‘‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়…” কিন্তু কখন সময় থমকে দাঁড়ায়? অনন্ত বহমান সময় থমকে যেতে পারে আলোর চেয়ে বেশি গতি পেলে। আর সময় থমকায় শিশুমনে। একশো বছর আগেও শিশু বিছানায় শুয়ে আবদার করেছে গল্প শোনার, এখনও করছে। ‘এক দেশে এক রাজা ছিল ’… ছোটদের মন ছুঁয়ে যাওয়ার মন্ত্র। রাজা, রানি, দুষ্টু রাক্ষস, পক্ষীরাজ ঘোড়া, ময়ূরপঙ্খী নৌকা নিয়ে তারা অনায়াস বিচরণ করে এক অন্য মায়াজগতে। যুগে-যুগে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে এইসব কল্পজগতের মায়াগল্প নানা রূপে, যাদের নাম রূপকথার গল্প।
আরও পড়ুন-বিকাশ রায় : অসামান্য অভিনেতা, সাহসী পরিচালক
নানা দেশে নানা এইসব রূপকথার গল্প আছে নানা রূপে। একদেশে কল্পনার আকাশে ড্রাগন ওড়ে তো অন্যদেশে ইঁদুরের গর্তে থাকে বিস্ময় সাম্রাজ্য। একযুগে আকাশে পক্ষীরাজ ওড়ে তো অন্য যুগে ওড়ে জাদু ঝাঁটা, মায়া কার্পেট। কালের প্রবাহ বয়ে চলে কিন্তু শিশু মন আটকে থাকে রূপকথার গল্পে।
খুব অনেকদিন আগেকার কথা নয়, একশো ছেচল্লিশ বছর আগের কথা। অবিভক্ত বাংলায় ঢাকার উলাইল গ্রামে জন্ম হল এক কলমকারের। যিনি ভবিষ্যতে বিখ্যাত হবেন লেখক নন, সংগ্রাহক হিসেবে। ঠাকুরমা, দাদুর মুখে মুখে প্রচলিত শিশুমন ভরানো গল্পগুলি তুলে এমন ঝোলা ভরবেন তা হাতড়ে বেড়াবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এই সংগ্রাহক জাদুকর সবার চেনা, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। বাংলার লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা নানা রূপকথার টুকরো টুকরো মণিমুক্তাগুলো তুলে থলে ভরে ফেললেন; শিশুসাহিত্য সাজল নতুন রূপে। ভারতের দক্ষিণা, ডেনমার্কের হ্যান্স কিংবা জার্মানির গ্রিম— ভৌগোলিক দূরত্ব কমে এসে কেন্দ্রীভূত হয় শিশুমন-প্রাঙ্গণে।
আরও পড়ুন-ফুল পাখি প্রজাপতি বন্ধু, গাছবাড়ি দেবে শীতল আশ্রয়, বজবজে প্রকৃতির পাঠশালা
শিশুমনের একচ্ছত্র সম্রাট সে দখিনা হাওয়ার আবির্ভাব ইংরেজি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ, তারিখ ১৫ এপ্রিল। ইংরেজ শাসনাধীন ভারত, ধীরে ধীরে আলোর পথ খুঁজে পাচ্ছে। অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রেরা দল বেঁধে পৃথিবীতে আসছে বিশেষত বাংলায়, নবজাগরণের স্বপ্ন দেখাতে। ইতিহাসে বাংলার যত বিখ্যাত ব্যক্তির নামের উল্লেখ আছে তার বোধহয় শতকরা নব্বই ভাগ ঊনবিংশ শতাব্দীর— এমন একটা সময়, যখন অগণিত তারকা-সন্তানের আলোয় ঝলমলে বাংলা। সবাই নিজের বিভায় নিজেই প্রতিভাত। সাথে আবার দীপ্ত রবিকিরণ। খর দিবালোকেও যেসব আলো আলাদা করে দেখা যাচ্ছিল তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ঠাকুরমার ঝুলি ভরে রূপকথার গল্প নিয়ে আসা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।
আরও পড়ুন-বাদশার শহরে আজ ইজ্জতের লড়াই
মা কুসুমময়ী ও পিতা রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদারের একমাত্র সন্তান দক্ষিণা। ভাগ্যের নিতান্তই বেয়াড়া কৌতুকে রূপকথা সম্রাট ছোটতেই রূপকথার আঁচল বঞ্চিত। দশবছর বয়সে মাতৃহারা সে বালক কিঞ্চিৎ বেশি বয়সেই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ঢাকার কিশোরীমোহন উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে ১৮৯৩ সালে, কিশোরীমোহন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দক্ষিণারঞ্জণকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এ-দুটি