জুডাস থেকে মিরজাফর৷ নরেন গোঁসাই থেকে শুভেন্দু অধিকারী৷ বিশ্বাসঘাতকতা কোনও স্থান, কাল মানে না৷ তার ভূগোল স্থান থেকে স্থানান্তরে, একাল থেকে সেকালে ছড়িয়ে পড়ে৷
এসব জানা ঘটনা৷
এসব ঐতিহাসিক সত্য৷
কিন্তু সেই বিশ্বাসঘাতকতার নষ্টামির গায়ে মূল্যবোধের দূর্বাঘাসের লেগে থাকা, সেই বিশ্বাসঘাতকতার পতনশীল মানবিকতার ছবিতে নির্ভেজাল মানবিক মূল্যবোধের রং, এসব সাধারণ বিষয় নয়৷ ক্রমাগত ঘটতে থাকা বর্তমান নয়৷ স্বাভাবিক ঘটনা নয়৷
তবে, তেমনটাও হয়৷ তেমনটাও ঘটে৷
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথের অগ্নিকন্যা
যেমনটা ঘটেছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের বেলায়৷ যেমনটা ঘটেছিল বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনের ক্ষেত্রে৷
১৮ এপ্রিল, ১৯৩০৷ চট্টগ্রাম দেখল যুব বিদ্রোহের আগুন৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রবল দাপট৷ প্রচণ্ড প্রতাপ৷ সেসব হেলায় নস্যাৎ করে দিয়ে ৬৫ জন যুবক একযোগে আক্রমণ করে সরকার আর রেল কোম্পানির দুটো অস্ত্রাগার দখল করে ফেলল৷ জ্বালিয়ে দিল টেলিগ্রাফের অফিস৷ উপড়ে ফেলল রেললাইন৷ কেটে দিল টেলিগ্রাফের তার৷ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হল৷ লড়াই শেষে পিছু হটল পুলিশ বাহিনী৷ রাতারাতি চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাদবাকি দুনিয়া থেকে৷ সেই শুক্রবারের রাতেই ইস্তাহার বিলি হল চট্টগ্রাম শহরে৷ নগরবাসী জেনে গেল, বিদ্রোহের কথা৷ জেনে গেল, বিদ্রোহের সংগঠক ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মির চট্টগ্রাম শাখা৷ তারা এটাও জানতে পারল, সেই বিপ্লবী সংগঠনের চেয়ারম্যান একজন শিক্ষক৷ নাম সূর্য সেন৷
আরও পড়ুন-ডুরান্ডের উদ্বোধনে আমন্ত্রণ মুখ্যমন্ত্রীকে, বাড়ছে প্রাইজ মানি
সে রাতেই চেয়ারম্যান সূর্য সেন জাতীয় পতাকা তুললেন৷ অভিবাদন করলেন সেই পতাকাকে। বিপ্লবীদের হাতে ৬৪টি মাস্কেট৷ সেগুলো থেকে আকাশে ছোঁড়া হল তিন রাউন্ড গুলি৷ মধ্যরাত্রির নীরবতা ভেঙে চুরমার৷ আর সেই নৈঃশব্দ্য নিধনের লগ্নে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বিপ্লবীরা স্লোগান দিলেন, ‘বন্দেমাতরম৷ ইনকিলাব জিন্দাবাদ৷’
নৈশনিদ্রায় ব্যাঘাত৷ ঘুম চোখ ডলতে ডলতে চট্টগ্রামবাসী শুনতে পেল মাস্টার নির্দেশ৷ বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরের দফার কার্যসূচি৷ পাঁচ দফা কর্তব্য পালনের ডাক৷
(১) চট্টগ্রাম জয়কে সম্পূর্ণতা দিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷
(২) ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে আরও ব্যাপক ও তীব্রতর করে তুলতে হবে৷
(৩) অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন করতে হবে৷
(৪) সমাজবিরোধী আর লুঠেরাদের আটকাতে হবে৷
(৫) সামরিক বিপ্লবী সরকারে তরফে পরবর্তীকালে যে সব নির্দেশ দেওয়া হবে, সেগুলো পালন করতে হবে৷
ঘোষণাপত্র পাঠ শেষ হতেই কমান্ডার গণেশ ঘোষের নির্দেশ শোনা গেল৷ ‘ফায়ার’৷ আবার আকাশে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হল৷ অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের সামরিক পন্থা৷
চট্টগ্রামে যেসব ইংরেজরা বাস করত তারা তখন ভয়ে কাঁপছে৷ চট্টগ্রামে বন্দরে অপেক্ষা করছিল একটা জাহাজ৷ তাতে তারা হুড়োহুড়ি করে উঠল৷ জাহাজ সাগর মোহানার দিকে এগিয়ে চলল৷ সেখানে পৌঁছে নোঙর ফেলল৷ জাহাজ থেকে কলকাতায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ করা হল৷
