প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার আর্যাবর্ত। দিনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।
রাতের অন্ধকার কেটে সবকিছু পরিষ্কার। সবকিছু স্পষ্ট।
উরুবিল্ব বন থেকে বেরিয়ে এলেন বুদ্ধ। বেরিয়ে এলেন তাঁর মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি সাধারণের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন বলে। এই অন্তর্দৃষ্টি তিনি অর্জন করেছেন তপশ্চর্যার ফলস্বরূপ।
আরও পড়ুন-গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অলরাউন্ডার
এই অন্তর্দৃষ্টি, এই অভিজ্ঞতা, এই শিক্ষা, চলে আসা পরম্পরাকে নস্যাৎ করে না। টের পান বুদ্ধ বুকের গভীরে। একই সঙ্গে আর একটা বোধ মাথা তোলে তাঁরই হৃদয় কন্দরে। এই নবলব্ধ বোধ জীবন সত্যের অন্বেষককে বিশ্বাসের ভূমি থেকে অভিজ্ঞতাসঞ্জাত প্রত্যয়ের উপত্যকায় পৌঁছে দেয়। এ অচেনা পথ ধরে বিশ্বাসে ভর করে হাঁটা নয়। এ হল অভিজ্ঞ নাবিকের মতো নিজের মতো করে নিজের গতিপথ শনাক্তকরণ। এ তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন।
তাঁর শেখা এই নতুন পথ, তাঁর পাওয়া এই নতুন আলো, তাঁর উপলব্ধি করা এই নতুন জ্ঞান, তিনি চেয়েছিলেন তাঁরই প্রাক্তন শিক্ষকদের সঙ্গে প্রথমে ভাগ করে নিতে। প্রাক্তন শিক্ষক মানে দুইজন, আলার কালাম আর উদ্দক রামপুত্র। কপিলাবস্তু ত্যাগের পর, ঘর-সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার পর, ওঁদের কাছেই গিয়েছিলেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। দু’জনেই তাঁকে সাদরে শিষ্যত্বে বরণ করেছিলেন। কেউ তাঁকে ফেরাননি। কিন্তু কেউই তাঁকে ভরাননি।
আরও পড়ুন-চিকেন-ফুচকার অভিনব স্বাদ পাবেন ফুচকা গ্রামে
প্রথমে গিয়েছিলেন আলার কালামের কাছে। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত যোগগুরু। তিনি তাঁকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে শূন্যভাবে পৌঁছতে হয়। কালাম অবাক হয়ে দেখেছিলেন, কীভাবে অনায়াস দক্ষতায় সিদ্ধার্থ তাঁরই সমান স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। গুরুর সমতুল হয়েও কিন্তু তৃপ্ত হয়নি শিক্ষার্থীর অন্তঃকরণ। সেখানে যে তখনও অনায়ত্ত নির্বাণ। জন্মহীন, জরাহীন, ব্যাধিহীন, দুঃখহীন, মৃত্যুহীন, তাবৎ বন্ধনহীন, সেই মানস স্তর। শূন্যত্বে পৌঁছেও সেখানে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না।
অনুত্তীর্ণ মননে হতাশার গাঢ় শ্বাস পল রচনা করে। সিদ্ধার্থ নিজেকে সমর্পণ করেন না কালের হাতে। জারি রাখেন খোঁজ। অনর্গল হয় তাঁর অন্বেষণ। আর সেভাবেই তিনি পৌঁছে যান রাজগৃহে। সেখানে পেয়ে যান আর এক গুরুকে। উদ্দক রামপুত্রকে। তাঁর কাছে তিনি শেখেন কীভাবে ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে, বোধ থেকে বোধাতীতে পৌঁছে যেতে হয়। