সিরোসিস আসলে কী
সিরোসিস রোগে আমাদের লিভার ততটা কাজ করে না যতটা তার কাজ করা দরকার। ক্রমাগত প্রদাহের ফলে লিভারে কার্যকরী কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সেইসব কোষের সংখ্যা এবং কার্যক্ষমতা দুই-ই হ্রাস পায়। মদ্যপায়ী যদি অভ্যেস বদল না করে আরও অতিরিক্ত মদ্যপান করে, যদি খুব স্থূল ব্যক্তি ওজন কমানোর চিন্তা না করে এমন লাইফস্টাইল লিড করে যে ওজন বেড়ে চলে, সেক্ষেত্রে সিরোসিসের সম্ভাবনা একশো শতাংশ বেড়ে যায়। লিভার খুব নমনীয় স্পঞ্জের মতো একটি বস্তু, সেটি রোগগ্রস্ত হলে ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায় তার কারণ এর ভিতরে তন্তুকলা বৃদ্ধি পায়। ফলে লিভারের অন্তস্থ রক্তবাহী নালিগুলো বিকৃত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-আদালত থেকে ফেরার পথে আসামিকে হত্যা, আইনজীবীর ওপর হামলা
শরীরের রক্ত লিভারে পৌঁছনোর সহজ পথে বাধা পেয়ে কিছু ঘুরপথে যাওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে শরীরের কিছু অংশে কিছু রক্তবাহী নালিকা ফুলে ওঠে। যখন পাকস্থলী এবং খাদ্যনালির সংযোগস্থলে রক্তবাহী নালিকা ফুলে ওঠে তাকে ভ্যারিক্স বলে। এই ভ্যারিক্সে রক্তের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা কম, যে কারণে এটি খুব কম চাপেই ফেটে যায়। তখন রোগীর রক্তবমি বা মলের সঙ্গে রক্ত বেরোতে শুরু করে। এই সময় রোগীর অবস্থা সংকটজনক হয়। সুস্থ লিভার আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করতে নানা পদার্থ তৈরি করে কিন্তু লিভারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেলে রোগীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দেহে বাসা বাঁধে অনেক ধরনের জীবাণু। লিভারের ক্ষতি হলে অ্যালবুমেন এবং অন্যান্য আরও প্রোটিন তৈরি হওয়া কমে যায়। ফলে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। কাজেই এই রোগটি ঠিক সময় ধরা পড়া খুব জরুরি তবেই উপযুক্ত চিকিৎসায় লিভারকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
আরও পড়ুন-‘জওয়ান’ মুক্তির আগে মেয়েকে নিয়ে তিরুপতি মন্দিরে শাহরুখ খান
সিরোসিস একদিনের ঘটনা নয়
সিরোসিস কখনও একদিনে হয় না। বহুদিন ধরে প্রদাহ থাকার ফলে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে লিভার। সমস্যার হল এর সিম্পটম অনেক দেরিতে আসে। এই লম্বা একটা সময় যখন লিভারটা ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু বোঝা যায় না। বাইরে থেকে সবটা স্বাভাবিক দেখায়। রোগের এই পর্যায়টাকে বলা হয় কম্পেনসেটেড সিরোসিস। অন্য কোনও রোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে আচমকা ধরা পড়ে যায় তাই সবসময় লিভার নিয়ে সচেতন থাকা জরুরি। যাঁর ফ্যাটি লিভারের সমস্যা আছে বা আগে হয়েছিল এখন সেরে গিয়েছে, তাঁর অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে লাইফস্টাইল নিয়ে।
সিরোসিসের লক্ষণ
পেট ফুলে যাওয়া, পেটে জল হওয়া।
পা ফুলে যাওয়া।
রক্তবমি, রক্তযুক্ত মল বা ব্ল্যাক স্টুল।
ঘুম না হওয়া, মানসিক পরিবর্তন।
ঘোর ঘোর ভাব।
শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)।
আরও পড়ুন-কসবার স্কুলে ছাত্রমৃত্যুতে খুনের মামলা হল অধ্যক্ষ সহ ৪ জনের বিরুদ্ধে
কেন হয় সিরোসিস
আধুনিক জীবনযাত্রা এবং খাওয়া-দাওয়া সিরোসিসের প্রধান কারণ। অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, চর্বিযুক্ত ভাজা পোড়া, দোকানের খাবার ইত্যাদি খেতেই পছন্দ করেন বেশিরভাগ মানুষ। এর থেকে অনেকের হয় অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ। মদ্যপানে এখন নারী-পুরুষ উভয়ই অভ্যস্ত। উৎসব অনুষ্ঠান মানেই মদ্যপান। এগুলো সিরোসিসের অন্যতম কারণ।
এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হল ওজন অত্যধিক বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ স্থূলতা।
মধুমেহ বা ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে সিরোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি দুটোই সিরোসিসের অন্যতম কারণ। এছাড়া বিরল কিছু কারণেও সিরোসিস অফ লিভার হয়।
আরও পড়ুন-উৎসবের মরশুম জুড়ে কি এবার শুধুই পদ্মার ইলিশ?