আরও পড়ুন-সুরাইয়া তৈয়াবজি, যাঁর হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছিল জাতীয় পতাকা
এরপর বন্দরের অস্ত্রাগার দখল, শহরের বন্দুকের দোকানে হানা, সরকারি ব্যাঙ্ক দখল, এসব চলল তিনদিন ধরে৷
২২ এপ্রিল৷ জালালাবাদের যুদ্ধ৷ চট্টগ্রাম থেকে ৬ মাইল উত্তরে জালালাবাদ পাহাড়৷ সেখানে একদিকে মাস্টারদার নেতৃত্বে খিদে তেষ্টায় কাত ১০, ২০, ২৪ বছর বয়সি ছাত্র-যুবর দল৷
তাদের হাতে মাস্কেট গান৷ আর একদিকে ব্রিটিশ বাহিনী৷ তাদের হাতে রাইফেল, মেশিনগান, লুইসগান৷ তারা প্রশিক্ষিত এবং রণদক্ষ৷
অসম লড়াই৷ কিন্তু হতাহতের হিসেবটা আরও অসামঞ্জস্যপূর্ণ৷ যুদ্ধ শেষে দেখা গেল বিপ্লবীদের মধ্যে ১১ জন শহিদ হয়েছেন৷ ব্রিটিশ বাহিনীর তরফে মৃতের সংখ্যা কমবেশি ৮০৷
আরও পড়ুন-নিউইয়র্কে হামলা, ছুরিকাহত রুশদি
ঠিক হল, রিপাবলিকান আর্মি এবার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে৷ চালাবে যুদ্ধ৷ সে লড়াই চলবে গেরিলা পদ্ধতিতে৷
১৯৩৫ পর্যন্ত ইতিউতি অব্যাহত সেই সশস্ত্র সংগ্রাম৷ কালারপুলে, ফেণীতে, ধলঘাটে, পাহাড়তাল ইউরোপীয় ক্লাবে, পল্টন ময়দানে৷
চাঁদপুরে পুলিশের আইজি ক্রেসকে খতম করার চেষ্টা করল বিপ্লবীরা৷ খেলার মাঠে ভিড়ের ভেতর খান বাহাদুর আসানউল্লাকে মারল তারা৷ কুমিল্লার পুলিশ সুপার নিহত হলেন তাদের আক্রমণে৷ ডিনামাইট দিয়ে জেলের দেওয়াল উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল৷ লড়াই হল গাহিরায়৷
এর মধ্যে ১৯৩২–এ ব্রিটিশ সরকারের তরফে ছড়িয়ে দেওয়া হল একটা বিজ্ঞপ্তি৷
আরও পড়ুন-আবার ইডেনে ব্যাট হাতে দেখা যাবে মহারাজকে!
‘‘১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কার্যে বিপ্লবী দলের নেতা বলিয়া কথিত সূর্য সেনকে যে ধরিয়া দিতে পারিবে বা এমন সংবাদ দিতে পারিবে যাহাতে সে ধরা পড়ে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে৷’’
অঙ্কের মাস্টার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার দশ হাজার টাকা৷ তখনও মোটামুটি দু’ টাকায় ১০–১২ কেজি চাল পাওয়া যেত৷ এটা সেই সময়কার কথা৷
সাল ১৯৩৩৷ বিপ্লবের আগুন ছড়াতে ছড়াতে অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা চলেছেন এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে৷ লুকিয়ে৷ গোপনে৷ ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে৷
এরকম একটা সময়ে ব্রজেন সেন সূর্য সেনকে নিয়ে এলেন গৈরালা গ্রামে৷ তাঁর নিজের গ্রামে৷ গৈরালার বিশ্বাসবাড়ির বউ ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাস৷ তিনি আশ্বাস দিলেন, যে কোনওভাবে রক্ষা করবেন সূর্য সেনকে৷ ধরা পড়তে দেবেন না তাঁকে৷ ওই আগুন পাখিই তো বিপ্লবের যজ্ঞের অগ্নিহোত্রী ঋত্বিক৷
আরও পড়ুন-বুমরার চোট নিয়ে চিন্তায় বোর্ড, বিশ্বকাপে বিকল্প ভাবনায় শামি
ক্ষীরোদপ্রভার আশ্রয়ে থাকার সময় মাস্টারদার সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে আসতেন কল্পনা দত্ত, সুশীল দাশগুপ্তরা৷ সূর্য সেনের পাশাপাশি তাঁদের জন্যও খাবার আসত বিশ্বাসবাড়ির হেঁশেল থেকে৷
ব্রজেন সেনের তুতো ভাই নেত্র সেন৷ তাঁরই প্রতিবেশী৷ তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে৷ কার জন্য এত খাবার–দাবার? কীসের জন্য তার স্ত্রীর সঙ্গে ছোট ভাই ব্রজেনের এত গুজগুজ ফিসফাস?
