ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল-সহ এই উপমহাদেশ এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর পালিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। বাঙালির এই চিরাচরিত পার্বণ উদযাপন বহু বছর ধরে হয়ে আসছে ওপার বাংলাতেও। বাংলাদেশে প্রথম কবে দুর্গাপুজো শুরু, তা নিয়ে যদিও নানা মতভেদ রয়েছে। একাংশের মতে, ১৫ শতকে বর্তমান সিলেটের (শ্রীহট্টের) রাজা গণেশ প্রথম দুর্গাপুজো করেন। তবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য নেই। তবে বহু গবেষকের বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, রাজশাহীর তাহেরপুরেই রাজা কংসনারায়ণ দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটান।
আরও পড়ুন-আজ টিমগেমেই আস্থা সুনীলের, সৌদির খেলার ভিডিও দেখে স্ট্র্যাটেজি তৈরি স্টিমাচের
তাহেরপুর কংস রাজার মন্দির:
কালের সাক্ষী এখন বারনই নদী। এই নদীর তীরেই বহু বছর আগে গড়ে ওঠা জনপদের নাম তাহেরপুর। তাহেরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলির মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে জায়গাটি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার একটি পুরসভা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তাহেরপুরেই সর্বপ্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন রাজা কংসনারায়ণ রায় বাহাদুর। একসময় তাহেরপুরে বসেই রাজ্য পরিচলনা করতেন রাজা কংসনারায়ণ ও তাঁর পরবর্তী রাজা-জমিদাররা।
১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে (৮৮৭ বঙ্গাব্দ) তাহেরপুরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা কংসনারায়ণ। কথিত আছে, অসুরের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা। বলা হয়, এরপর থেকেই এই উপমহাদেশে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু।
আরও পড়ুন-হাতছানি দেয় সাতকোশিয়া
কে ছিলেন রাজা কংসনারায়ণ?
রাজা কংসনারায়ণ ছিলেন বাংলার ১২ ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া। তাঁর আদিপুরুষ ছিলেন মৌনভট্ট। আর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামন্ত রাজা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত কংসনারায়ণ রায়। তিনি সুলতানি আমলে চট্টগ্রামে মগ দমনে বীরের ভূমিকা পালন করেন। পাঠান আমলে কিছুদিন ফৌজদারের দায়িত্বও পালন করেন। মুঘল আমলে কিছুকাল বাংলা-বিহারের অস্থায়ী দেওয়ান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে নজির হয়ে থাকল বাংলার পর্যটন
বাংলা মুঘলদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলে সম্রাট আকবর রাজা কংসনারায়ণকে সুবে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। কিন্তু যথেষ্ট বয়স হওয়ায় তিনি দেওয়ানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তাহেরপুরে ফিরে ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সমসাময়িক বাংলার হিন্দু সমাজে তিনি ছিলেন অতি সম্মানীয়। শোনা যায়, হিন্দু সমাজের মধ্যমণি হয়ে থাকার মনোবাসনা নিয়ে নিজের পরগনার শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের মত জানতে চেয়ে তিনি একটি সভা ডেকেছিলেন। তাঁর ইচ্ছার কথা শুনে তৎকালীন পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী রাজাকে বলেছিলেন, বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ— এই চারটি মহাযজ্ঞ নামে কথিত। প্রথম দুটি কেবল সার্বভৌম সম্রাটরা করার অধিকারী এবং পরের দুটি কলিযুগে নিষিদ্ধ। আপনার পক্ষে দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনও মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নেই। এই যজ্ঞ সব যুগের মানুষ করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সেই সভায় সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর এই মতে সমর্থন দিলেন। এরপর ১৬ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা কংসনারায়ণ সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন করলেন। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে তাহেরপুরের দুর্গা মন্দিরে। যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি নিজেই।
আরও পড়ুন-আজ টিমগেমেই আস্থা সুনীলের, সৌদির খেলার ভিডিও দেখে স্ট্র্যাটেজি তৈরি স্টিমাচের
ত্রেতাযুগে স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে এই পুজো করেছিলেন।
রাবণ বধে রামের অকালবোধনের মাধ্যমে শরৎকালে দুর্গাপুজোর বর্ণনা শুনে রাজা কংসনারায়ণও তা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলা ৮৮৭ সনের আশ্বিন মাসে মহাষষ্ঠী তিথিতে অকালবোধনের মাধ্যমে কংসনারায়ণ দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ে নিজের মন্দিরে প্রথম দুর্গাপুজো করেন। সেই শুরু। এরপর থেকে শরতের দুর্গোৎসব ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে।
একই বছর রাজশাহীর ভাদুরিয়ার রাজা জয়জগৎ নারায়ণ বেশ জাঁকজমকভাবে বাসন্তী পুজোর আয়োজন করেছিলেন। তিনি কংস রাজাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য ন’লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই পুজো করেন। ১৮ শতকে সাতক্ষীরার কলোরোয়ার মঠবাড়িয়ার সবরত্ন মন্দিরেও দুর্গাপুজো হত বলে বিভিন্নজনের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-বিধায়কের শপথ নিয়ে বোসের রাজনীতি, জটিলতা বাড়ছেই
কংসনারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মীনারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান। পরে অবশ্য লক্ষ্মীনারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুগ্রহে নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব শুরু করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানি জয়সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
রাজা কংসনারায়ণের মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত গোপাল চক্রবর্তী জানান, গোবিন্দ মন্দিরের পাশাপাশি রাজা কংসনারায়ণের শিব মন্দিরও রয়েছে।
প্রায় ৫৫০ বছর বয়স কংস রাজার এই মন্দিরটির। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব ধরনের পুজো-অর্চনা হয় এখানে।
আরও পড়ুন-৪৩৯ বছরের পুরনো ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপুজো
এই রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তাঁর বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পুজোর সময় ভিটেতে আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তিনি তাহেরপুরে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। রাজা কংসনারায়ণ তাহেরপুরে একইসঙ্গে গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গামাতা মন্দির এবং কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে রাজার বংশধররা ভারতে চলে গেলে ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িসহ সব জমি লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয় তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ। হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে মন্দিরটি খুলে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। রাজার নির্মিত সেই চার মন্দিরে এখনও পূজার্চনা হয়।