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সেই মনঃস্তরে নিজেকে উত্তীর্ণ করেন সিদ্ধার্থ। কিন্তু তাও অতৃপ্ত থাকে চিত্ত। কারণ, তখনও কাটেনি তাঁর যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার আবেগ, তখনও ঘোচেনি তাঁর বাসনার দপদপানি। কারণ, তখনও ছুঁতে পারেননি তিনি সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানবিন্দু, যা তাঁকে থিতু করবে নির্বাণে। সেখানে কোনও টানাপোড়েন নেই। সেখানে তাবৎ জীবন-অন্বেষ উদ্দিষ্ট সীমা খুঁজে পায়। সেখানে আলেয়া নয়, নক্ষত্রেরা নয়, গ্রহেরা জ্বলে। ধ্যানের গভীরে পৌঁছে সিদ্ধার্থ টের পান, আত্মোপলব্ধি তখনও অধরা। উদ্দক রামপুত্র বলেছিলেন, তাঁর আশ্রমে গুরু হয়ে জাঁকিয়ে বসুন সিদ্ধার্থ। তিনি আপন আসন ছেড়ে দিচ্ছেন। সিদ্ধার্থ অন্বিষ্টের সঙ্গে আপস করেননি। একটা সম্প্রদায়ের আচার্য হতে তিনি ঘর ছাড়েননি। তাই আবারও বেরিয়ে পড়েছিলেন পথে। নির্দিষ্ট কিন্তু অনুপলব্ধ দিশায় পৌঁছে যাওয়ার তাগিদে।
আরও পড়ুন-মুর্শিদাবাদে ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক আদালত
কিন্তু সেসব অতীত। উরুবিল্ব থেকে নির্গত হয়েছেন, সিদ্ধার্থ নন, শাক্যমুনিও নন, বুদ্ধ।
এখন তিনি জেনে গিয়েছেন নির্বাণ কী।
এখন তিনি বুঝে গিয়েছেন নির্বাণের আনন্দস্বরূপ।
কোনও গুরুর দেখানো পথ ধরে নয়। কোনও বিশ্বাসের লাঠিতে ভর করে নয়। সেখানে উত্তরণ তাঁর সফল হয়েছে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আপন অনুভূতির প্রদীপ জ্বেলে চিনেছেন তাঁর পথ। আপন উপলব্ধ জ্ঞানের প্রত্যয়ে সংশয়ে নিশ্চিত হয়েছে সে পথের নির্মাণ। কোনও পূর্ব নির্ধারিত বিশ্বাসের জোরে নয়, প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতা তাঁকে এগিয়ে দিয়েছে সামনের বাধা কাটিয়ে ওঠার প্রকৌশলের দিকে। এভাবেই জঙ্গমতার অন্তে স্থবিরতা এসেছে। সংক্ষুব্ধ প্রহরের পর নেমেছে শান্তি। অগম্য পথরেখা হয়েছে মসৃণ। আর সিদ্ধার্থ বোধিত্ব অর্জন করেছেন।
আর আজ, সেই জ্ঞান, সেই অভিজ্ঞতা, সেই শিক্ষা যখন নিজের শিক্ষকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন শাস্তা, তখন তিনি জানলেন, দু’জন শিক্ষাগুরুই লোকান্তরিত। আলার কালাম আর উদ্দক রামপুত্র, কেউই বেঁচে নেই নিজেদের চোখের ধুলো সরিয়ে নির্বাণের হদিশ পাওয়ার জন্য।
ফলে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হল বুদ্ধদেবকে।
আরও পড়ুন-জাতীয় ফুটবল দলে আদিবাসী পাপিয়া
সিদ্ধান্ত বদলে ঠিক করলেন, দু’জন গুরুকে নয়, পাঁচজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন নিজের তপশ্চর্যার অসামান্য অভিজ্ঞতা। সেই পাঁচজন কে কে হবেন, কোথায় কোথায় তাঁরা থাকেন, কী তাঁদের বৃত্তি, কেমন তাঁদের প্রবৃত্তি, সেসব বিষয়ে সম্যকভাবে জেনে শাস্তা এগিয়ে গেলেন বারাণসীর দিকে। ঋষিপত্তনার মৃগদাবে থামলেন তিনি। বসলেন শিক্ষকের আসনে।