বিদ্যালয়ে থাকার সময় পড়ালেখায় ভাল করতে না পারায়, টাঙ্গাইলে দক্ষিণারঞ্জনের পিসি রাজলক্ষ্মী চৌধুরানি নিজের কাছে রেখে সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয়ের বোর্ডিং-এ থেকে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। বিদ্যালয়ের অধ্যয়ন শেষে পিতার সঙ্গে ২১ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদে গিয়ে সেখানে পাঁচ বছর বাস করেন।
আরও পড়ুন-মেহুল প্রত্যর্পণে বড় ধাক্কা খেল কেন্দ্র, সিবিআই, ইডির ব্যর্থতা
মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাইস্কুলে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। এরপর কৃষ্ণনাথ কলেজে এফএ। দক্ষিণারঞ্জনের বাবা রমদারঞ্জন এইসময় মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর টাঙ্গাইলে পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে বসবাস শুরু করেছিলেন। ছোট থেকেই মাতৃহারা বালকটির ইনি ছিলেন একমাত্র মাতৃসম স্নেহছায়া।
আরও পড়ুন-নদীভাঙন সমাধানে বাংলার সঙ্গে রয়েছে নেদারল্যান্ড
ছোটবেলায় মাতৃহীন বালকটি পিসিমার স্নেহ আঁচল বুকে চেপে ঘুমালেও কখনও কি রাতের অন্ধকারে ভয় পায়নি? আকাশের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ আর কান ফাটানো আওয়াজে দিশা হারায়নি? মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে ‘এক যে ছিল রাজা’ শোনার সৌভাগ্য তার হয়নি। সেদিনের সেই বালক নিজেই বুঝেছিল বৈভব নয়, শিশুমন ঘিরে থাকে কিছু কল্পজগৎ কিছু গল্পজগৎ। তাই ছোটবেলায় পিসিমার মুখে শোনা গল্পগুলো, গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে থাকা লোককথাগুলো, গীতি-কবিতাগুলো, আর প্রচলিত ব্রতকথাগুলো সযত্নে সংগ্রহ করেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের লেখা ও সংগৃহীত রূপকথা কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছাপা হতে আরম্ভ করলে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এভাবে এক সময় প্রস্তুত হয়ে যায় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পাণ্ডুলিপি। প্রকাশক না পেয়ে নিজের অর্থেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশে উদ্যোগী হন দক্ষিণারঞ্জন। এ সময়ই আকস্মিকভাবে রূপকথা-লোকগীতি সংগ্রহের আরেক কিংবদন্তি দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে আসে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রুফ কপি। অবশেষে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগেই সেকালের বিখ্যাত প্রকাশক ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯০৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। বাংলাসাহিত্যে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব আলোড়ন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে লাগে সে আলোড়নের ঢেউ। এতদিন সাহিত্যের আঙিনা খোলা ছিল বড়দের জন্য। প্রবল দখিনা বাতাসে সাহিত্যজগতে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হয়ে উঠল শিশুসাহিত্য।
আরও পড়ুন-পুলিশের সামনেই আততায়ীদের হাতে খুন ‘গ্যাংস্টার’ আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই
লেখক যখন শিশুসাহিত্য রচনা করেন তখন তিনি ফিরে যান তাঁর শৈশবের দিনগুলোতে। সেই সময় তাঁর কী ভাল লাগত, কী ইচ্ছে হত, কী পেয়েছিলেন আর কী পেতে চেয়েছিলেন আর কী পাননি এইসবের মিলিত ধারা আর পরিবেশ নামক গণ্ডি পুষ্ট করে শিশুসাহিত্যকে। দুশো কি আড়াইশো বছর আগে এই কল্পনা জগতের ডানা মেলা শুরু। বেট্রিক্স পটার, লুই ক্যারোল, রুডিয়ার্ড কিপলিং কিংবা হাল আমলের রাউলিং,খাঁটি দেশি ধারায় দক্ষিণারঞ্জনের পাশাপাশি যোগীন্দ্রনাথ উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার সত্যজিৎ, লীলা, রবীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর, সুখলতা, স্বপনবুড়ো, আরও লিস্ট বাড়তেই থাকবে। আর চিত্র সাহিত্য হলে নারায়ণকে জগৎপ্রভু বলা যেতেই পারে। এর পরে শিশু সামান্য বড় হলেই কিশোরজগৎ— সেখানে আবার ভাললাগা বদলে যায় বেশ খানিকটা। অল্প বাস্তব ঢুকেই পড়ে বয়সের সাথে। সেখানে তার জগৎ অনুসন্ধানের ‘এক দেশে এক রাজা ছিল’ বললেই সে হয়তো প্রশ্ন তুলবে কোন দেশে, কোন জেলায়… ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর আবিষ্কার নয়া দার্জিলিং লামাহাটা
শিশুসাহিত্যে এখন বিচরণ লেখকের পক্ষে তুলনামূলক কঠিন। দুশো বছর আগে শিশুর শৈশব ছিল, কল্পজগতে বিচরণ করার অফুরান সময় ছিল। গুগল, ম্যাপ, উইকি এমনকী ডিকশনারিও সবসময় ছিল না। ইউনিট, ব্লক, কম্পিউটার কোর্স ছিল না, সবেতেই ফার্স্ট হওয়ার মাথাব্যথাও ছিল না। এমন একটা সময় শিশুসাহিত্যের স্বর্ণযুগ চলছিল যখন শিশু তার শরীরে ও মনে শিশু ছিল। এখন পটচিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। সেই অর্থে শিশুসাহিত্য আর কিছু নতুন করে ভাবতে পেরেছি কই! তিন বছরের মধ্যে তিন কেজির বিদ্যে বয়ে, সারাদিন মগজে ফার্স্ট আর ফাস্ট শব্দ দুটো ঠুসে আর যা-ই আসুক, কল্পনা আসার সময় পায় না, খুব বেশি হলে হগওয়ার্থ স্কুলে ডাইনিবিদ্যা শিক্ষা পর্যন্ত ভাবনা ঢোকে স্কুল বাস্তবতার ছোঁয়া আছে বলে হয়তো। এখন শিশুসাহিত্য অনেকটাই বদলে গেছে। তাহলে শিশুসাহিত্য সমকালীন হতে গিয়ে কীভাবে তার বদল ঘটাবে এটাই আসল প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-১৫ জনের সই, এবারও নেতা সেই অভিষেক
একটা সময় যখন মানুষের জীবনে খুব বেশি বিনোদনের উপাচার ছিল না। ছোটদের তো নয়ই। শুধু শেষের দুটো দশক বাদ দিয়ে গত শতাব্দীর কথাই যদি ভাবা যায়, স্কুলে পুজোর ছুটি, গরমের ছুটিতে বই থাকত বাড়িতে শিশু থাকত মামাবাড়িতে। বড় শহরের অত্যন্ত ধনী পরিবার বাদ দিলে টেলিভিশন তখন অধরা মাধুরী; কম্পিউটার,মুঠোফোন কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো। দল বেঁধে খেলা, গল্প নিয়ে বাচ্চারা দিনে ব্যস্ত থাকত। বর্ষার রাতে রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দে কিংবা শীতে লেপের ওমে ঠাকুমা কিংবা দিদিমার কাছে গল্প শোনাটা শৈশব জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হিসাবে ভাবা হত।
আরও পড়ুন-রাম-বাম-কং হাত মিলিয়ে গোহারা হল তৃণমূলের কাছে
মা-পিসি-মাসিদের গল্পেও থাকত ‘লালকমল আর নীলকমলে বড্ড দেখি ভাব’-এর সুর। সেই গল্পের রেশ থেকে যেত অনেকদিন। সেসময় শৈশব কাটানো একটা মানুষ এখন কখনও কোনও পুরনো ভাঙা প্রাসাদ বা রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে তার মনে ইতিহাসের আগেই ভেসে ওঠে রাজা, রানি, সেপাই কোটাল আর রাজপুত্রের ছবি। আজকের শৈশব কি এতটাই খায় মানুষ পশুপক্ষীকে, কিন্তু আস্ত রূপকথাকে গিলে ফেলল কে আজকের শিশুদের অতি-প্রাপ্তি নাকি বেশি বাস্তবতা নাকি আরও অন্য কিছু?
