প্রথম এবং শেষ সুযোগ
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। অসামান্য এই ছবির অভিনেতাদের নিয়ে নতুন একটি ছবির পরিকল্পনা করছিলেন গৌতম ঘোষ। নাম ‘আবার অরণ্যে’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর সম্মতি দিয়েছিলেন। চিন্তা ছিল ‘হরি’র চরিত্রের অভিনেতাকে নিয়ে। কারণ তখন সেই অভিনেতা ক্যানসারে আক্রান্ত। কিন্তু তাঁকে ছাড়া কীভাবে হবে এই ছবি? পরিচালক পড়লেন মহা সমস্যায়। একদিন তিনি গেলেন অভিনেতার কাছে। দারুণ বন্ধুত্ব দু’জনের। তবে একসঙ্গে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। এটাই হয়তো প্রথম এবং শেষ সুযোগ। ‘আবার অরণ্যে’র পরিকল্পনার কথা জানালেন গৌতম ঘোষ। গুরুতর অসুস্থ অভিনেতা ছেলেমানুষের মতো লাফিয়ে উঠলেন, ‘‘ফ্যানটাসটিক। আমি করব ছবিটা।’’
আরও পড়ুন-রবিবারের গল্প: জানালা
তিনি শমিত ভঞ্জ। বাঙালির অন্যতম পছন্দের অভিনেতা। মনের জোর ছিল সাংঘাতিক। পরিচালকের কথা শুনে তিনি হয়ে পড়েছিলেন স্মৃতিমেদুর। সেই গভীর অরণ্য, গাছ ও মাটির মাতাল-করা গন্ধ, সবুজের কোলে তুমুল আড্ডা— লোভ সামলাতে পারেননি। দ্বিতীয়বার তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল ছটফটে ডাকাবুকো হরি। শ্যুটিং-পর্বে ছিল বেড়ানোর মেজাজ। শারীরিক কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে ছবির কাজ শেষ করেছিলেন শমিত। ফ্লোরে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। শেষে কাঁদিয়েওছিলেন।
আরও পড়ুন-গণদেবতার লেখক তারাশঙ্কর
হলিউড তারকাদের সঙ্গে মিল
শমিত ভঞ্জের অভিনয়-জীবনে ছিল তপন সিংহের বড় ভূমিকা। তপন সিংহ তখন নামী পরিচালক। তাঁর বেশকিছু ছবি উচ্চ প্রশংসিত। ‘ঝিন্দের বন্দি’তে উত্তমকুমার এবং সৌমিত্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। টলিপাড়ায় তাঁকে রীতিমতো সমীহ করা হত। তাঁর ঘরেই একদিন দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েন রোগা ছিপছিপে চেহারার শমিত, ‘‘আমি অভিনয় করতে চাই।’’
অচেনা যুবকের সাহস দেখে তপন সিংহ অবাক। তবে মানুষ চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। তিনি শমিতকে কাজ দিয়েছিলেন নিজের ছবিতে। ধীরে ধীরে শমিত হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ছবির গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা। তাঁকে কেউ কেউ আধুনিক নায়ক মনে করতেন। আশ্চর্য মিল ছিল হলিউড তারকাদের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-মাতৃভাষাতেও পঠনপাঠন সিবিএসইতে
গাইতেন, তবলা বাজাতেন
জন্ম ১৯৪৪ সালের ২ জানুয়ারি। অবিভক্ত মেদিনীপুরের তমলুক শহরে। বাবা প্রীতিময় ভঞ্জ এবং মা শীলাদেবী। পড়াশোনা শুরু জামশেদপুরের লয়েলা স্কুলে। পরে ভর্তি হন তমলুকের হ্যামিলটন হাইস্কুলে। ভাইবোনেরা সকলেই গাইতে পারতেন। নিজের চেষ্টায় গান শিখেছিলেন শমিত। চমৎকার ছিল তবলার হাত। তালিম নিয়েছিলেন কেরামতুল্লার কাছে।
আরও পড়ুন-লড়াই করছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ভিড়ের দৃশ্যে অভিনয়
ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। স্কুলে এবং পাড়ার নাটকে অভিনয় করতেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছে। পলিটেকনিকের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই শমিত কলকাতায় চলে আসেন। ইতি টানেন পড়াশোনায়। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক। এই নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপোড়েন ছিল। শেষে তিনি মহানগরীর বুকে পা রাখেন বাবার অমতে, ঝগড়া করে। কলকাতায় এসে সবিতাব্রত দত্তর দলে নাম লেখান। অভিনয় করেন কয়েকটি নাটকে। তারপর স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাঘুরি। একদিন জুটে যায় কাজ। ভূমেন রায়ের ‘নিশাচর’ ছবিতে। দাঁড়াতে হয়েছিল ভিড়ের মধ্যে। একটা স্যুট পরেছিলেন বলে পেয়েছিলেন অন্যদের তুলনায় বেশি খাতির। তারপর ‘বাদশা’ ছবিতে। আবারও ভিড়ের দৃশ্যে। তারপর সোজা তপন সিংহের কাছে। তপন সিংহ তাঁকে প্রথমে ‘হাটে বাজারে’ ছবিতে ছোট্ট চরিত্রে সুযোগ দিয়েছিলেন। একজন মোটর মেকানিকের চরিত্র। সেই ছবিতে অশোককুমার এবং বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে সাবলীল অভিনয় করেছিলেন।
