অপরাজিতা আঢ্য, অভিনেত্রী
আমাদের বাড়ির পুজোর যে উপাচার অনুষ্ঠান সেটা সারাবছর ধরে চলতে থাকে। লক্ষ্মীপুজোর আগেরদিন পর্যন্ত আমার শ্যুটিং থাকে প্রত্যেকবার। আমি শ্যুটিং থেকে ফিরে রাতে গোছগাছ করি, মাকে সুন্দর করে সাবেকি সাজে সাজাই বেনারসী শাড়ি আর গয়না পরিয়ে। সকালে উঠে আলপনা দিই। আমাদের প্রায় ৩২ বছরের পুজো। ঠাকুরপুকুরে যখন শাশুড়ি-মা থাকতেন তখন থেকেই তিনি লক্ষ্মীপুজো শুরু করেন। সেখানে মা এলোঝেলো বানাতেন। সেই এলোঝেলো এখন এই বাড়িতেও হয়ে চলেছে। এলোঝেলো আর নাড়ু আমাদের মা লক্ষ্মীর শুকনো প্রসাদে থাকবেই। ভোগ তো হয়ই। ভোগ রাঁধতে লোক আসে বাড়িতে। খিচুড়ি, আলুরদম, লাবড়া, ভাজা, চাটনি, পায়েস সব হয়। প্রচুর লোক আমাদের বাড়িতে এমনিতেই খায় সারাবছর আর লক্ষ্মীপুজোতেও তার ব্যতিক্রম হবে না। অনেক আত্মীয়স্বজন। সবাই আসেন, সবাই মিলে খুব আনন্দ করি এই দিনটা।
ইন্দ্রাণী হালদার, অভিনেত্রী
লক্ষ্মীপুজো আমার মার বাড়িতেই হয় বরাবর। সেই উৎসবেই আমি সবসময় ইনভলভ। সেই শুরুর দিন থেকেই। বিয়ের পরেও তার নড়চড় হয়নি। আমি আর মা একসঙ্গে মিলেই পুজোটা করি। আগে অনেকটা বড় করে পুজো হত এখন কিন্তু এখন একটু ছোট করে করছি। আসলে এখন তো সবার বাড়িতেই প্রায় লক্ষ্মীপুজো হয়। আমাদের রুপোর লক্ষ্মী রয়েছে, সেই মূর্তিই পুজো হয়ে আসছে। ছোটবেলার লক্ষ্মীপুজোর আনন্দটা অন্য ছিল। সবার বাড়ি যেতাম, প্রসাদ খেতাম। শ্যুটিং থাকলেও আমি সন্ধ্যের মধ্যে প্যাক আপ করে চলে আসি। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো যেহেতু সন্ধেবেলা হয় আমি সকালে অনেকসময় কাজ রাখি। আসলে কাজের মধ্যে থাকলেই আমার মনে হয় মা লক্ষ্মীকে আসল শ্রদ্ধা করা হয়।
আমি আলপনা দিই। ধানের শিষ দিয়ে মা লক্ষ্মীকে সাজাই। আমার মা লক্ষ্মীর পাঁচালি নিজে পাঠ করেন। খুব সুন্দর করে পড়েন মা পাঁচালিটা। আমি আর মা একসঙ্গেই ভোগের খিচুড়ি, তরকারি রাঁধি। এটাই আমার ভীষণ ভাললাগা। ব্যস্ততা , কাজকর্ম সবকিছুর মাঝেই মা লক্ষ্মীর আরাধনা।
সোনালী চৌধুরী, অভিনেত্রী
আমরা যেহেতু এদেশি আমাদের লক্ষ্মীপুজো হয় কালীপুজোর দিন। তবে সেটা এখন হয় আমাদের দেশের বাড়ি বাগনানে। সেটাকে আমরা সুখলক্ষ্মী পুজো বলি। ওটাই চৌধুরীদের পুজো। কিন্তু আমার ঠাকুমা এই বাড়িতে কোজাগরীর দিন লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন শুরু করেছিলেন সেই পুজোটাই আমার মা করে গেছেন, যার এখন অনেক দায়িত্ব। এরপর আমাকেই এই পুজোটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা ওইদিন লক্ষ্মীর সঙ্গে নারায়ণেরও পুজো করি। নারায়ণের সেদিন সিন্নি করা হয় এবং আলাদা