যা বিশ্বাস করেন সেসব নয়, নিজে যা জেনেছেন বুঝেছেন শিখেছেন, সেসব কথা বলতে লাগলেন এক এক করে। বিশ্বাসীর উচ্চারণে নয়, অভিজ্ঞের অনিবার্যতায় বলিষ্ঠ হল তাঁর দেওয়া শিক্ষা।
প্রথম প্রথম অবিশ্বাসীর কান দিয়ে শুনছিলেন পাঁচজন।
আরও পড়ুন-চিন থেকে সরল এশিয়ান কাপ
সেটাই তো স্বাভাবিক। চিরকাল এঁরা জেনে এসেছেন কঠোর তপশ্চর্যায় গড়ে ওঠে সন্ন্যাসীর জীবন। এতদিন এঁরা বিশ্বস্ত থেকেছেন সেইসব গুরুদের প্রতি, যাঁদের নেতি নেতি অনুরণনে পূর্ণ থাকে জীবনের ভাঁড়ার। আর এই নতুন শিক্ষক তো সেই কাঠিন্যের পথ পরিহার করার কথা বলছেন। এই নবীন সন্ন্যাসী তো আর সবার মতো পরমকে পাওয়ার জন্য চরমকে বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরার কথা বলছেন না।
কিন্তু সেই বলার মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল, যার আকর্ষণ পাঁচজনের কেউই কাটিয়ে উঠতে পারলেন না।
সেই আকর্ষণের বৃত্তটার কেন্দ্রে ছিল অন্যের কাছে থেকে শেখা কোনও জ্ঞান নয়, নিজের, নিজেরই ঠেকে শেখা অভিজ্ঞতা।
তারই জোরে বুদ্ধ বলে চলেন, এভাবেই নির্বাণের পথে যেতে হয়, আসতে হয়। এভবেই চলে তথায় আসা-যাওয়া। তথায় আগত ব্যক্তির এই হল পথ।
আর সেই পথ যিনি জানান চেনান দেখান, তিনি নিজে তথায় আগত।
তিনি তথাগত।
আরও পড়ুন-চক্ষু চড়কগাছ কাটোয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের, ভুয়ো বিলে পুকুরচুরি
সময় যত এগোয় তত উৎকর্ণ হন পঞ্চজন। আকৃষ্ট হন আরও। আরও।
পৌর্ণমাসীর রাত্রি। জ্যোৎস্নায় ভিজে যাচ্ছে চরাচর। মৃগদাবের হরিণরাও কান খাড়া করে শুনতে লাগল সেই বাণী। দিবিলোকে সবার অগোচরে ভিড় করলেন দেবতারা, সেই বাণী শুনবেন বলে।
স্নিগ্ধ চন্দ্রমায় ঘুরতে শুরু করল ধম্মচক্র। উচ্চকিত হল মঝঝিম পন্থা।
ইন্দ্রিয় তৃপ্তির তাড়নার কথা বললেন তথাগত। প্রক্ষোভের উথালপাথাল দশায় নিরন্তর অস্থিরতার কথাও। চেনালেন যন্ত্রণার উৎসে অবস্থিত তৃষ্ণার আসল চেহারা। জানালেন, কোন সে পথ, যে পথে পা ফেললে দুঃখকে অতিক্রম করা যায়। দিলেন সেই মধ্যপন্থার দিশা, যে পন্থার পন্থী হলে কাটিয়ে ওঠা যায় জন্ম-মৃত্যুর কালচক্রকে।
আরও পড়ুন-সুন্দরবনে বাঘের ডেরায় এবার কুমিরের হানা
অমোঘ আস্থা জিতে নিলেন তথাগত, যখন তিনি বললেন, গভীরতায় আর্দ্র অভিজ্ঞতায় দার্ঢ্য গলায়, “যতক্ষণ এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ নিছক বুদ্ধিগম্য, প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে পাওয়া নিছক উপদেশমালা ছিল, ততক্ষণ আমি বুদ্ধত্ব অর্জনের দাবি করিনি। কিন্তু এখন আমি উপলব্ধি করেছি, আমার হৃদয়মথিত এই শিক্ষা প্রশ্নের অতীত, সন্দেহের ঊর্ধ্বে, অভিযোগের বাইরে। এই অনভিযোগ্য, প্রশ্নাতীত, সন্দেহাতীত, অকাট্য শিক্ষার জোরে আমি তোমাদের বলছি, এই আমার শেষ জন্ম। আর পুনর্জন্মের চক্রে থাকব নাকো আমি।”
