নারীর সম্ভ্রমহানির সমর্থক বিজেপি দূর হটো

সাভারকরের কথা মেনেই বোধ হয় বিজেপি বিরোধী পক্ষকে দমাবার জন্য নারী- নির্যাতনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। লিখছেন শমিত ঘোষ

Must read

এ যেন উলোটপুরাণ! গোটা দেশ তাঁকে দেখেছে, দিল্লির রাজপথে ‘গোলি মারো শালেকো…’ স্লোগান দিয়ে বিরোধীদের সন্ত্রস্ত করতে। সেই স্লোগানের জন্য নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল দেশ জুড়ে। সিএএ এবং এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে তাঁর সেই তর্জনী উঁচিয়ে স্লোগান এবং দেশের রাজধানীতে ভয়াবহ দাঙ্গা— সবটাই দেখেছে দেশবাসী। তাঁর ‘হেট স্পিচ’ বা ‘ঘৃণা ভরা ভাষণ’ নিয়ে মামলা হয়েছে বিভিন্ন আদালতেও। অথচ বিজেপি (BJP) নামক রাজনৈতিক দলটিতে পদোন্নতি পেতে হলে ঘৃণা ছড়ানোটাই একমাত্র এবং সহজতম পদ্ধতি। তিনিও সেটিই করেছিলেন৷ তাই দিল্লি-দাঙ্গার বছরখানেক বাদেই ‘রাষ্ট্রমন্ত্রী’ থেকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়ে গেলেন। পেলেন ক্রীড়া ও তথ্য-সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর! কিন্তু এহেন মন্ত্রিমশাই যিনি ঘৃণার সম্ভাষণে সিদ্ধহস্ত তিনিই যখন, শান্তির ললিত বাণী শোনান তখন বেশ হাসি পায়।

সম্প্রতি, অনুরাগ ঠাকুর বাংলায় এলেন। যদিও এই ঘটনার মধ্যে আর নতুনত্ব কি? সে তো কতই বহিরাগত বিজেপি নেতা প্রতিদিনই বাংলায় আসেন রাজনৈতিক পর্যটক হিসেবে। ইনিও তেমনি ভাবেই এলেন। এবং এসেই রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করলেন। বঙ্গ-বিজেপির (BJP) নেতারা সম্ভবত অনুরাগকে বোঝালেন, যে বাংলায় এসে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইলে একমাত্র উপায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করা! তবেই আপনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন। নয়তো বিজেপির ওই বস্তাপচা বক্তব্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসা হবে না। অনুরাগ সেইটিই করলেন। বলাবাহুল্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কয়েকদিন আগেই মণিপুরের ঘটনা নিয়ে বলতে গিয়ে এরকমই কিছু বক্তব্য রেখেছিলেন। বিজেপির এই এক বিড়ম্বনা। একের পর এক রাজ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে, যা লজ্জায় মাথা হেঁট করে দিচ্ছে গোটা দেশের। আর বিজেপির তাবড় নেতারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন কীভাবে কখনও রাজস্থান কখনও ছত্তিশগড়, কখনও বাংলার কোনও ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করা যায়৷ মণিপুরের সাম্প্রতিকতম ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও সেই ঘটনা নিয়ে সমালোচিত হতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে। গোটা বিশ্বের সামনে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ দেখানো নেতার ইমেজ বাঁচাতে বাজারে নামতে হচ্ছে বিজেপির ছোট-বড়-মেজো নেতা-নেত্রীদের। কখনও বাংলার গ্রামীণ কোন্দলকেই রাজনৈতিক রঙ দিয়ে ‘অতি-অভিনয়ের দোষে দুষ্ট’ কান্নার অভিনয় করতে হচ্ছে বিজেপি-নেত্রীকে। কখনও অনুরাগ ঠাকুরদের বাংলায় পাঠাতে হচ্ছে, গোটা দেশের কাছে বাংলার ভাবমূর্তি খারাপ করার জন্য! কিন্তু এসব করেও বিজেপি মণিপুরের ঘটনা এবং সেই ঘটনার অভিঘাত থামাতে পারছে না। পারাটা সম্ভবও নয়।

