বাংলার কালীতীর্থ

সামনেই কালীপুজো। শক্তি-আরাধনায় মাতবে বাংলা। সাজবে আলোকমালায়। মণ্ডপে মণ্ডপে নামবে জনজোয়ার। বাংলার জেলায় জেলায় আছে বহু কালীমন্দির। সারা বছর ভক্ত সমাগম হয়। কালীপুজোয় উপচে পড়বে ভিড়। কেউ দেবেন পুজো। কেউ দেবীদর্শন। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। কয়েকটি সুপ্রসিদ্ধ কালীতীর্থের সন্ধান দিলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কঙ্কালীতলা মন্দির
বীরভূম জেলার কঙ্কালীতলা। বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে। কোপাই নদীর তীরে অবস্থিত। একটি প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠ। প্রাচীনকালে এই জায়গাটি কাঞ্চি নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তন্ত্রচূড়ামণিতেও জায়গাটির উল্লেখ আছে। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর অস্থি পড়েছিল। সেই কারণে নাম হয়েছে কঙ্কালীতলা। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে লেখা রয়েছে, এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশটি পড়েছিল।

আরও পড়ুন-লন্ডভন্ড গাজার কেন্দ্রে দখল নিল ইজরায়েলি সেনা

মন্দিরের চারপাশের পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর। কিছুক্ষণ থাকলে মন অপার শান্তিতে ভরে ওঠে। এই শক্তিপীঠের দেবী গর্ভাদেবী নামে প্রসিদ্ধ। ভৈরব রুরু নামে পূজিতা হন। মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ড রয়েছে। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি পাথরের খণ্ড আছে। যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই পাথরের খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়। পুজোর পর আবার কুণ্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কঙ্কালীতলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানারকম অলৌকিক ঘটনা। তাই পর্যটকদের কাছে স্থানটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। গুপ্ত তন্ত্রসাধনার জন্য বিখ্যাত। সাধকদের পাশাপাশি এখানে সারা বছর সাধারণ পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে।

আরও পড়ুন-কুরুচিকর মন্তব্যের জের, ক্ষমা চাইতে হল নীতীশকে

সেবকেশ্বরী কালীমন্দির
শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকগামী ৩১ নং জাতীয় সড়কের ধারেই সেবক পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত বিখ্যাত সেবকেশ্বরী কালীমন্দির। দার্জিলিং বেড়াতে গেলে অনেকেই ঘুরে আসেন। এই মন্দিরে দেবী দর্শনের জন্য তিস্তার ধার থেকে অন্তত ১০৭টি সিঁড়ি পেরতে হয়। খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে তৈরি হয়েছে সিঁড়ি। অদ্ভুত নির্জন পরিবেশ। কালীপুজোর রাতে, শিলিগুড়ি, সিকিম, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কালিম্পং সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীর ঢল নামে। স্থানীয়দের পাশাপাশি আসেন দূর-দূরান্তের প্রচুর মানুষ। পাহাড়ের নির্জনতায় হয় কালী মায়ের আরাধনা। মন্দিরের সামনে পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে। সেটা স্বপ্নাদেশে পাওয়া। মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ। পুজো দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসা যায়। ভক্তদের বিশ্বাস, গোটা পাহাড়-জঙ্গল যখন ঘুমোয়, তখন একমাত্র জেগে থাকেন সেবকেশ্বরী মা। তাঁকে পাহাড়ের প্রহরী হিসেবে কল্পনা করেন এলাকার মানুষ। অনেকেরই বিশ্বাস, দেবীর কাছে অন্তর থেকে প্রার্থনা করলে তিনি ভক্তের মনস্কামনা পূরণ করেন।

আরও পড়ুন-রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের শীর্ষ স্তরে রদবদল

দেবী চৌধুরানি কালীমন্দির
জলপাইগুড়ির শতাব্দীপ্রাচীন মন্দির দেবী চৌধুরানি কালীমন্দির। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের রংপুরের মন্থনী রাজ এস্টেটের সর্বময় কর্ত্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানি। তাঁকেই কল্পনায় দেবী চৌধুরানি হিসাবে রূপ দিয়েছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে উল্লেখ রয়েছে। দেবী চৌধুরানি সেই সময় ব্রিটিশ এবং জমিদারদের কাছ থেকে ধন-সম্পদ লুট করে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রাখতেন। পরে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। মন্দিরে মূলত মা কালীর উপাসনা করা হয়। প্রাঙ্গণে রয়েছে বিশাল বটগাছ। সেখানেই রয়েছে শিবের মন্দির। শিলিগুড়িগামী জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত প্রাচীন এই মন্দির ঘিরে নানা ইতিহাস আর জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে। একসময় নাকি নরবলি হত। শোনা যায়, ১৮৯০ সালে নরবলির অভিয়োগে প্রাণদণ্ড হয়েছিল মন্দিরের কাপালিকের। তারপর থেকে নরবলি বন্ধ হয়ে যায়। পাঁঠাবলির রীতি অবশ্য এখনও আছে। কালীপুজোর দিন রাতভর পুজো চলে মন্দিরে। বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভিড় জমান।

