২০২২-এ খেলার মঞ্চে পুরুষদের পাশাপাশি ঔজ্বল্য ছড়িয়েছেন মহিলারাও। বছর শেষে কয়েকজন ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদের আশ্চর্য সাফল্য ফিরে দেখল জাগোবাংলা
ঝুলন গোস্বামী
এই মুহূর্তে বাংলা তথা দেশের অন্যতম সেরা মহিলা ক্রীড়া ‘আইকন’। যাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিকেটের ময়দানে নেমেছেন বর্তমান প্রজন্মের বহু খেলোয়াড়। আর তাঁদের পাশে সমান উজ্জ্বল ছিলেন ঝুলন। ২০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপট দেখিয়ে সেপ্টেম্বরে অবসর নিলেন ‘চাকদা এক্সপ্রেস’। সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য নজির। একদিনের ক্রিকেটে আইসিসি-র দশকসেরার সম্মান পেয়েছেন। মার্চে মহিলা বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছেন, একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ২৫০ উইকেটের মালকিন। ৪০ বছর বয়সে সেপ্টেম্বরে জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচেও ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন ঝুলন। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটে এখনও কেউ তাঁর বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি। ঝুলনের সম্মানে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ ডাকটিকিট। তৈরি হচ্ছে জীবনীচিত্র। ঝুলনদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান ‘ম্যাচ ফি’ পাবেন মহিলারাও। শুরু হচ্ছে মহিলা আইপিএল। ঝুলন, মিতালি রাজরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নজরকাড়া সাফল্য না দেখালে এই মঞ্চ আদৌ তৈরি হত না।
আরও পড়ুন-সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক স্লোগান, মঞ্চেই উঠলেন না মুখ্যমন্ত্রী
মৌমা দাস
টেবল টেনিসে বাংলা তথা দেশের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। মাঝে বিরতি। সন্তান জন্মের প্রায় তিন বছর পর চলতি বছর জাতীয় সিনিয়র টিটি টুর্নামেন্টে নেমেই রানার্স হয়েছেন। মাত্র ১৫ দিনের প্রস্তুতিতে। জিমে কিছুক্ষণ ঘামঝরানো আর হাতে গোনা কয়েকটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেই নেমে পড়েছিলেন শিলংয়ে। পরে গুজরাতে ৩৬তম জাতীয় গেমসেও বাংলার সাফল্যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই যখন খেলার ময়দান ছেড়ে অন্য ভূমিকায়, তখন ৩৮ বছর বয়সে মেয়ের পুরো দেখভাল করেই জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন মৌমা।
আরও পড়ুন-৫ প্রকল্পের ৪টিই তাঁর হাত ধরে, স্মৃতিচারণে মুখ্যমন্ত্রী
মেহুলি ঘোষ
জুলাইয়ে আইএসএসএফ শ্যুটিং বিশ্বকাপে দশ মিটার এয়ার রাইফেলে দেশকে সোনা উপহার দিয়েছিলেন। এতেই শেষ নয়, নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান এয়ার গান চ্যাম্পিয়নশিপেও জিতেছেন তিনটি সোনা। এশীয় ও আন্তর্জতিক স্তরে কয়েকটি বড় প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিলেও বাংলার সোনার মেয়ের পাখির চোখ ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক।
আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মেলা বা তীর্থস্থান করা হোক, নমামি গঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি
নিখাত জারিন
চলতি বছরে অনবদ্য ছন্দে ছিলেন ২৮ বছর বয়সি ভারতীয় বক্সার। আন্তর্জাতিক মঞ্চে গড়েছেন একের পর এক সাফল্যের সোপান। বুলগেরিয়ার সোফিয়ায় স্ট্র্যান্ডজা মেমোরিয়াল বক্সিং টুর্নামেন্টে নামী বক্সারদের হারিয়ে সোনা জেতেন। মে মাসে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৫২ কেজি ক্যাটাগরিতেও সোনা জেতেন তিনি। এর আগে মেরি কম ৬ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিশ্ব মিট থেকে সোনা জিতেছেন সরিতা দেবী, জেনি আরএল ও লেখা সি। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পঞ্চম ভারতীয় মহিলা হিসাবে এই কীর্তি গড়েন নিখাত। বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসেও ‘সোনা’র মেয়ে হিসাবে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মেলা বা তীর্থস্থান করা হোক, নমামি গঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি
মীরাবাই চানু
মণিপুরের ছোট্ট শহরের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মীরাবাই চানু গত কয়েক বছর ধরেই দেশের অন্যতম সেরা ভারোত্তোলক। জীবিকা নির্বাহের জন্য জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে আনতেন। আর বর্তমানে তিনি সাফল্যের শিখরে! কর্নম মালেশ্বরীর পর তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় ভারোত্তোলক হিসাবে অলিম্পিকে জিতেছেন রুপোর পদক। চলতি বছর বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমসে ৪৯ কেজি বিভাগে প্রথম ভারতীয় হিসাবে সোনা জিতেছেন। গড়েন রেকর্ডও। পরে ডিসেম্বরে কলম্বিয়ায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও রুপো জিতেছেন পদ্মশ্রী সম্মানপ্রাপক চানু। ২৮ বছর বয়সি এই ক্রীড়াবিদ দেশকে আরও সম্মান এনে দেবেন, আশায় বুক বাঁধছেন ভক্তরা।
আরও পড়ুন-ফান | ফেস্টিভ্যাল | ফেলুদা
