বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে সুপরিচিত নাম সাতকর্ণী ঘোষ। সম্পাদনা করেন ‘কলকাতার যিশু’, ‘সারঙ্গ’ পত্রিকা। প্রকাশক এবং সংগঠক হিসেবেও বিশেষ পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ২০২২ পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২৪। এরমধ্যে ২০টি কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কবিতা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক কবিতা সংকলন ‘এই ভূমি সমগ্র জীবন’। নির্বাচিত কবিতা প্রয়াস। কবির ভাবনার বিশালতা বোঝা যায় এই সংকলনটি থেকে। বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা রচনা করেছেন। বলেছেন সময়ের কথা, সমাজের কথা। কিছু কবিতায় উঁকি দিয়ে যায় প্রেম, বিচিত্র সম্পর্ক। আশাবাদের পক্ষে তিনি। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তোলেন। স্পষ্ট উচ্চারণে। কোথাও আলো, কোথাও কোথাও রয়েছে কুয়াশার বেড়াজাল।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে বৃদ্ধ ভোটারের মাথা ফাটাল কেন্দ্রীয় বাহিনী
ভূমিকা এইটুকুই। এবার ঘুরে দেখা যাক কবিতার অন্দরমহল। সংকলনের প্রথম কবিতা ‘অন্তর্বর্ণ’। তিনি লিখেছেন, ‘বাড়ির ভেতরে বাইরে অসহ্য উচ্চারণ/ স্বর বিকৃত হয় বেশ খোলাবাজারে/ লোক উঁকি দেয় রহস্য গন্ধ শুঁকে/ হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যায় চাঁদে।’ কবি এখানে বিদ্রোহী, বিপ্লবী। সমাজের ত্রুটি দেখে রাগে গর্জে ওঠেন। প্রশ্ন তোলেন, ‘কেন এত কোলাহল হলাহল তীব্র অভিমান/ মান-অপমান সব ফুৎকারে বাষ্প হয়।’ অশান্ত, বিষাক্ত পরিবেশ দেখে কবির কপালে চিন্তার ভাঁজ। কবিতাটি প্রথম কাব্যগ্রন্থের। যে বয়সে কবিরা শুধু প্রেমের কবিতা লেখেন, সেই বয়সে তিনি ভেবেছেন সমাজ, অস্থির সময়ের কথা।
যে-কোনও সংবেদনশীল মানুষই রক্তপাতের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এই কবিও তাই। ‘কখনও না’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘যাকে ঠকাবে বলে রাবণপণ হাতে ধরেছ/ যুদ্ধে-যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত করতে চেয়েছ মন/ সে তোমার একান্ত হতে পারত।’ পাশাপাশি ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ কবিতায় লেখেন, ‘তুমি কার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে/ যে তোমাকে কাল ভাই বলে ডেকেছিল/ যার বোন তোমায় হাতে বেঁধেছিল রাখী/ যার মাকে তুমি মা বলেছিলে?’ যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতা, অথচ উচ্চস্বরের বদলে বাঁধা হয়েছে নিচু স্বরে। বারুদের ধোঁয়া সরিয়ে ফুটে উঠেছে চেনা মানুষের মুখ।
আরও পড়ুন-ফের মহিলা ভোটারকে যৌন-নিগ্রহের অভিযোগ জওয়ানের বিরুদ্ধে
দেশপ্রেমের ছবি ফুটে উঠেছে ‘অশোকস্তম্ভের তলায় নিদ্রা’ কবিতায়। এখানে দেখা যায় গল্পের চলন। মেধা ও মননের মহাসম্মিলন। ‘জন্মভূমি’ এক শান্ত কবিতা। সেইসঙ্গে গভীর অর্থবহ। গাছের সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন কবি। ‘খিদে’ কবিতায় ফুটে ওঠে গভীর মৃত্যু চেতনা। কবি লিখেছেন, ‘এই স্বপ্ন বলেছিল অসুখের কথা/ বলেছিল চিতার আগুনের কথা/ সামনা-সামনি চিতা জ্বলতে দেখে/ নিজের শরীর জ্বালা দিয়ে ওঠে/ এ-ভাবেই আমাকে পোড়ায়।’
মানুষের চারিত্রিক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় ‘অনন্ত জীবন’ কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘কেউ ভালোবাসার ফুল নিয়ে অপেক্ষায়/ কেউ আবার হিংস্র, বিষনখ দিয়ে/ তুলে নিতে পারে নরম হৃদয়টাও।’
