গরমে শিশুর যত্ন

তাপমাত্রা ৪০ ছুঁয়েছে। বৈশাখের আগেই গরমের দাপটে নাজেহাল সবাই। বিশেষ করে শিশুরা। হিটজ্বর, ডায়েরিয়া, আমাশা, ডিহাইড্রেশন, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ঘামাচি, অ্যালার্জি ইত্যাদি নানা শারীরিক সমস্যায় এইসময় কমবেশি ভোগেই কচিকাঁচারা। কীভাবে করবেন এর প্রতিরোধ! ভরা গরমেও শিশুকে সুস্থ রাখবেন কীভাবে, রইল তার কিছু গাইডলাইন। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রোজই ১ থেকে ২ ডিগ্রি করে চড়ছে তাপমাত্রা। গরমের দাপটে কালঘাম ছুটছে আট থেকে আশির। বিশেষ করে ছোট্ট শিশুদের। গরম পড়তে না পড়তে ডাক্তারের চেম্বারে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাবা-মায়েদের লম্বা লাইন।
বাচ্চারা গরমে একটু বেশি ভোগে। গরমটাই এই সময় রিস্ক ফ্যাক্টর হয়ে যায় শিশুদের জন্য। গরম থেকে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়।
গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিট লেগে বাচ্চাদের ইউরিনের পরিমাণ কমতে শুরু করে। সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রে অনেক বাবা-মা বুঝতেই পারেন না যে প্রস্রাব কম হচ্ছে। এর কারণ হল জলশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন।

আরও পড়ুন-আসুন, ঘৃণা ও বিভাজনের শক্তিকে আমরা প্রতিহত করি, বার্তা মহাত্মার নাতনি এলা গান্ধীর

তা হলে কতটা ইউরিন স্বাস্থ্যকর?
কীভাবে বুঝবেন?
লক্ষ্য রাখা দরকার, চব্বিশ ঘণ্টায় অর্থাৎ ধরে নেওয়া যাক, সকাল বারোটা থেকে পরের দিন সকাল বারোটা পর্যন্ত এইভাবে হিসেব করলে এই সময়সীমায় একটি শিশুর যেন অন্তত ছ’বার ইউরিন হয়। তার বেশি হলে সমস্যা নেই কিন্তু কম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শিশুর যদি ইউরিন কম হচ্ছে দেখেন, তবে শরীর ঠান্ডা করুন। ঠান্ডা জায়গায় রাখুন। জানলায় ভিজে কাপড় ঝোলাতে পারেন। ছাদে খড় বা বিচালি দিয়ে ঢেকে দিন, টিনের শেড দিয়ে দিতে পারেন যাতে সরাসরি সূর্যের আলোতে ঘর উত্তপ্ত না হয়। এসিতেও রাখতে পারেন। বিশেষ করে দিনের বেলা। শরীর যেন হিট অ্যাবজর্ব না করে।
হিট ফিভার
হিট বা তাপ শরীরে শোষিত হলেই জ্বর আসতে পারে। হিট ফিভার থেকে আসতে পারে নানান জটিলতা।
তাই এই সময় জ্বর এলে চিকিৎসকের পরামর্শ তো নেবেনই। প্রাথমিক ভাবে জ্বর বাড়লে মাথায় জলপট্টি দিন বা মাথা ধুয়ে দিন। ভিজে কাপড় দিয়ে গা মুছিয়ে দিন।
গরমের ভাইরাল জ্বরে চিকিৎসকেরা প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ দিয়ে থাকেন। ছোটদের ডোজ সম্পূর্ণ আলাদা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক এই সময় তাঁরা চট করে দেন না খুব বাড়াবাড়ি কিছু না হলে।