সিরোসিসের চিকিৎসা
ইতিমধ্যেই আমরা জানলাম যে কী কী কারণে সিরোসিস অফ লিভার হয়। এবার আমরা জানব এর চিকিৎসা। সিরোসিসের চিকিৎসার প্রথম শর্তই হল, কারণটা খুঁজে বের করা। যদি শুরুতেই রোগটির কারণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে চিকিৎসা সহজ হবে অর্থাৎ কষ্টসাধ্য, দুরূহ চিকিৎসা এড়ানো সম্ভব হবে। সহজ ভাষায় বললে, ইদানীং হেপাটাইটিস বি আর হেপাটাইটিস সি আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে সারানো সম্ভব। আর স্থূলতা, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত লিভারের প্রচলিত সমস্যা জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রণে এনে ওষুধের দ্বারাই রোগীকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন-শিক্ষক দিবসে কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী
কিন্তু রোগ যদি ডিকম্পেনসেট অবস্থায় ধরা পড়ে অর্থাৎ পেটে জল জমা, রক্ত বমি বা ব্ল্যাক স্টুল ইত্যাদি শুরু হয়ে গিয়ে থাকে তবে চিকিৎসা দুরূহ হবে। রোগী চিকিৎসায় সাড়া নাও দিতে পারে। ডিকম্পেনসেট রোগীর ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক, কিডনি থেকে শুরু বেশ কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডিকম্পেনসেট সিরোসিস রোগীর লিভারের সঙ্গে এই অরগ্যানগুলোও অকেজো হতে শুরু করে দেয় আগে থাকতেই। এই অবস্থায় কিছু মেডিকেশনে রোগীকে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। চিকিৎসক এমন ওষুধ দেন যার মাধ্যমে অতিরিক্ত জল মূত্রাকারে বেরিয়ে যায়। তবে এই ওষুধ যেমন উপকারী আবার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খেলে হতে পারে মারাত্মক বিপদ। হয়ে যেতে পারে কিডনির গোলমাল, সোডিয়াম, পটাশিয়ামের তারতম্য, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। যতটা সম্ভব কম ওষুধে এই রোগের চিকিৎসা করা উচিত।
আরও পড়ুন-মোদি-ঘনিষ্ঠ হরিশ সালভের বিয়ের অতিথি পলাতক ললিত মোদি!
লিভার প্রতিস্থাপন কখন
ডিকম্পেনসেট সিরোসিস সারানোর সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হল লিভার প্রতিস্থাপন। তবে এটি কিন্তু খুব সহজ অপারেশন নয়। জটিল শল্য চিকিৎসা। তাই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না আবার ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলেও চলবে না। এই অপারেশনে কমজোরী লিভার সরিয়ে নতুন উন্নত লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। অপারেশনের পর রোগীকে বেশ কিছুদিন মেডিকেশনের মধ্যে থাকতে হয় যতদিন না লিভার আবার কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এই অপারেশন বেশ ব্যয়বহুল। তাই ভাল করে ভেবে নেওয়া জরুরি। রোগীর শরীর-স্বাস্থ্য ভাল হলে, বয়স খুব বেশি না হলে লিভার প্রতিস্থাপন সফল হওয়া সম্ভব। কাজেই বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ বিবেচ্য।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালকে রাজ্য সরকার, বেআইনি সার্কুলার এখনই প্রত্যাহার করুন
লিভার প্রতিস্থাপন দু’ধরনের হয়
জীবিত ব্যক্তির লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন
মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে এমন রোগীর লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন।
তবে জীবিত ব্যক্তির লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে রোগীর পরিবার বা আত্মীয় তাঁর লিভারের অংশ নিয়ে দান করতে পারেন।
দাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ এক হতে হবে। দাতার বয়স ১৮ থেকে ৫৫-র মধ্যে হতে হবে। তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে।
লিভার প্রতিস্থাপনের আগে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবশ্যিক।
জীবিত ব্যক্তির লিভার দানে রিস্ক
প্রশ্ন আসতে পারে, যিনি লিভার দান করছেন তারপর তাঁর কী হবে। আসলে দাতার লিভারের কিছুটা অংশই নেওয়া হয়, পুরোটা নয়। যেহেতু লিভার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় সেহেতু দাতার লিভার প্রতিস্থাপনের দু’মাসের মধ্যে আবার পুরনো কর্মক্ষমতায় ফিরে আসে। দাতাকে দু’সপ্তাহের মধ্যে ছুটি দেওয়া হয়।
মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে এমন রোগীর লিভার নিতে হলে তাঁর পরিবারের আত্মীয়স্বজনের অনুমতি প্রয়োজন।