শেষে স্ত্রীর মুখ থেকেই অসতর্কতায় বেরিয়ে গেল সেই গোপন খবর৷ স্বয়ং সূর্য সেন আস্তানা গেড়েছেন এখানে৷ তাঁকে বাঁচিয়ে থাকার জন্য একজোট হয়েছে গৈরালার বউ–ঝিয়েরা৷
সোনার হাঁস উড়ে এসেছে ঘরে৷
আরও পড়ুন-দুই নায়কের দৌড়
নেত্র সেনের কি আর বসে থাকলে চলে?
তার স্ত্রীর কিন্তু তখনও বিশ্বাস, স্বামী আর যাই–ই করুক, মাস্টারদাকে বিপদে ফেলবে না৷ মাস্টারদার মতো একজন সম্মাননীয় ব্যক্তির ক্ষতির কারণ হবে না সে৷
১৬ ফেব্রুয়ারির অন্ধকার রাত্রি৷ নেত্র সেনের দেওয়া খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন ওয়েলেসলির নেতৃত্বে এক সুবিশাল গোর্খা বাহিনী ঘিরে ফেলল গোটা তল্লাট৷
ব্রজেন সেন সবিস্ময়ে দেখলেন, নেত্র সেন সিগন্যাল দিচ্ছে আর সেই আলোর ইশারা অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে ব্রিটিশ সেনারা৷
শুরু হল গুলির লড়াই৷
হল না কো শেষে রক্ষা৷
আরও পড়ুন-সোনা জিতেই সিন্ধু ফের চ্যালেঞ্জের মুখে
কল্পনা দত্তরা পালাতে সক্ষম হলেও ধরা পড়লেন সুশীল দাশগুপ্ত৷
এবং সূর্য সেন৷ তাঁর হাতে গুলি বিঁধেছে৷ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল থানায়৷ টেনে হিঁচড়ে৷ নিয়ে যাওয়ার সময় ঘুসি মেরে মেরে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর চোখ-মুখ চোয়াল৷
১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪৷ ফাঁসি দেওয়া হল সূর্য সেনকে৷
ফাঁসির আগে উপড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁর দাঁত আর নখ৷
ফাঁসির পর তাঁর মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সমুদ্রে৷
কিন্তু তার আগেই খতম হয়ে গেল নেত্র সেন৷
৯ জানুয়ারি, ১৯৩৪৷ দশ হাজার টাকার পুরস্কার পেয়ে মহাখুশি নেত্র৷ রাতের খাবার খেতে বসেছে৷ সামনে স্ত্রী বেড়ে দিয়েছেন ভাত৷ পাশে রাখা মাছের বাটি৷
আরও পড়ুন-প্রস্তুতি শুরু বিরাটের, ফিট রাহুলই নেতা জিম্বাবোয়েতে
এমন সময় দরজায় টোকা৷
দুটো ছেলে ঘরে ঢুকল৷ কিশোর৷ বয়স ১৮–১৯৷ কিরণময় সেন আর রবীন্দ্র নন্দী৷ রবীন্দ্রকে সবাই গ্রামে খোকা নামেই চেনে৷
কিরণময়ের হাতে রাম দা৷ রাম দায়ের একটা কোপে কাটা পড়ল নেত্র সেনের মাথা৷ ভেসে গেল থালাবাটি ভাত মাছ মেঝে রক্তের স্রোতে৷ নেত্রর স্ত্রী সবটা দেখলেন৷ যাওয়ার আগে ছেলে দুটো তাঁকে বলে গেল একটাই কথা, ‘‘বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু৷’’
ওই একটা উচ্চারণেই চেতনার রং বহ্নিময়৷
ওই একটা উচ্চারণেই মনের আকাশ অন্যরকম৷
ব্রিটিশ পুলিশ নানাভাবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ জানতে চেয়েছে, কে বা কারা মারল নেত্রকে৷ নেত্র সেনের স্ত্রী কাউকে কিচ্ছু বলেননি৷
কারণ, তিনিও যে বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু৷
বিশ্বাসঘাতকতার আখ্যান তো দেশে দেশে, কালে কালে৷ সে কাহিনি তো সুলভ৷
আরও পড়ুন-প্রেসিডেন্সিতে অশান্তি করছে বামেরা
কিন্তু ব্যক্তিগত লাভক্ষতির খতিয়ান শিকেয় তুলে, স্বামীর চেয়ে দেশপ্রেমীকে ভালবাসায় আর শ্রদ্ধায় বরণ করার, আঁকড়ে থাকার এমন ঘটনা বিরল৷ মূল্যবোধ লগ্ন থাকার এমন আকুতি বড়ই দুর্লভ৷
বি. দ্র. : ৯ জানুয়ারি, ১৯৩৪–এর রাতে নিহত হওয়ার সময় নেত্র সেন পুরস্কারে অর্থ হাতে পাওয়ার আশায় মশগুল ছিলেন, কিন্তু সে অর্থ তিনি কোনওদিনই পাননি৷ সে টাকা নেননি তাঁর বিধবা পত্নীও৷