করে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে ওইদিন বিভিন্ন ধরনের নাড়ু হয়। সেই নাড়ু কোনওদিন আমরা কিনিনি। সবটা নিজেরাই বানাই। আমি সবধরনের নাড়ু করতে জানি। নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া। আর যেটা লাগে সেটা হল তালের ফোপর। আমি লেক মার্কেটে নিজে লক্ষ্মীপুজোর বাজার করি সবটা। বাজারে সবাই আমাকে চেনে। আলপনা দেওয়া, ফলের জোগাড়, সবজি কাটা, ঠাকুরকে সাজানো— সবটা বেশিরভাগ আমার দায়িত্ব। আমাদের খিচুড়ি ভোগ হয়, সঙ্গে থাকে ফুলকপির তরকারি, পাঁচমিশালি সবজি, আলুরদম। ছোটবেলায় আমরা কোজাগরীর দিন রাত জাগতাম। গানবাজনা হত। গ্রামের বাড়িতে এখনও ওই সুখলক্ষ্মী হয়। আমি ছোটবেলায় গেছি। এখন আর যাই না। মা-ঠাকুমার এই পুজোটাই এখন আমাদের বাড়ির পুজো হয়ে গেছে।
রম্যাণি রায়, কথাকলি নৃত্যশিল্পী
আমাদের কথাকলি নৃত্যে মা লক্ষ্মীকে নিয়ে কোনও কিছু করিনি কখনও। ওটা মূলত রামায়ণ, মহাভারতের গল্প-নির্ভর। সেখানে কৃষ্ণ আছেন। কিন্তু লক্ষ্মী, কালী, দুর্গা নেই। আমার জন্মের আগে থেকে দেখছি লক্ষ্মীপুজো হয়ে আসছে। ঠাকুমা আর মা করতেন আগে। ছোট করে হত। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। নাড়ু, সুজি, লুচি হত তখন। একটু বড় হওয়ার পর থেকে আলপনা দিতাম। শীতকালে বইমেলা থেকে আলপনার বই কিনতাম দেখতাম নতুন কী আলপনা দেওয়া যায়। এটা খূব আনন্দের ব্যাপার ছিল। রাতে অ্যালা মাটি জল দিয়ে ভিজিয়ে গুলে আঙুল দিয়ে আলপনা দিতাম। এখন ফেব্রিক কালার, পোস্টার কালার অনেক কিছু এসে গিয়েছে সেগুলো ব্যবহার করি, রঙ্গোলি দিয়েও আলপনা দিই। সবাই একটা সময় আসত আর বলত তোদের বাড়িতে খিচুড়ি হবে না! বন্ধু-বান্ধবরা জিজ্ঞেস করত। আমাদের বাড়িতে আগে খিচুড়ি হত না কারণ আমরা ব্রাহ্মণ নই। আমার খুব খারাপ লাগা ছিল যে খিচুড়ি করতে পারব না। কিন্তু পিসির বিয়ে হল ব্রাহ্মণ পরিবারে। তখন পিসি এসে চালু করল খিচুড়ি করা। সেই থেকে আমার বাড়িতে খিচুড়ি ভোগ শুরু। পুরোহিত আসেন এবং মূর্তি পুজো হয়। জন্মাষ্টমীর সময় বাড়িতে তাল এলে সেই তালের আঁটি আমরা মাটিতে পুঁতে রেখে দিই। লক্ষ্মীপুজোর দিন বের করে সেই তালফোপর দেওয়া হয়। লক্ষ্মীপুজোর আগে-পরে অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর দিনটি বাড়ি থাকার চেষ্টা সবসময় করি।
আরও পড়ুন-চাপে পড়ে উপাচার্যের কৈফিয়ত তলব বোসের
দেবারতি মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক
আমার শ্বশুরবাড়ির দেশ বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে। সেখানে প্রায় ১১০ বছরের দুর্গাপুজো। সেই পুজোর পরেই ঠাকুরদালানে লক্ষ্মীপুজোও হয় নিয়ম মেনেই। ওই বাড়িতে আমি পুজোর সময় চলে যাই। পুজো থেকে লক্ষ্মীপুজো ওখানেই কাটে। রাজ্য সরকারি অফিসে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত ছুটি থাকলেও এটাই বড় ছুটি। সামনেই বইমেলা তাই যতটা সম্ভব ডেডলাইন কমপ্লিট করে ফেলা যায় সেই জন্য লেখালেখি চলতে থাকে। এ বছর আমার বই বেরবে বইমেলাতে সেটার ব্যস্ততা রয়েছে। আর একটা ধারাবাহিক উপন্যাস বেরচ্ছে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সেটা শেষ করব।
কাজেই সবকিছুর সঙ্গে এই কাজটা বন্ধ করলে হবে না। এর মাঝে লক্ষ্মীপুজোয় সারা বাড়ি আলপনা দেব। আলপনা আমি নিজে হাতে দিই খুব ভাল লাগে। আমার মা-শাশুড়িমা দু’জনেই থাকে সঙ্গে। কাকিমা শাশুড়ি, জেঠি শাশুড়ি মোটিমুটি ছ-সাতজন মিলেই বেশিরভাগটা করে। আমি বা আরও যাঁরা— দেওর-ননদেরা সবাই মিলে নাড়ুতে হাত লাগাই। ওই জোগাড়যন্ত্রে সাহায্য করি। ভোগ দিয়ে পুজো হয়। খিচুড়ি, লুচি, সুজি, পায়েস সবকিছু থাকে। সকাল থেকে খাওয়াদাওয়া রাত পর্যন্ত চলে। আড্ডা দিই, গল্প করি।
আরও পড়ুন-মা তোর একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি
দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত, চিকিৎসক ও সাহিত্যিক
লক্ষ্মী আমার কাছে শুধু ধন সম্পদের দেবী নন— তিনি সৌভাগ্যের, শ্রীবৃদ্ধির দেবী। আমরা যদি সৌভাগ্যকে নিজের জীবনে নিয়ে আসতে পারি আমাদের কর্মের মাধ্যমে তবেই আমাদের পুজো সার্থক। সারাদিন আমার কর্মব্যস্ততার মধ্যেই কাটে। নিজের প্র্যাকটিস থাকে সকালের একটা নির্দিষ্ট সময়। এরপর নিজের লেখালেখি থাকে। সেই সঙ্গে থাকে বাড়ির দায়িত্ব। এরই মাঝে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করি। পুজোটা আমার নিজের মনের মতো করে করি তাতে নিয়ম আচারের চেয়ে বেশি আন্তরিকতা থাকে। আমার বাপের বাড়ির দেশ বরিশাল এবং শ্বশুরবাড়ি ঢাকা বিক্রমপুর। পুজোর নিয়ম দুই বাড়ির ধরন মেনেই করি। আমার শাশুড়ি মা এবং মা দু’জনেই প্রচুর কাজ করতেন। তার মাঝেই সুন্দর করে পুজো করতেন। তাঁদের মতোই আমি পুজোর আলপনা নিজের হাতে আঁকি। কোনও ফাঁকিবাজি নেই তাতে। আতপ চাল ভিজিয়ে বেটে গুলে করি। পুজোতে নারকেল দেওয়া হয়। কারণ নারকেল মা লক্ষ্মীর প্রিয় ফল। বরিশালের একধরনের পুলি হয়। সেটা আমার মা করতেন লক্ষ্মীপুজোয়। সেই পুলিটা আমিও নিজে হাতে তৈরি করি এইদিন। এ ছাড়া খিচুড়ি তরকারি সব হয়। অনেক সময়ই পুরোহিত আসেন না। আমি নিজেই পুজো করেছি। খুব সামান্য আয়োজন হলেও পাড়া-প্রতিবেশীরা আসে। অনেক রাত পর্যন্ত জাগি। খুব ভাল লাগে।
আরও পড়ুন-শচীনকত্তা
নন্দিনী ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, মেনস ফোরাম