বললেন, “তোমার সংকল্প হোক সৎ। অন্যের ক্ষতি না করেও নিজের সম্পদ বাড়ানো যায়। সেই পথে হাঁটো। সৎ চিন্তা করো সতত। সহজাত সুচিন্তার প্রদীপটা নিভতে দিও না কখনও। তোমার বলা কথায় যেন সততা থাকে। অসৎ কাজে কখনও হোয়ো না লিপ্ত। অযথা হত্যা, অহেতুক হানাহানি, চুরি করে লাভবান হওয়া, সংযমের বাঁধ ভেঙে ফেলে নিজেকে এবং নিজের চারপাশকে ভাসিয়ে দেওয়া, এসব করে বোসো না কখনও। সৎ জীবন যাপন করো সর্বদা। তোমার কোনও চেষ্টায় যেন চালাকি না থাকে, যাবতীয় চেষ্টা যেন সৎ হয়। পবিত্র ও ন্যায়সঙ্গত হোক তোমার জীবনের পথে চলা, নিরবচ্ছিন্নভাবে। জীবনকে দেখ সৎভাবে। বাসনার ঠুলি যেন তোমার সৎ দৃষ্টিকে আড়াল না করে। সৎ সংকল্প, সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কার্য, সৎ জীবন, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ দর্শন, এদের নিরন্তর অনুশীলনে আসে সম্যক সচেতনতা। তখন তুমি দেহে ও মনে সবসময় সজাগ থাকবে। আর জীবন যাপনের এই আটটি কলার মান্দাসে চড়ে তুমি পৌঁছে যাবে নির্বাণের চড়ায়।”
আরও পড়ুন-অযোধ্যা পাহাড়ে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল
এই জ্ঞানের ঢেউ প্রথম যাঁর মন-কোটরে চৈতন্যের টোকা দিয়ে গেল, তিনি হলেন কৌন্দিন্য। প্রবীণ তাপস। বুদ্ধ তাঁকে আহ্বান জানালেন দিব্য জীবনে। তথাগত তাঁকে বললেন, “এস ভিক্ষু! মার্গ দর্শন শেষে প্রবিষ্ট হও এই পূত যাপনের বলয়ে। তাবৎ যন্ত্রণাকে নস্যাৎ করো আট তারে বাঁধা জীবনে।”
এক থেকে আর এক। তার থেকে আরও এক। প্রাণে প্রাণে শিখায় শিখায় সংযোজিত হয় দিব্য জ্ঞানের আগুন। তমসা কেটে গিয়ে রচিত হয় প্রদীপ্তির বলয়। ঔজ্জ্বল্যে মুছে যায় গতানুগতিক জীবন পথে চলার ইচ্ছেটুকু। দুঃখহীন আকাশের ঠিকানা ডানায় লিখে নেয় একের পর এক নির্বাণোন্মুখ পাখি।
শ্রমণের সংখ্যা বাড়ে। বেড়েই চলে। সেই প্রসারমানতায় নিশ্চিত হয় সংঘের গঠন। শাস্ত্র পুঁথি বলছে, বৌদ্ধ সংঘে প্রথম যোগ দিয়েছিলেন ছয়জন অর্হৎ। অর্হৎ মানে অরিহন্ত। অর্থাৎ, যারা নিজেদের অন্তঃস্থিত অরি বা শত্রুদের হন্তারক। ক্রোধ, আসক্তি, অহংকার আর লোভের মতো শত্রুসংহারক বিজয়ী তিনি। সম্যকভাবে সচেতন এক মানুষ তিনি, যিনি শত অসুবিধা অপমানেও রেগে যান না, অযুত লোভের মধ্যেও নির্লোভ থাকেন, অসংখ্য প্ররোচনা সত্ত্বেও অহমিকার প্রদর্শন করেন না, অগুন্তি আকর্ষণেও তাঁকে টলানো যায় না।
আরও পড়ুন-‘আইপিএলে এটাই শেষ’: রায়াডুর ‘অবসর’ ওড়াল সিএসকে
আর এই ছয়জনের পরে এলেন যশ। বারাণসীর এক ধনী ব্যবসায়ী।
একদিন সকালে দিনের আলোয় ভরা পৃথিবীতে জেগে উঠে তাঁর মনে হল তিনি নিঃস্ব। নিযুত ধনের আগারে বসেও তিনি নির্ধন।
চারিদিকে তখনও ঘুমিয়ে আছে তাঁর রাত-বিলাসের নারীরা।
কারও চুল খোলা, বসন আলুথালু। শরীরের আড়াল হারানো, বস্ত্র সরে যাওয়া বিভঙ্গে কোনও আনন্দ ইশারা খুঁজে পান না যশ।
কারও ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। ওই ঠোঁটে আগের রাতে ঠোঁট চুবিয়েছিলেন তিনি, ভাবলেই সারা শরীর ঘিন ঘিন করে ওঠে যশের।