পি ভি সিন্ধু
প্রকাশ পাড়ুকোন, পুল্লেলা গোপীচাঁদ, সাইনা নেহওয়ালদের সার্থক উত্তরসূরি। ব্যাডমিন্টন তারকা সিন্ধুর দিকে সর্বদাই পদকের আশায় তাকিয়ে থাকে দেশ। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি নিরাশ করেন না। চলতি বছর বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছেন সিন্ধু। মহিলাদের দলগত বিভাগে ভারত রুপো জিতলেও সিন্ধু ছিলেন অপরাজিত। এ বছর খেতাব জিতেছেন সুইস ওপেন, সৈয়দ মোদি গ্রাঁ প্রি, সিঙ্গাপুর ওপেনে। এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বিতর্কিত হারে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ব্রোঞ্জ নিয়ে। চোটের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, ওয়ার্ল্ড ট্যুর ফাইনালে ছিলেন না। সিন্ধু ভারতের একমাত্র মহিলা খেলোয়াড় যিনি দুটো অলিম্পিক পদক জয় করেছেন। আগামী বছর তাঁর স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় দেশবাসী।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রীর মাতৃবিয়োগ, বাতিল হচ্ছে না বঙ্গের কোনও কর্মসূচি
সাক্ষী মালিক
চলতি বছর তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত টিউনিস র্যাঙ্কিং সিরিজ ইভেন্টে নিজের ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন। তার পরে বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণপদক জিতেছেন। ৩০ বছর বয়স সাক্ষীর। প্যারিস অলিম্পিকের লক্ষ্যে এখনও নিশ্চিত না হলেও তাঁর ফর্ম আশা জাগাচ্ছে।
আরও পড়ুন-ফের গ্রেফতার সাকেত
মনীষা কল্যাণ
সুনীল ছেত্রী, সন্দেশ ঝিঙ্গানদের আড়ালে অনেকটাই অবহেলিত দেশের মহিলা ফুটবল। পুরুষদের ফুটবলে চালু হয়েছে আইএসএল। বিদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে ময়দান ভাগ করে নিচ্ছেন সুনীলরা। তারই মধ্যে বিরল নজির গড়েছেন মনীষা। সাইপ্রাসের অ্যাপোলন লেডিস ফুটবল ক্লাবের হয়ে উয়েফা ইউরোপীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেক হয়েছে তাঁর। হরিয়ানার এই ফুটবলার প্রথম ভারতীয় মহিলা, যাঁকে শুধু বেঞ্চে বসিয়ে রাখার জন্য নির্বাচিত করা হয়নি। বরং ইউরোপীয় টুর্নামেন্টে মাঠে নেমে বিশ্বমঞ্চে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন।
আরও পড়ুন-মোক্ষম খোঁচা দিলেন অভিষেক
মনু ভাকের
আইএসএসএফ শ্যুটিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২৫ মিটার পিস্তলে দলগত ইভেন্টে রুপো জিতেছেন মনু। জাতীয় শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে একটা-দুটো নয়, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাঁচটি সোনা জিতেছেন হরিয়ানার এই তরুণী। মধ্যপ্রদেশে জুনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও ১০ মিটার পিস্তল ইভেন্টে সোনা জেতেন মনু।
জ্যোতি ইয়ারাজি
পি টি উষা, অশ্বিনী নাচাপ্পা, দ্যুতি চাঁদের মতো স্প্রিন্টারের অভাব দেশে। এমনিতেই অ্যাথলেটিক্স যথেষ্ট অবহেলিত ভারতে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। তার মধ্যেই চলতি বছর আশার সঞ্চার করেছেন জ্যোতি ইয়ারাজি। অন্ধ্রপ্রদেশের ২৩ বছরের এই স্প্রিন্টার প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে ১৩ সেকেন্ডের কমে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছেন। ৬১তম জাতীয় ওপেন অ্যাথলেটিক্সে তিনি সময় নিয়েছেন ১২.৮২ সেকেন্ড।
আরও পড়ুন-তাঁর সঙ্গে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ পরিচয় হয়েছিল: পেলের প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রী
করমন কৌর থান্ডি
সানিয়া মির্জার পর বিশ্ব টেনিসের মঞ্চে কে হবেন ভারতের প্রতিনিধি, তা নিয়ে জল্পনা ছিলই। কিছুটা আশাও জাগিয়েছিলেন অঙ্কিতা রায়না। কিন্তু প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। এবার তাঁকে সরিয়ে ভারতের এক নম্বর মহিলা টেনিস তারকা হিসেবে উঠে এসেছেন করমন কৌর থান্ডি। যাঁকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু। অক্টোবরে কানাডার সাগুয়েনে ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন (আইটিএফ)-এর ডব্লু-৬০ ইভেন্ট জেতার পর করমন এই অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হলেন। এর আগে ২০১০ সালে এই টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন সানিয়া। চলতি বছরে আরও দুটি সিঙ্গলস খেতাব জিতেছেন করমন। ডব্লিউটি-এ র্যাঙ্কিংয়ে করমনের বর্তমানে র্যাঙ্ক ২১৭।
আরও পড়ুন-হলদিয়া ও পটাশপুরে সমবায় ভোটে জয়ী তৃণমূল
পি টি উষা
ভারতের সবচেয়ে সফল ক্রীড়াবিদদের একজন, পি টি উষা ডিসেম্বরে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (আইওএ) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সি উষা আইওএ-র প্রথম মহিলা সভাপতি। এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক বিজয়ী এবং একজন অলিম্পিয়ান হিসাবে অত্যন্ত মর্যাদার এই পদে উষা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই সাফল্য আরও অনেক মহিলাকে ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পদে ওঠার পথ প্রশস্ত করবে।