আমাদের প্রচুর ব্যস্ততা। সপ্তাহে সাতদিন অফিস। প্রচুর কাজের চাপ এমনকী দুর্গাপুজোতে দুটো দিন ছুটি থাকে। রোজ ছুটি রাখা সম্ভব হয় না। আমার নানা অনুষ্ঠান, টিভি শো, টক শো, বিতর্ক সভা থাকে। আমি বিধাননগর কোর্টের লোক আদালতের বিচারক তাই ওটা যেদিন থাকে সারাদিন ওখানেই চলে যায়। আমার গানের দল রয়েছে। বড় করে গণেশপুজো করি অফিসের সামনে। দুর্গাপুজো থেকে রোজ সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান থাকে। এর মাঝেই লক্ষ্মীপুজোও করি প্রতিবছর। আমার বাড়িতে সারাবছর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধরা আসেন থাকেন। একটা সময় আমার বাপের বাড়িতে বিরাট করে লক্ষ্মীপুজো হত। অনেক লোক খেত। আমরা বরিশালের বাঙাল তাই খিচুড়ি, ইলিশমাছ দিয়ে ভোগ দেওয়া হত। নিয়ম ছিল লক্ষ্মীপুজোয় শেষ ইলিশ খাওয়া হবে। এরপর আবার সরস্বতী পুজোয় জোড়া ইলিশের বিয়ে দিয়ে ইলিশ মাছ খাওয়া শুরু হবে। এর মাঝে আর ইলিশ খেতাম না। এখন আমি নিজে লক্ষ্মীপুজো করি। শ্বশুরবাড়ি এদেশীয়। এখানে লক্ষ্মীপুজোয় আমিষ ব্যাপারটা নেই তাই শুধু মাছ ভোগটা দিই না। কিন্তু খিচুড়ি ভোগ, লুচি, সুজি, লাবড়া, পাঁচভাজা— সব হয়। নিজে হাতেই পুজোর ভোগ রাঁধি। অনেক লোকজন আসে। আমার মা খুব ভাল আলপনা দিতেন। জিঙ্ক অক্সাইডের সঙ্গে আঁঠা দিয়ে আলপনা দিতেন, যেটা একমাসেও উঠে যেত না। এখন আমার কমপ্লেক্সে একজন প্রতিবেশী এসে সেই আলপনা দেন। এত কাজের ফাঁকে মায়ের আরাধনায় মনটা ভরে যায়।
আরও পড়ুন-আইফোন তৈরি করবে টাটা
সৃজনী বসাক, অধ্যাপক ও গবেষক
আমি অকুপেশনাল হ্যাজার্ড নিয়ে গবেষণা করছি। এর পাশাপাশি আমি বিদ্যাসাগর কলেজে জুলজির অধ্যাপক। সেখানে পড়াই। আর ইগনুর সঙ্গেও যুক্ত রয়েছি। তাই সারাবছর বেশ ব্যস্ত থাকি। পুজো-আচ্চা যেমন চলে পাশাপাশি কাজ, পেশা চলতে থাকে। ইগনুর ডেটটা সপ্তাহান্তে পড়ে। ওটা থাকেই। যদিও কলেজ ছূটি থাকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। ওই দিনটা ফাঁকা রাখার চেষ্টা করি আমি। বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো দেখে আসছি জন্মের পর জ্ঞান হওয়া থেকে। মা-ই মূলত পুজোর সবটা করে। আমি জোগাড় করতে, মাকে হেল্প করতে পাশে থাকি। মূলত আলপনা দেওয়া, ফলকাটা ইত্যাদি। আমাদের দোতলা বাড়ি উপর থেকে আলপনা দেওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে শুকনো ভোগটাই দেওয়া হয় মাকে। লুচি, সুজি, পায়েস, ফলমূল, মিষ্টি, নারকেল। লক্ষ্মীপুজোতে ছুটি থাকলেও তার আগে বা পরে অনেক কিছু করতে হয়। মায়ের আরাধনার পাশাপাশি কর্মব্যস্ততাও জীবনের অঙ্গ, তাই কাজ কখনও বন্ধ করি না।