এ-ছাড়াও মন ছুঁয়ে যায় ‘অসুস্থ মেঘ’, ‘অন্যের হাত’, ‘চলচ্ছবি’, ‘রাত-দিন স্বপ্ন’, ‘প্রস্থান’, ‘ভাঙনের সুখ’, ‘অন্তর্গত শ্লেষ’, ‘বসন্ত আসেনি এখনো’ কবিতাগুলো। আলোচনার বাইরে থেকে গেল অজস্র কবিতা। এই সংকলন কবির সমগ্র জীবনের কথা বলে। কবিতাগুলো যেন তাঁর আত্মজীবনীর খণ্ড খণ্ড অংশ। আমাদেরও অচেনা লাগে না। রঙমিলান্তি প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদশিল্পী সুনীল জানা। দাম ৩৯৯ টাকা।
আরও পড়ুন-রেমাল মোকাবিলায় এবার প্রস্তুত নবান্ন
নয়ের দশকে কবিতা-জগতে আসেন রাজীব মিত্র। সম্পাদনা করতেন ‘সংবর্তিকা ১৯ দিনে’। শিক্ষকতা করেন। লিখছেন দীর্ঘদিন। তবে মাঝে-মধ্যে নিয়েছেন বিরতি। আবার ফিরে এসেছেন। এই বিরতি শুধুই প্রকাশের বিরতি, চর্চার নয়। কবিতার হাত কখনওই ছাড়েননি। কোনওকালেই নিজেকে ভাসিয়ে দেননি গড্ডলিকা প্রবাহে। অংশ হননি কোলাহলের। কারণ কোথাও পৌঁছনোর কোনও দায় নেই তাঁর। খানিক দূরে, নিভৃতে করে গেছেন কবিতার সাধনা। হয়তো নিজের জন্য। এত বছরের লেখালিখি। এর আগে প্রকাশ পেয়েছে দুটি কাব্যগ্রন্থ। ২০২৪-এর গোড়ায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ভূতে পাওয়া দৈবের ঘোড়া’। কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে মনে হল, কবিতাগুলো আসলে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। কথোপকথন, নিচু স্বরে। ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে অন্যের দোরে পৌঁছয় না। অক্ষরের পাশে অক্ষর, শব্দের পাশে শব্দ। এগোনো মাত্রই বিস্ময় জাগে। সেইসঙ্গে লাগে ঘোর।
আরও পড়ুন-ফের মহিলা ভোটারকে যৌন-নিগ্রহের অভিযোগ জওয়ানের বিরুদ্ধে
কাব্যগ্রন্থের ‘হেরে যাওয়া জুয়াড়ির ঘোড়া’ কবিতার শুরুটা এইরকম— ‘হেরে যাওয়া জুয়াড়িরও শেষ বাজির একটা ঘোড়া থাকে।/ তাহার অশ্বক্ষুরের সাথে ধুলোর ঝড় ওঠে,/ এরকম স্বপ্নের ভিতর ভোর হয়।’ এই জুয়াড়ি তো আমরাই। হারতে হারতেও হারি না। বের করি তুরুপের তাস। দিনবদলের স্বপ্ন দেখি। কবিতার মাঝের অংশে কবি লেখেন, ‘না বলা কথার মেঘ থোকা হয়ে ঝুলে থাকে বকুলের ডালে।’ অসাধারণ একটি পঙক্তি। যেন এই পংক্তিকে প্রতিষ্ঠা দিতেই আগে-পরে আরও কিছু পঙক্তির আগমন ঘটেছে। এই ‘না বলা কথার মেঘ’ আসলে কবিতাই। কারণ তার মধ্যে অনেক বলা, না-বলা কথা লুকিয়ে থাকে।
মাঝেমধ্যেই স্মৃতিমেদুর হন কবি। অতীত আঁকড়ে ধরেন। ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’ কবিতার শেষ অংশে লেখেন, ‘যদিও চাঁদনী রাত, যদিও সবাই গিয়েছে বনে/ আর,/ তোমাকে আচম্বিতে ছুঁয়ে দেওয়ার কৌশল হারিয়ে ফেলেছি।’ এই অংশে লুকিয়ে রয়েছে প্রেম। গভীর, পরিণত। সংযমের প্রকাশ ঘটেছে কৌশল হারিয়ে ফেলার মধ্যে দিয়ে। এই হারিয়ে ফেলা হয়তো ইচ্ছাকৃত।
আরও পড়ুন-বাঁকুড়া লোকসভার ৫টি ইভিএমে বিজেপির ট্যাগ, রিপোর্ট তলব কমিশনের
‘গার্হস্থ্য’ কবিতায় আঁকা হয়েছে ট্রেনযাত্রার ধূসর স্মৃতি। শুরুটা এইরকম— ‘চায়ে রামপেয়ারী ডাকের সাথে শৈশব মাখা আশ্চর্য ভোর নেমে এল।/ মা সেলাইকলের চাকা থামিয়ে সরে বসলেন জানলার পাশে/ বাবা বিষাদের বারান্দা পেরিয়ে মাটির ভাঁড়ে চা আনছেন।’ অতীতের গন্ধ লেগে রয়েছে কবিতার নরম শরীর জুড়ে। এই ভোর আসলে জীবনের ভোর। মাটির ভাঁড়ে চা নয়, বাবা যেন পরিবারের জন্য নির্ভরতা বয়ে আনছেন। বহু ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে। বিষাদ পেরিয়ে। ঘাম ঝরিয়ে। সেই খবর কেউ রাখে না। কবিতাটি পুরোদস্তুর জীবনচিত্র, সমাজচিত্র।
‘সুবর্ণভূমি’, ‘ফেরা’, ‘কুহক’, ‘হোর্ডিং’, ‘যা কিছু চেয়েছি অশালীন’ কবিতাগুলোও গভীর অর্থ বহন করে। কোথাও রয়েছে আলো, কোথাও কুয়াশা। রহস্যভেদ করতে পারলেই আশ্চর্য আনন্দ। বারবার ফিরে ফিরে যেতে হয় কবিতাগুলোর কাছে। ছোঁয়া প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদশিল্পী পার্থপ্রতিম দাস। দাম ১৫০ টাকা।