আরও পড়ুন-সভাস্থলে আচমকা বিস্ফোরণ, কোনমতে রক্ষা পেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী
শিশু মন কি সময়ের সাথে বদলে গেল? বস্তুজগতে আলোর গতিবেগ ছাড়া সবই আপেক্ষিক তাই সময়ের সঙ্গে সবই পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই পরিবর্তন আদৌ স্বাভাবিক না প্রতিস্থাপিত এটা দেখার বিষয়। আজকের শিশু কি রূপকথার গল্প শুনছে না? বাস্তব বলছে, তাকে শোনানো হচ্ছে না। আজকের শিশুকে অতিরিক্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, অতীতকে দেখার সময় নেই। শিশুমন সবদিন কল্পনার জগৎ খোঁজে। সেখানে তাদের শৈশব বিক্রি হচ্ছে সেমিস্টারে, ব্লকে, ইউনিটে। কল্পনা না থাকলে শিশু ছবি আঁকে কীভাবে? নিজে বানিয়ে গল্প বলে কীভাবে? অতিরিক্ত কেরিয়ারিস্টিক ভাবনা, হাইড্রোজেন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি আর সময়ের পিছনে ছুটে-চলা বাবা-মায়েরা আসলে সঠিক বীজ বপনের অভাবে শিশুর শৈশব হত্যা করছে নির্বিবাদে। ব্যস্ত মা বাবা, সময় নেই, মাতৃভাষা নেই, পিসি নেই, মাসি নেই, মামা নেই, কাকা নেই, ঠাকুরমা নেই, দাদু নেই, দিদা নেই— আজকের শিশুর একটাই আছে এক অনন্ত প্রতিযোগিতার হাতছানি— প্রথম হওয়ার শপথবাক্য পাঠ। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো এর পর আছে কোভিড-পরবর্তী সময়ে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের অনন্ত অনলাইন বিচরণ। সাঁতারের ক্লাসও অনলাইনে হয় যে! কে তাকে রূপকথার গল্প শোনানোর মতো বাজে সময় নষ্ট করবে?
আরও পড়ুন-১৫ জনের সই, এবারও নেতা সেই অভিষেক
অথচ শিশুমন খোঁজে রূপকথা। শিশুমনে রূপকথার বীজ বপন করে তাতে জলসিঞ্চনের লোকের অভাব। ভাল বীজের অভাব। শিশুসাহিত্য এমন হবে, যেখানে শিশুর কল্পনার জগৎ বিকশিত হবে, বড়রা খুঁজে পাবে তাদের শৈশব— সেরকম ছোটদের মন ভরানো শিশুদের সাহিত্য তৈরি হচ্ছে কই? ছোটদের হাজার ব্যস্ত জীবন হলেও সঠিকভাবে শিশুমন ছুঁয়ে যাওয়া লেখার কদর আজও আছে। আর সেটা না হলে হ্যারি পটারের সাতকাহনের এত রমরমা হল কীভাবে? তাহলে কি বাংলা রূপকথা কালের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে? মোটেই না। আজও বইমেলায় দিব্য বিক্রি হয় ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলির নতুন রঙিন রূপে। বাংলা না-জানার গর্ব-ঝলমল মা-বাবারা শিশুকে দেন প্রীতিশ নন্দী-কৃত ঠাকুরমার ঝুলির ইংরেজি অনুবাদ। নতুন কিছু করে দেখাতে না পারাটা অবশ্য আমাদের দোষ। শিশুমন তাই যা পেয়েছে তাকেই আঁকড়ে ধরতে চায়। এখানেই সেইভাবে লেখক না হয়েও সংগ্রাহক দক্ষিণারঞ্জন হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ।
আরও পড়ুন-বাবাসাহেব আগেই বলেছিলেন