কেউ আবার সুষুপ্তির মধ্যেই অব্যাহত রেখেছে অশ্লীল বিড়বিড়ানি। সাতসকালে ওই সব শব্দে নিজেকে নোংরা বলে মনে হয় যশের।
আরও পড়ুন-আই লিগ অধরা মহামেডানের, টানা দু’বার ভারতসেরা গোকুলাম
রাতভর রতিযাপনের পর সকালের এই পচাগলা পরিপার্শ্ব দেখে বমি পায় যশের। ঘর ছাড়েন। চলে আসেন হরিণ উদ্যানে। যেখানে বিরাজ করছিলেন তখনও তথাগত। যোগ দেন সংঘে।
এর পরই ঢল নামে অনুগামীর। বারাণসীর বণিক পরিবারগুলোতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় বুদ্ধের শিষ্য হওয়ার জন্য। নারী, পুরুষ, তরুণ, প্রবীণ নির্বিশেষে, সবাই শিষ্যত্ব গ্রহণে আগ্রহী। শিষ্যত্ব গ্রহণ মানেই শ্রমণ হওয়া নয়। অনুগমন মানেই সংসারবিবিক্ত সন্ন্যাসযাপনের দীক্ষা গ্রহণ নয়। তবে বৌদ্ধের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তে থাকে শ্রমণের সংখ্যাও।
একে একে একষট্টি।
শ্রমণ সংখ্যা ৬১-তে পৌঁছলে বুদ্ধ নির্দেশ দেন, “এবার ছড়িয়ে পড় চারিদিকে। গৃহীদের মধ্যে। প্রচার কর অষ্টাঙ্গিক মার্গের সহজ সত্য। দুঃখ জয়ের দিব্য মন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না। স্রেফ পালন করে ফললাভ করতে পারে যে কেউ।”
সেই সঙ্গে সতর্ক করে দেন, “যাও। কিন্তু দু’জনে একই সঙ্গে অভিন্ন গন্তব্যে যেও না। দিকে দিগন্তে যাও, পৃথক পৃথক ভাবে। ভিক্ষুকের দল, জেনো, এই ধম্ম শুরুতে, মধ্যপথে, অন্তে, সর্বথা কল্যাণপ্রদ। তাই এর প্রচার আবশ্যক।”
বেরিয়ে পড়েন শ্রমণরা। একা একা। কিন্তু অভিন্ন উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন-দলীয় কর্মীদের রাজনৈতিক পাঠ
আর্যাবর্তের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে তিনটি প্রার্থনার মন্ত্র। বৌদ্ধ জীবন গ্রহণের আকুতিমেদুর বাক্যত্রয়ী।
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
ধম্মং শরণং গচ্ছামি।
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।
আমি বৌদ্ধিক সত্তার আশ্রয় নিলাম। আর স্রেফ বিশ্বাসের ভেলায় নিজেকে ভাসাব না।
আমি মানব ধর্মের শরণাপন্ন হলাম। যা কিছু অমানবিক, মানবকল্যাণের পরিপন্থী তার থেকে নিজেকে মুক্ত করব।
আমি সংঘবদ্ধ জীবনের অঙ্গীকার করলাম। একক তপস্যা, জনবিচ্ছিন্ন জীবন কিংবা ভিড় থেকে সরে গিয়ে স্রেফ আত্মসুখে মগ্ন থাকার যে যাপন কৌশল, তার থেকে বেরিয়ে আসার শপথ নিলাম। জোটবদ্ধ জীবনই আমার যাপন। একসঙ্গে অভিন্ন আস্থায় আশ্বস্ত জীবধর্ম পালন হবে আমার আগামী। পথভোলা পথিকের দলে, উদভ্রান্ত সন্ন্যাসীর কিংবা দিগভ্রষ্ট সংসারীর দলে ভিড়ব না। দুঃখ জয়ের পথ চেনে যারা সেই শ্রমণদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হব আমি।
আরও পড়ুন-বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগেই ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা বিপ্লব দেবের, কী বলছে তৃণমূল
