যা যা হয়েছে, সব তাঁরা দেখেছেন। পরদিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইন্টারের এজলাসে মামলা রুজু করলেন বঙ্কিমচন্দ্র। জজ সাহেব ডাফিনকে ডেকে পাঠালেন। বহরমপুর কোর্টের সব উকিল মোক্তার বঙ্কিমচন্দ্রর ওকালতনামায় সই করেছিলেন। ফলে, বাধ্য হয়ে কর্নেল ডাফিন তাঁর হয়ে মামলা লড়ার জন্য কৃষ্ণনগর থেকে উকিল আনতে বাধ্য হলেন।
আরও পড়ুন-সাফের শেষ চারে সুনীলরা
৮ জানুয়ারি, ১৮৭৮-এর অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হল, “We are grieved to learn… that Babu Bankim Chandra Catterjee, the Dy. Magistrate, while returning home from office on the 15th December last, was assaulted by one Lt. Colonel Duffin on the Berhampore cantonment, and received several violent pushes at his hands… the Babu was brought a criminal case against his aggressor and if has caused as it ought great sensation in Berhampore.”
সোজা কথায়, বঙ্কিমের রুজু করা মামলা ও বহরমপুর আদালতে ব্যবহারজীবীদের অবস্থান, শহরে প্রভূত উত্তেজনার সঞ্চার করে।
ক’দিন পর ১৫ জানুয়ারি ওই পত্রিকাতেই ফলাও করে লেখা হল, বিচারকের নির্দেশে কর্নেল ডাফিন প্রকাশ্য আদালতে হাজার হাজার লোকের সামনে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন।
এরই দশ বছরের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী থেকে একে একে বের হল ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৮৮৪) এবং ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬)।এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৪)।
আরও পড়ুন-মালদহের কনিষ্ঠ প্রার্থী এবার মঙ্গলী
এই ‘ধর্মতত্ত্বে’ই বঙ্কিম তুলে ধরলেন অনুশীলন বিষয়ক ধারণা। অনুশীলনের মূলে আছে ভক্তি। জ্ঞান ও কর্তব্য, এই দুই ধারায় এটি বিভক্ত। ভক্তি সকল মানবকে ঈশ্বরমুখী করে তোলে। বঙ্কিম বললেন, পশ্চিমে গণিত, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জ্ঞান পেতে হলে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুশীলনকারী হলে সেসবের আবশ্যকতা হয় না। পাশাপাশি বাংলা মাধ্যমে ওইসব বিষয় অধীত হলে যুগপৎ দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির গৌরব বৃদ্ধি পাবে। এবং গ্রাম-বাংলায় অশিক্ষিতের হার হ্রাস পাবে।
উল্লিখিত উপন্যাসসমূহ এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ ও ‘কৃষ্ণচরিত্রের’ সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্র যে জাতি আভাসিত করলেন সেই জাতি মূলত পুরুষ, আরও স্পষ্ট করে বললে, উচ্চবর্ণের পুরুষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। তানিকা সরকার তাঁর ‘হিন্দু ওয়াইফ, হিন্দু নেশন: কমিউনিটি, রিলিজিয়ন অ্যান্ড কালচারাল ন্যাশনালিজম’ (প্রকাশক পার্মানেন্ট ব্ল্যাক) গ্রন্থে এই কথা ব্যক্ত করেছেন।
আরও পড়ুন-উন্নয়নের স্লোগানে প্রচার