আরও পড়ুন-পর্যটনক্ষেত্রকে শিল্পের স্বীকৃতি রাজ্য সরকারের!

উলুবেড়িয়া আনন্দময়ী কালীমন্দির
হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া শহরে অবস্থিত একটি শতাব্দীপ্রাচীন কালীমন্দির। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ ভাগীরথী নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাতৃপীঠ ও তৎসংলগ্ন প্রাঙ্গণ উলুবেড়িয়া কালীবাড়ি নামে প্রসিদ্ধ। হাওড়া জেলার অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্যস্থল। পাথরে নির্মিত কালীবিগ্রহের পদতলে শ্বেতপাথরে তৈরি শবাসনে শায়িত শিব মূর্তি বর্তমান। সারা বছর বহু মানুষ আসেন। পুজো দেন। মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ান। বসেন গঙ্গার তীরে। কালীপুজোর রাতে আয়োজিত হয় বিশেষ পুজো। অগণিত মানুষের সমাগম হয়। মন্দির সংলগ্ন আটচালায় প্রতি বছর বসে রাসের মেলা। আসেন দূর-দূরান্তের মানুষজনেরা।

আরও পড়ুন-পর্যটনক্ষেত্রকে শিল্পের স্বীকৃতি রাজ্য সরকারের!

হংসেশ্বরী কালীমন্দির
হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় দুশো বছরের পুরনো একটি বিখ্যাত কালীমন্দির। ১৭৯৯ সালে রাজা নৃসিংহদেব এই হংসেশ্বরী কালীমন্দিরের নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮১৪ সালে তাঁর বিধবা স্ত্রী রানি শঙ্করী মন্দির নির্মাণ শেষ করেন। মন্দিরের স্থাপত্য শিল্প দেখার মতো। তেরোটি মিনার বা গম্বুজ আছে, যা দেখতে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো। ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি। সত্তর ফুট উঁচু এই মন্দিরে লেগেছে বারাণসীর স্থাপত্য শিল্পের ছোঁয়া। পাথর এসেছিল উত্তরপ্রদেশের চুনার থেকে। কারিগররা এসেছিলেন রাজস্থানের জয়পুর থেকে। মন্দির নির্মাণে করতে খরচ হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। কেউ কেউ বলেন মন্দিরটি মস্কোর সেন্ট বেসিল ক্যাথিড্রালের আদলে তৈরি। দেবী খুব জাগ্রত। মনে করেন স্থানীয়রা। সারা বছর বহু মানুষ আসেন। তবে কালীপুজোর রাতে জনসমাগম বেশি হয়।

আরও পড়ুন-১৬৪ বছরের কালীপুজোয় বন্ধ হল বলি

ক্ষেপি মায়ের মন্দির
প্রায় ৩০০ বছর আগে কাটোয়া শহরের ভাগীরথীর তীর জঙ্গলে ভরা ছিল। কথিত আছে, সেই জঙ্গলে বাস করতেন এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। তিনি জঙ্গলে কালীপুজো করতেন। ডাকাতি করার সময় কালী মাকে পুজো করে ডাকাতি করতে বের হতেন। ডাকাতের ভয়ে তটস্থ থাকত বর্ধমান, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষজন। আজ সেই ডাকাত নেই। তবে থেকে গিয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির। যা বর্তমানে ক্ষেপি মায়ের মন্দির নামে সুপরিচিত। কালীমূর্তিটি প্রায় পাঁচ কেজি সোনা এবং ৯ কেজি রুপো দিয়ে সাজানো। রাজ্য ও বাইরের লোকজন আসেন। দীপাবলির দিন মানুষের ঢল নামে। বহু মানুষ রাত জেগে পুজো দেখেন। এই মন্দিরে দেবী দর্শন এবং তাঁর পুজো করা অত্যন্ত পুণ্যের বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।

Latest article