আরও পড়ুন-জেলার প্রথম বায়োডাইভারসিটি পার্ক গড়া হবে সুতিতে
চরিত্রের নাম ছেনো
শমিত ভঞ্জকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছিল তপন সিংহর ‘আপনজন’। চরিত্রের নাম ছেনো। যেটা তাঁর অভিনয়ের গুণে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি আইকনিক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মিনার, বিজলি, ছবিঘর ও রাধা সিনেমায় ‘আপনজন’ মুক্তি পায়। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর। ছবিটি সাফল্য পেলেও খুব একটা লাভ হয়নি শমিতের। দীর্ঘদিন ছিলেন কর্মহীন। কোনও প্রযোজক বা পরিচালক তাঁকে সুযোগ দেননি। তবে পেয়েছেন সাধারণ মানুষের ভালবাসা। পরবর্তী সময়ে কাজ পেতে তাঁকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ তখন খ্যাতির মধ্যগগনে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নির্মাতারা আগে এঁদের কথাই ভাবতেন। তারপর বাকিরা। তবে হাল ছাড়েননি শমিত। লড়াই চালিয়ে গেছেন। অবশেষে আদায় করে নিয়েছেন সম্মান। অনেকেই স্বীকার করেন, তাঁর মধ্যে দ্বিতীয় উত্তমকুমার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। ভুল সময়ে এসেছিলেন বলে সেটা আর হল না।
আরও পড়ুন-করমণ্ডল দুর্ঘটনার দায় রেল কর্মীদের ঘাড়ে চাপালেন রেলমন্ত্রী
মানিকদা খুঁজছেন
শচীন অধিকারীর ‘শপথ নিলাম’ ছবিতে অভিনয় করছিলেন শমিত। শ্যুটিং চলাকালীন একদিন রবি ঘোষ তাঁকে খবর দিলেন, ‘‘মানিকদা তোকে খুঁজছেন।’’
মানিকদা মানে সত্যজিৎ রায়! প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। কোথায় থাকেন তা-ও জানেন না। রবি ঘোষ বললেন, ‘‘সত্যিই তোকে খুঁজছেন। দেখা কর মানিকদার সঙ্গে।’’
সত্যজিতের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তখনই শুরু হয় শমিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র জার্নি। সত্যজিৎ রায় তাঁকে ‘হরি’র চরিত্রে নির্বাচন করেন। রাতারাতি শমিতের কদর বেড়ে যায় টলিপাড়ায়। এমনিতে ডাকাবুকো, বেপরোয়া। তবে সিমির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয়ের আগে শমিত রীতিমতো নার্ভাস। সত্যজিৎ রায় তাঁকে দেখিয়ে, বুঝিয়ে দেন। ছবির তিন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ। শমিত-সিমির অন্তরঙ্গ দৃশ্যের শ্যুটিং কেমন হল, জানতে চান পরিচালকের কাছে। সত্যজিৎ রায় তাঁদের বলেন, ‘‘ছেলে খুব চালু। যা দেখিয়েছি তার চেয়ে বেশি করেছে!’’
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনায় মৃত ১৭
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। শমিত-অভিনীত ‘হরি’র চরিত্র দারুণ ভাবে সমাদৃত হয়।
বেকার অবস্থায় বিয়ে
বিয়ে করেছিলেন ভালবেসে। স্ত্রী রঞ্জা শমিতের গলায় মালা দিয়েছিলেন কলেজে পড়তে পড়তে। শমিত তখন বেকার। তবে কেউ কারও হাত ছাড়েননি। দুই পরিবারের আপত্তি খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল। রঞ্জার উপর বিরাট নির্ভরতা ছিল শমিতের।
মহানায়কের মৃত্যুদিনেই
অভিনয় করেছেন ‘রূপসী’, ‘জননী’, ‘আটাত্তর দিন পরে’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘গণদেবতা’ প্রভৃতি জনপ্রিয় বাংলা ছবি এবং হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘গুড্ডি’তে। ‘গুড্ডি’র পর আরও তিনটি হিন্দি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। যেমন ‘ওহি রাত ওহি আওয়াজ’, ‘অনজানে মেহমান’ ও ‘কিতনে পাস কিতনে দূর’। ফুটিয়ে তুলেছেন নানা ধরনের চরিত্র। তাঁর অভিনয়ধারা ছিল স্বতন্ত্র। লেগে থাকত অদ্ভুত সারল্য।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘আবার অরণ্যে’। শমিত-অভিনীত শেষ ছবি। যদিও ছবির সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। ওই বছর ২৪ জুলাই না-ফেরার দেশে চলে যান। ১৯৮০-র যে-দিন প্রয়াত হয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার।
দুই দশক হল তিনি নেই, তবু আজও চলচ্চিত্র আড্ডায় ওঠে ‘ছেনো’, ‘হরি’র প্রসঙ্গ। এইভাবেই সিনেপ্রেমীদের মনে আজও বেঁচে আছেন শমিত ভঞ্জ। থাকবেন আগামী দিনেও।