শুধু রূপকথা ও লোককথা সংগ্রাহক নয়, তাঁর স্বদেশি গানের সংকলনের নাম ‘আহুতি’। ভারতীয় নারীচরিত্রের মহিমাজ্ঞাপক গ্রন্থ আর্য্যনারী এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মচিন্তা-বিষয়ক শিশুপাঠ্য গ্রন্থ সচিত্র সরল চণ্ডী প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত তোষণী পত্রিকায় তাঁর লেখা চারু ও হারু নামক কিশোর উপন্যাসটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয়। শিশু-কিশোরদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি অজস্র কবিতা, গল্প, জীবনী রচনা করেন। ১৯৩০-’৩৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণারঞ্জন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। এ-ছাড়া বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সমিতি’র কার্যকরী সভাপতি ও পরিভাষা রচয়িতার দায়িত্ব তিনি পালন করেন। ঢাকা বান্ধবসমাজ তাঁকে ‘কাব্যানন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি কলিকাতা সাহিত্য সম্মেলনে ‘বাণীরঞ্জন’ উপাধি, শিশুসাহিত্য পরিষদের ‘ভুবনেশ্বরী পদক’ লাভ করেন। লোকসংস্কৃতি পরিষদ, সব পেয়েছির আসর, নন্দন, সাহিত্যতীর্থ প্রভৃতি সংস্থা তাঁকে সম্মানিত করে। বাংলার লুপ্তপ্রায় কথাসাহিত্যের সংগ্রহ ও গবেষণা করেন। পরে এই সংগৃহীত উপাদানসমূহ ও ড. দীনেশচন্দ্র সেনের উপদেশানুযায়ী রূপকথা, গীতিকথা, রসকথা ও ব্রতকথা— এই চারভাগে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গের পল্লি-অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় বিপুল কথাসাহিত্যকে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’, ‘দাদামশায়ের থলে’, ‘ঠানদিদির থলে’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থে স্থায়ী রূপদান করেছেন। ১৯০১ সালে দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদিত মাসিক ‘সুধা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘উত্থান’। নিজের বইয়ের ছবি এবং প্রচ্ছদগুলো সব সময় তিনি নিজেই আঁকতেন। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন অসাধারণ দারুশিল্পীও। কাঠের শিল্পকর্মে পটু ছিলেন। তিনি বাংলায় বিজ্ঞানের বহু পরিভাষা রচনা করেন। হাজারো গুণের মাঝেও অমরত্বের রহস্য লুকিয়ে আছে সেই ঠাকুরমার ঝুলিতেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, জ্যোতিষ্কের আকর্ষণে সূর্যের কাছে আসা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ভূমিকা লেখেন।
আরও পড়ুন-মালদহে দশ হাজারের বেশি পড়ুয়াকে শিক্ষাশ্রী সুবিধা
‘‘দক্ষিণাবাবুকে ধন্য। তিনি ঠাকুরমা’র মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে; রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।
আরও পড়ুন-নাম না করে স্পিকারের তোপ সেই বিচারপতিকে
এক্ষণে আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের আধুনিক দিদিমাদের জন্য অবিলম্বে একটা স্কুল খোলা হউক এবং দক্ষিণাবাবুর এই বইখানি অবলম্বন করিয়া শিশু-শয়ন-রাজ্যে পুনর্বার তাঁহার নিজেদের গৌরবের স্থান অধিকার করিয়া বিরাজ করিতে থাকুন।” দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকে বাংলা হারিয়েছে ১৯৫৬ সালের ৩০ মার্চ। ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকায় রবিঠাকুরের লেখা কথাগুলি তাঁকে নিয়ে লেখা যে কোনওসময় যে কোনও প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত অথচ সারকথা।