‘লোকরহস্য’ এবং ‘কমলাকান্তর দপ্তর’-এর বিভিন্ন প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনের অসারতা নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করেছেন। এই সকল প্রবন্ধেই তিনি ধর্ম ও রাজনীতির পুরোদস্তুর বিচ্ছেদের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বলেছেন, ইউরোপে ধর্ম শান্তিপ্রিয়, নম্র, ক্ষমাশীল কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে গান্ধর্ব বিবাহের সূত্রে তা হিংস্রতার জন্মদাতা। এমনটা ভারতের ক্ষেত্রে হতে বাধ্য যদি ভারতও ইউরোপ অনুসারী হয়। তা না করে, যদি প্রত্যেক হিন্দু আপন আপন ধর্ম বা কর্তব্য পালনে উৎসাহী হয়, তবে সমাজ মসৃণভাবে অগ্রসর হবে। আনন্দমঠে তিনি সেটাই দেখিয়েছেন। কৃষ্ণচরিত্রে তিনি সেটাকেই তুলে ধরেছেন। নৈতিকতার প্রশ্নে বঙ্কিমের কোনও আপসকামিতা ছিল না। তাই তিনি ত্যাগ, আত্মোৎসর্গ এবং আত্ম বিসর্জনকে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গ হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বৈরাগীরাই জাতীয়তাবাদী বঙ্কিমের দৃষ্টিতে প্রকৃত রাজনীতিক, আসল যোদ্ধা। দেশপ্রেম এই আবহে, বঙ্কিমী জাতীয়তাবাদের সৌজন্যে একটা আলাদা ধর্ম।
আরও পড়ুন-প্রচারে প্রার্থীদের গাড়ি ব্যবহার নিয়ে নির্দেশিকা
বঙ্কিম এই ধর্মের দেবতার জন্য মন্ত্র রচনা করলেন। সেই মহামন্ত্র হল ‘বন্দেমাতরম’। দেশ আর মা-কে এক করে দিয়ে তিনি জাতীয়তাবাদকে ভিন্ন স্তরে পৌঁছে দিলেন। আবেগের ছোঁয়ায়, মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, পৃথগীকরণের প্রয়োজন, বিদ্বেষ-বিভেদের সমীকরণ তুচ্ছতা, গৌণতা অর্জন করল।
তাই, তাই-ই অরবিন্দ লিখেছেন বন্দেমাতরম মন্ত্র রাতারাতি গোটা জাতিকে স্বদেশধর্মে (religion of patriotism) দীক্ষিত করেছিল।
“ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” আনন্দমঠ-এর এই উক্তিটিকে আশ্রয় করে কোনও হিন্দু সাম্প্রদায়িক বা ইসলামি মৌলবাদী বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে এগোতে চান কিংবা সেটাকে নস্যাৎ করে দিয়ে আপন উদেশ্য পূরণ করতে চান, তবে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া আবশ্যক যে ‘আনন্দমঠ’-এর পটভূমি হল ১৭৭২-এর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ফের বিজেপিতে ভাঙন, উন্নয়নের প্রচার গ্রাম থেকে গ্রামে, বাংলা জুড়ে তৃণমূল ঝড়
১৭৬৪তে বক্সারের যুদ্ধের পর মিরজাফর ফের বাংলার মসনদে বসলেন। তাঁর দেওয়া দেওয়ানির সুবাদে বিনা শুল্কের বাণিজ্যের যথেচ্ছাচার শুরু করল ইংরেজরা। এই আবহে দেখা দিয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। সেই অবস্থায় একদল সন্ন্যাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করার জন্য হিন্দু পৌত্তলিকতাকে আশ্রয় করেছিল। রাষ্ট্রে তখন যদি হিন্দুশক্তি থাকত আর সন্ন্যাসীদের জায়গায় কোনও সুফিসাধক বা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিপ্লবী যদি “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি তুলে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নামতেন, তাহলে মন্বন্তরের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা হিন্দুরা বোধ করি আপত্তি করতেন না।
আরও পড়ুন-দিনে ও রাতে বিদ্যুৎ খরচ আলাদা হচ্ছে
রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, “the greatest moral of ‘Ananda Math’, then, is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to Mussalman oppression.”
আজকের অসহিষ্ণুতার আবহে, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধেও এই একই কথা বলা যেতে পারে, যেতেই পারে।
সেটাই বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী ভাবনার শিক্ষা। এইটুকু মনে রাখলে ভাল হয়।