শচীনকত্তা

‘তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসোনি। তুমি কি আমায় বন্ধু কাল ভালবাসনি’। এমন মধুর কথা, এমন সুর আর কে-ই বা দিতে পারেন। তিনি ছিলেন সেই নদীটার মতোই কানায় কানায় ভরাট। তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ সঙ্গীতজগৎ। তিনি হলেন কিংবদন্তি গীতিকার শচীন দেব বর্মণ। গানের দুনিয়ায় সবার প্রিয় শচীনকত্তা। আগামী ৩১ অক্টোবর তাঁর প্রয়াণদিবস উপলক্ষে স্মরণ করলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

তরুণ সঙ্গীত পরিচালক
তরুণ সঙ্গীত পরিচালক সদ্য নতুন একটা সুর করা গান গাইছেন আসরে। নিমগ্ন হয়ে নিজের সবটুকু ঢেলে তিনি গেয়ে চলেছেন। গানটার শেষে চোখ তুলে তাকালেন সেই আসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতার দিকে। তিনি হলেন ফিল্মিস্তানের কর্ণধার এস মুখার্জি। মুখার্জিবাবু কিন্তু শুধুই শ্রোতা নন বিচারকও। যাঁর রায় পেলে মুম্বই (তখনকার বোম্বে) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সাদরে বরণ করে নেবে কলকাতা থেকে আসা এই তরুণ সঙ্গীত পরিচালককে। কিন্তু এ কী— যাঁকে ঘিরে এত আশা তিনি তো ঘুমোচ্ছেন নাক ডেকে! আবার পরের দিন হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন সেই তরুণ।

আরও পড়ুন-আইফোন তৈরি করবে টাটা

আবার গানটা পুরো শেষ করে যখন সেই শ্রোতার দিকে তাকালেন তখনও সেই মানুষটি নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন! এইভাবে চলতে থাকল। পেরিয়ে গেল মাস। তরুণ সঙ্গীত পরিচালক যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রইলেন। প্রযোজকের গান শোনাও হয় না আর তাঁর সুযোগও থেকে যায় অধরা। এমতাবস্থায় একদিন অধৈর্য হয়ে তরুণ সঙ্গীত পরিচালক ভাবলেন আর না এবার ফিরে যাবেন কলকাতায়। রুটিনমাফিক গান শেষ করে উঠতে যাবেন ঠিক তখন এস মুখার্জি বলে উঠলেন, ‘গানটা রেকর্ড করিয়ে ফেলুন না!’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কিছু বললেন? উল্টোদিক থেকে জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, আপনার এই গান আমার খুব পছন্দ হয়েছে। রেকর্ড করিয়ে ফেলুন।’ যেমন কথা তেমনটাই হল। রেকর্ড হল গান। ব্যস পায়ের তলায় মাটি পেয়ে গেলেন তরুণ সেই সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। এদেশের গোটা সঙ্গীতজগতে যিনি শচীনকত্তা নামেই বিখ্যাত।

আরও পড়ুন-ইডি ‘পথভ্রষ্ট কুকুর’! বললেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলট

জন্মেই নামজাদা
ত্রিপুরার বিখ্যাত চন্দ্রবংশীয় মাণিক্য রাজবংশে জন্মেও জীবনের একটা বৃহৎ পর্ব জুড়ে শুধুই স্ট্রাগল করে গেছেন শচীন দেব বর্মণ। বাবা ছিলেন নবদ্বীপচন্দ্র দেব বাহাদুর। বাংলাদেশে
নবদ্বীপচন্দ্রের কুমিল্লার বসতভিটার উল্টোদিকেই ছিল আরেক জমিদারবাড়ি। সবাই ডাকতো মুন্সিবাড়ি। মুন্সিবাড়ির ছেলে মর্তুজ মিয়াঁ আর শচীনদেব ছিলেন বাল্যবন্ধু। কৈশোরে একদিন রাতের বেলা শচীনদেব আর মর্তুজ মিয়াঁ মুন্সিবাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। শচীনদেব এর মধ্যেই গুনগুনিয়ে গান গাওয়া শুরু করে দেন। শচীনদেবের গান অন্দর থেকে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন জমিদার নাবালক মিয়াঁ। তিনি চাকরকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। সে তখন শচীন দেবের কাছে এসে বলেন, ‘শচীনকর্তা, হুজুর আপনাকে ডাকছে।’ শুনেই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। কাঁপতে কাঁপতে হাজির হন নাবালক মিয়াঁর সামনে। জমিদার তাকে বলেন, ‘কীরে, তোর তো গানের গলা খুব ভাল। কোনও বাদ্যযন্ত্র আছে কি তোর?’ শচীনদেব বললেন না নেই। তখন নাবালক মিয়াঁ তাঁকে হারমোনিয়াম, তবলা, পিয়ানো কিনে দিলেন। কানাকেষ্ট নামক এক তবলচিকেও রেখে দেন।

আরও পড়ুন-ইডি ‘পথভ্রষ্ট কুকুর’! বললেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলট

লড়াকু শচীনদেব
লড়াকু মানুষ ছিলেন শচীনদেব। তাঁর আত্মজীবনী ‘সরগমের নিখাদ’-এ লিখে গিয়েছেন তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা। পিতার মৃত্যুতে তাঁর জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনও উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইয়েরা আমাকে তা-ই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।’

আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত পরেশ-পুত্র

১৯৩২ সালে তিনি এইচএমভিতে অডিশনে ফেল করলেন। তবে সেই একই বছর তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে শচীনদেবের প্রথম রেকর্ড করা দুটি গান হল ‘ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে’ এবং রাগপ্রধান গান ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’। ১৯৩০-এর দশকে তিনি রেডিওতে পল্লীগীতি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
১৯৩৪-এ সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলনে গান গেয়ে শচীন দেব বর্মণ স্বর্ণপদক জয় করেন। পরের বছর বেঙ্গল সংগীত সম্মেলনে তাঁর ঠুমরি শুনে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ মুগ্ধ হন। ১৯৩৭ সাল শচীন দেব বর্মণের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বছরেই তিনি বিয়ে করেছিলেন মীরা দাশগুপ্তকে। যিনি পরবর্তীতে মীরা দেব বর্মণ নামেই সুপরিচিত। তিনি ছিলেন তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস রায়বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনি।

আরও পড়ুন-ষড়যন্ত্রের শিকার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক: বাংলায় বিজেপির অবস্থা সঙ্গীন, বলছে তৃণমূল

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শচীন ও মীরা দুজনেই তালিম নিতেন। সেখান থেকেই প্রণয় এবং পরিণয়। স্বামী শচীন দেব বর্মণের মতোই সংগীতের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। সার্থক গীতিকার। তাঁর লেখা গানের মধ্যে রয়েছে ‘শোন গো দখিন হাওয়া’, ‘বিরহ বড় ভাল লাগে’, ‘সুবল রে বল বল’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’ ইত্যাদি। শচীন আর মীরার সন্তান সুরজগতের প্রবাদপুরুষ রাহুল দেব বর্মণ। রাহুল দেব বর্মণ ছিলেন যোগ্য পুত্র। শচীন এবং রাহুল দেব বর্মণ দু’জনেই জিনিয়াস। দুজনেই গেয়েছেন এবং বাজিয়েছেন— সুরের অলরাউন্ডার।

আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু চিনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর

উত্থান
১৯৪৪ সালের ফিল্মে অভিনেতা এবং গায়ক হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি। শুরুটা হল চরম হতাশা দিয়ে। ‘ইহুদি কি লড়কি’ ছবিতে তাঁর গাওয়া গানটি আবার পাহাড়ি সান্যালকে দিয়ে নতুন করে গাওয়ানো হয়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। ধ্রুপদী সঙ্গীত, সেতার বাজানো, ভাস্কর্য তৈরি ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তালিম নিয়েছিলেন উস্তাদ বাদল খান, আলাউদ্দিন খান, আব্দুল করিম খান, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, কিংবদন্তি মান্না দে-র কাকা শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। শচীনকত্তার সফল শিল্পী, সুরস্রষ্টা আর সঙ্গীত পরিচালক হবার পিছনে এই কৃষ্ণচন্দ্র দে-র অবদান অপরিসীম। বাংলা লোকগান ও হিন্দিগানের ভাণ্ডারকে তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। ‘কাহে কো রোয়ে’ গানটি গাইবার জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার।

আরও পড়ুন-হিজাজিকে দেখে নিলেন কুয়াদ্রাত, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ড্র ডায়মন্ড হারবারের

সুপারহিট সঙ্গীত পরিচালক আর সুপারহিট গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। তাঁর একের পর এক হিট গানে কণ্ঠ দিয়েছেন লতা। কিন্তু সেই লতার সঙ্গে আট বছর কাজ করেননি শচীনদেব। টিনসেল টাউনে কান পাতলে শোনা যায়, শচীন দেব বর্মণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সুরকাররাই লতা মঙ্গেশকরের কেরিয়ার তৈরি করেছি।’ এই মন্তব্য শুনে নাকি খুব রেগে গিয়েছিলেন লতা। পরে অবশ্য পুত্র রাহুল সেই ঝগড়া মিটিয়েছিলেন।
সেই ১৯৩৪-এ গোল্ড মেডেল দিয়ে শুরু। তারপর এক এক করে ফিল্মফেয়ার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড-সহ কত কী! ১৯৬৯-এ শচীনদেবকে দেওয়া হয় ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব— পদ্মশ্রী। পরের বছর শক্তি সামন্তের আরাধনা ছবির সফল ‘হোগি তেরি আরাধনা’ গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্লেব্যাক গায়কের পুরস্কার পান শচীন দেব বর্মণ। চার বছর পর জিন্দেগি জিন্দেগি ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার— শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক। ৬৯টি বসন্ত পার করে ১৯৭৫ সালে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

Latest article