অবসান হল অজ্ঞানের রাতি। দপ দপ করতে করতে নিভে গেল ঘরে ঘরে কালিমামলিন বাতি। নিখিলের আলো তথাগতের দীপ্তিতে জ্বলে উঠল ভারত-গগনে। বুদ্ধ- প্রদর্শিত পথে যারা চলবে তারা নিজেদের নিল চিনে।
উত্তর পশ্চিম ভারত তখন কেবল বুদ্ধের, কেবল ধম্মের, কেবল সংঘের।
বুদ্ধ পদে আত্মসমর্পণ করলেন শ্রাবস্তীর অনাথপিণ্ডক আর বিশাখা। ধনী সম্পদশালী পরিবারের নারী পুরুষ। সমাজমুখ্য ব্যক্তিরা সব।
আরও পড়ুন-একদিকে কাশ্মীর ফাইলস অন্যদিকে খুন পণ্ডিতরা, মোদি–শাহর বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল জনতা
অগ্নি উপাসকদের দল থেকে বেরিয়ে এলেন সারিপুত্ত আর মৌদ্গল্যয়ন। সঙ্গে তাঁদের সহস্র অনুগামী। সন্ন্যাসী তাপসদের বৃত্তে উড়ল বুদ্ধের কেতন।
মগধের বিম্বিসার থেকে কোশলের পসেন্দি, একে একে নৃপতির দল অনুগামী হলেন বুদ্ধের। বিম্বিসার সহর্ষে ঘোষণা করলেন, ছেলেবেলা থেকে যে পাঁচটি স্বপ্ন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, সেগুলোর সবক’টি পূর্ণ হল তাঁর বুদ্ধের পূত স্পর্শে। সিংহাসনে আসীন হয়েছেন। প্রজ্ঞাবানের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁকে জ্ঞাপন করেছেন অন্তরের শ্রদ্ধা। শুনেছেন তাঁর নির্দেশ। উপলব্ধি করেছেন তাঁর বাণী। আর কী চাওয়া থাকতে পারে একজনের একটা জীবনে? এরকম ঘোষণায় ক্ষাত্র কেতনেও স্পষ্ট হল বৌদ্ধ চিহ্ন।
বুদ্ধের ধম্মে নিজেদের সঁপে দিলেন দস্যু আঙ্গুরিমাল থেকে বারবনিতা আম্রপালি। প্রলেতারিয়েতদের বৃত্তে, ব্রাত্যদের বলয়েও তখন বুদ্ধের জয়জয়কার, ধম্মের উদ্গীরণ।
শাসক থেকে শাসিত, বণিক থেকে লুঠেরা, গৃহবধূ থেকে জনপদবধূ, সবাই তখন বৌদ্ধ। বুর্জোয়াদের নিজের দিকে টেনে আনার পাশাপাশি লুম্পেন প্রলেতারিয়েতদের আস্থা অর্জনের পরিণামে আর্যাবর্তের সমাজ পরিসরে শাস্তার ধম্মশিক্ষা বৃত্ত সম্পূর্ণতা অর্জন করল।
আরও পড়ুন-বহিষ্কৃত টমাস, বাংলায় দোস্তি–কেরলে কুস্তির আজব নীতিতে চলছে কংগ্রেস
অসীম প্রত্যয়ে, গভীর বোধি থেকে বিকচিত হয় তথাগতের অমোঘ বাণী।
“ভিক্ষুকরা, সবকিছু এখন অগ্নিময়। চক্ষুতে এখন আগুন লেগেছে। দৃষ্টিতে এখন আগুন ঝরছে। দৃশ্য যা-কিছু সেসব এখন জ্বলছে। ফলত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাবৎ চেতন এখন দহন জ্বালায় জ্বলন্ত। এই আগুনে পুড়ছে কী? পুড়ছে তোমার বাসনা। পুড়ে ছাই হচ্ছে তোমার ক্রোধ। পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তোমার ভ্রম। প্রজ্ঞাবানেরা তাই যাবতীয় ইন্দ্রিয়কে পুড়িয়ে, বাসনাকে জ্বালিয়ে, মনের যা কিছু চাই সেসবকে ছাই করে দিয়ে হৃদিমূল থেকে কষ্ট বিনাশের কথা বলেন। বিষয়তৃষ্ণার দহনেই দুঃখ থেকে উত্তরণ। কামনা-পোড়া ছাই মেখেই পড়ে থাকে যন্ত্রণার মড়া। তৃষ্ণাজয়ী হও, দুঃখজয়ী হবে তবে।”
তিনি বলেন। বলেই চলেন। আজও বলছেন।
তথাগত অনর্গল।
তথাগত অনির্বাণ।