আরও পড়ুন-তৃণমূলের কড়া চিঠি রাজ্যপালকে — এনআইএ-র কর্তাকে তলব

পেটের রোগ
প্রচণ্ড গরমে শিশুদের ডায়েরিয়া হওয়ার প্রবণতা থাকে। ডায়েরিয়া হলে দ্রুত শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়।
ডায়েরিয়াতে মল হতেই থাকে এবং সঙ্গে বমিও হতে পারে। গরমজনিত ডায়েরিয়া হলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির তুলনায় শিশুদের শরীর থেকে অনেক বেশি লবণ ও জল বেরিয়ে যায়।
এ-ছাড়া আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি হতে পারে গরমে। বাড়াবাড়ি হলে রক্তপাত পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু খাবার বা পানীয়ই নয়, শিশুর শরীরে ভিটামিন এ আর জিঙ্কের অভাবও এই অসুখ ডেকে আনে।
শিশুদের বিপাক প্রক্রিয়ার হার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। অতিরিক্ত তাপ বের হওয়ার সময় ত্বক থেকে অনেক বেশি জল জলীয় বাষ্প আকারে বেরিয়ে যায়।
ছোট শিশুরা কিন্তু জলের তেষ্টা মেটাতে বড়দের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কাজেই বড়দেরই খেয়াল রাখতে হবে তাঁদের শরীরে জলের ঘাটতি যাতে না হয়।
কীভাবে বুঝবেন শিশুর জলশূন্যতা?
ডিহাইড্রেশন হলে প্রথমেই প্রস্রাবের রংটা খেয়াল করবেন। তা যদি গাঢ় হলুদ বা বাদামি হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শিশুর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। জিভ শুকিয়ে যায়। মাথাব্যথা, বমি-বমি ভাব হওয়া।
ত্বক খুব শুষ্ক হয়ে যায়। অতিরিক্ত ঘাম হয় অথবা একেবারেই ঘাম হওয়া বন্ধ হয়ে যায় ডিহাইড্রেশন হলে।
ইউরিন কম হয়। শ্বাসের গতি ও নাড়ির গতি বেড়ে যায়, পেশির ব্যথা, খিঁচুনি হতে পারে।
অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়তে পারে, হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে।
ডায়েরিয়া হলেও ডিহাইড্রেশন হয়ে শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
যদি ছ’মাসের নিচের শিশুর চব্বিশ ঘণ্টায় ইউরিন কম হচ্ছে বলে মনে হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শে জল বা ওআরএস দেওয়া যেতে পারে। ইউরিন স্বাভাবিক হলে আবার মায়ের দুধেই ফিরে যেতে হবে। আর জল দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন-বাম জমানার পাপ মোচন, চাকরি ৪০০ শিক্ষকের

শিশুকে হাইড্রেটেড রাখতে
ছ’মাস হয়নি যে শিশুর তাকে বারবার মায়ের দুধ খাইয়ে যেতে হবে। ৬ মাসের বেশি বয়সি শিশুদের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি জল ও তরল খাবার দিন।
বাচ্চার জন্মের পর প্রথম ছ’মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র খাদ্য। এটা শিশুর রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি জীবনদায়ী। কাজেই যে শিশু ব্রেস্ট ফিড করে তার এই ধরনের জটিলতা বিশেষ তৈরি হয় না।
মোটামুটি ছ’মাসের উপরের শিশুকে জল এবং জলজাতীয় পানীয় খাওয়ানোর অভ্যেস করাতে হবে। ১ থেকে ৩ বছরের শিশু চার কাপ জল খাবে। ৪ থেকে ৮ বছরের শিশুর জন্য ছয় কাপ, ৯ থেকে ১৩ বছরের শিশুকে ৮ কাপ জল খেতে হবে। জল ছাড়াও দুধ, ফলের রস থেকেও শরীরে ফ্লুইড ঢোকে তাই সেগুলোও খাওয়াতে হবে। ডাবের জল খাওয়ান। এর সঙ্গে সবুজ শাক-সবজি, মরশুমি ফল যেমন তরমুজ, শসা, জাম, লিচু, আনারস ইত্যাদি খাওয়ান যাতে শরীর ঠান্ডা এবং হাইড্রেটেড থাকে।
সদ্যোজাত থেকে ছ’মাস শিশুর বয়স হলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রিতে রাখতে পারেন।
অতিরিক্ত গরমে ডিহাইড্রেশন থেকে শিশু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিন। জামা খুলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা, হাত-পা মুছে দিন। শিশু নিস্তেজ বা অচেতন হয়ে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
গরমের অন্যান্য সমস্যা
গরমে অতিরিক্ত ঘাম বসে ঠান্ডা লেগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও নিউমোনিয়া হতে পারে। শিশুর সংক্রমণের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হল জ্বর, দ্রুত ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস, শ্বাসের সঙ্গে শোঁ-শোঁ শব্দ, খেতে না পারা বা খাওয়ানোতে অসুবিধে হওয়া, দুর্বল, ক্লান্তি বা ঝিমুনি ভাব।
গরমে শিশুর ত্বকের সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। ঘাম সহজে শুকোয় না। ত্বকে ঘাম জমে সেখান থেকে একধরনের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ হয়। লাল চাকা-চাকা অ্যালার্জি বেরয়। ঘামাচি হয়। কিছু মেডিকেটেড পাউডার রয়েছে যা কয়েকদিন লাগালে ঘামাচির উপশম হবে।
এতটা গরমে শিশুকে বেশিক্ষণ ডায়াপার পরিয়ে না রাখাই ভাল। অনেক সময় ডায়াপারের কারণে ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে। ভেজা থেকে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি হয়।

Latest article