আরও পড়ুন- মণিপুরের পাপ ঢাকতে অন্য রাজ্যের তুলনা কেন? সুপ্রিম ভর্ৎসনা কেন্দ্রকে

প্রধানমন্ত্রী নিজের ৬ সেকেন্ডের ‘বাইট’ দেওয়া ছাড়া এখনও নীরব। এখনও অবধি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হচ্ছে না মণিপুরে। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং-কে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী! স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে বিজেপি নিজেরা কতটা চায়, এই অশান্তি থামাতে? তাই, মণিপুরের থেকে নজর ঘোরাতে বিজেপি বাংলায় কখনও নিজেদের মহিলা সাংসদদের পাঠাচ্ছে। কখনও অনুরাগ ঠাকুরদের। কারণ, বিজেপি জানে, মণিপুরের ঘটনা নিয়ে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। অনুরাগরা বাংলার নাগরিকদের নিয়ে খুব চিন্তিত কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ভুলে গেছেন যে, এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে সামাজিক অপরাধ এবং নারীদের ওপর নির্যাতনের হার বাংলার চেয়ে অনেক বেশি। কয়েকদিন আগেই মধ্যপ্রদেশে দলিত মহিলাদের ধর্ষণের খবর দেখে লজ্জিত হয়েছি আমরা। সেখানে কিন্তু বিজেপির (BJP) ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম’ যায়নি। অনুরাগের মতো নেতারাও সেখানে যান না। অথচ দেশের সব শহরের মধ্যে মহিলাদের জন্য নিরাপদতম শহর কলকাতায় ছুটে আসেন অনুরাগরা। প্রেস-বাইট দেন। যেখানে মহিলাদের নগ্ন করে ‘প্যারেড’ করানো হচ্ছে আর তাদের তাড়া করছে কয়েকশো উন্মত্ত জনতার দল। স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রীকে জীবন্ত খুন করা হচ্ছে! প্রাক্তন সেনাকর্মীর স্ত্রী-সহ একের পর এক নারীরা ধর্ষিত হচ্ছেন, ৬০ হাজারের ওপর বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, ২৫০-এর ওপর চার্চ ধ্বংস হয়েছে গত ৩ মাসে, সেই বিজেপি- শাসিত মণিপুরে যাওয়ার সাহস নেই খোদ প্রধানমন্ত্রীরই।
কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দল শাসিত রাজ্যেগুলিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাঠিয়ে একই চর্বিতচর্বণ আওড়ানো বিজেপির একটা কৌশল। এই কৌশল জানতে গেলে বা বুঝতে গেলে আমাদের গত কয়েক বছরে এ-দেশের আরও কয়েকটি ঘটনায় আলোকপাত করতে হবে। প্রথমত, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে নারীদের ওপর এরকম অত্যাচার প্রথম নয়। বহু বহু উদাহরণ আছে। বিজেপিই একমাত্র রাজনৈতিক দল, যাদের কর্মীরা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বের করে! উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের সমর্থনে মিছিল করে বিজেপির সমর্থকেরা। গুজরাতের স্বরাষ্ট্র দফতর বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি দেয় আর সেই ধর্ষকদের বীরের সংবর্ধনা দেয় স্থানীয় বিজেপি নেতারা৷ কিছুদিন বাদেই সেই ধর্ষকদের দেখা যাচ্ছে বিজেপির সাংসদ-বিধায়কদের সঙ্গে একই মঞ্চে! নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি (BJP) বরাবরই তাঁদের আদর্শ করেছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ একবার ‘কল্যাণ’ আক্রমণ করেন। শিবাজির সেনারা কল্যাণের মুসলিম গভর্নরের পুত্রবধূকে ধরে নিয়ে আসেন। শিবাজি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেনাদের নির্দেশ দেন, সেই মুসলিম পুত্রবধূর গায়ে যেন কেউ হাত না দেয়। ওই মহিলাকে যেন, তাঁর আত্মীয়দের কাছে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আরেকবার পেশোওয়ার চিমাজি আপ্টে বেসেইন আক্রমণ করেন। সেখানে তখন পর্তুগিজ শাসন।

চিমাজি আপ্টে তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দেন তাঁর কোনও সেনা যেন, পর্তুগিজ গভর্নরের পরিবারের কোনও মহিলার কোনোও ক্ষতি না করে। মহিলারা যেন সুরক্ষিত থাকেন। উপরিউক্ত দুটি ঘটনার উল্লেখ করে বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘সিক্স গ্লোরিয়াস এপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ বইতে লিখছেন শিবাজি এবং পেশোওয়া চিমাজি আপ্টে ভুল করেছিলেন! সেদিন যদি, মুসলিম এবং পর্তুগিজদের রমণীদের ছেড়ে না দিয়ে ধর্ষণ করা হত তাহলে ভবিষ্যতে হিন্দুরা সুরক্ষিত থাকত! অর্থাৎ সাভারকার ধর্ষণকে একটি ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে দেখেছেন৷ সেই আদর্শের পরম্পরার প্রতিফলন আজকের বিজেপির মধ্যে।

Latest article