বর্ষায় বাড়ে জয় বাংলা

ভাইরাসঘটিত নানা রোগের প্রভাব বাড়ে বর্ষাকালে। যার মধ্যে অত্যন্ত সংক্রামক এবং অস্বস্তিকর একটি রোগ হল কনজাংটিভাইটিস, যা চলতি কথায় 'জয় বাংলা' নামেই পরিচিত। এ বছর বর্ষাতেও আবার বাড়বাড়ন্ত রোগটির। সতর্কতাই হল এই রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রোগের আবার জয়ধ্বনি!
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোকজনের কাছে ‘জয় বাংলা’ ছিল এক আতঙ্কের নাম। কোনও জয়ধ্বনি নয়। ‘জয় বাংলা’ নামের এই চোখের অসুখে বিপর্যস্ত হয়েছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবন। Georges Childs Kohn তাঁর Encyclopedia of plague and pestilence : From Ancient Times to the Present বইতে একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ লোক চোখ-ওঠা রোগে আক্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। হয়তো সমসাময়িক পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে এই পরিসংখ্যান অনেক বেশি।

আরও পড়ুন-আর্মি রেডকে সমীহ ডায়মন্ড হারবারের

যাঁরা ‘জয় বাংলা’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশ বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী। পাশাপাশি প্রচুর স্থানীয় মানুষও ছিল। ১৯৭১-এর সরকারি হিসাব মতে প্রায় ৫ লাখ লোক অ্যাকিউট হেমোরেজিং কনজাংটিভাইটিসে (AHC) আক্রান্ত হন এবং তাঁদের চিকিৎসা পরিষেবা লেগেছিল। আসল সংখ্যাটা হয়তো এর চেয়ে বেশি। কলকাতা শহরের শতকরা ৬৫ জন লোক এই রোগে আক্রান্ত হন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন রেলওয়ের কর্মচারীরা, ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হতে বসেছিল। ৭১-এর মে মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

আরও পড়ুন-কলকাতা মেট্রোয় একসঙ্গে ঝাঁপ যুগলের

মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মাধ্যমেই এই রোগ ছড়ায় বলে স্থানীয়রা এর নামকরণ করে ‘জয় বাংলা’।
তখন বিনামূল্যে মেডিক্যাল ক্যাম্প করে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়েছিল। ওই বছরই জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গের সিনিয়র চক্ষু বিশেষজ্ঞরা যেমন— ডাঃ নীহার মুন্সি, ডাঃ অমল সেন, ডাঃ আই এস রায়, ডাঃ প্রকাশ ঘোষ, ডাঃ জলধর সরকার, তৎকালীন কলকাতা পুরসভার স্ট্যান্ডিং হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ডাঃ বীরেন বসু জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে ‘জয় বাংলা’ রোগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের ৫ টি ম্যাচ আয়োজনের দায়িত্বে ইডেন গার্ডেন্স

খুব ছোঁয়াচে
এসে গেছে বর্ষা আর এবারেও শুরু হয়ে গেছে কনজাংটিভাইটিসের প্রকোপ। এটা হল কনজাংটিভার ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ বা ব্যথা। চোখের পাতার নিচে সাদা অংশের ওপর ঝিল্লির মতো পাতলা পর্দা বা স্বচ্ছ যে আস্তরণ থাকে সেটা হল কনজাংটিভা। যা আমাদের চোখের ভিতরে সাদা অংশ ও চোখের পাতার ভিতরের অংশকে ঢেকে রাখে । কর্নিয়ার মার্জিন থেকে সক্লেরা এবং আই লিডের পিছনের অংশ পর্যন্ত পুরোটাই কনজাংটিভা। রোগটি মূলত বাচ্চাদের মধ্যেই বেশি দেখা দিলেও প্রাপ্তবয়স্কদেরও ভালমতোই হয়। একজনের থেকে অন্যের চোখে সংক্রমিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে ‘জয় বাংলা’ আর বাংলাদেশে এই রোগকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘চোখ ওঠা’। নাম যা-ই হোক রোগটি কিন্তু খুব ছোঁয়াচে।
সাধারণত কন্টামিনেটেড ডিজিজ যা সংযোগের মাধ্যমে ছড়ায়। যার হয়েছে এমন ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস গামছা, তোয়ালে, রুমাল অন্য কেউ ব্যবহার করলে, আবার হ্যান্ড টু আই কন্টাক্ট অর্থাৎ আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত জিনিস কেউ ধরার পর যদি সেই হাত না ধুয়ে হাত চোখে দেয় তাহলে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন-‘বিরোধীদের ‘NO VOTE TO MAMATA’ প্রচারাভিযানকে ‘NOW VOTE FOR MAMATA’-এ রূপান্তর করার জন্য জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ’ বার্তা অভিষেকের

এক নয়, একাধিক ধরন
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে হতে পারে ব্যাকটেরিয়াল কনজাংটিভাইটিস। ঠাণ্ডা লাগলে, ফুসফুসে সংক্রমণ হলে বা গলায় ব্যথা, ঘা হলে এটা হতে পারে। অনেক সময়ে কনট্যাক্ট লেন্সের জন্যও এই ধরনের কনজাংটিভাইটিস হতে পারে।
অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস অর্থাৎ কোনও দ্রব্য থেকে অ্যালার্জির কারণে এই ধরনের কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। যেমন ধুলো, বালি, ফুলের রেণু,খাবার বা ওষুধ ইত্যাদি।
ইনফেকটিভ কনজাংটিভাইটিস যেটার কারণ কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস।

আরও পড়ুন-প্রয়াত নিত্যানন্দ হেমব্রম, শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

কেমিক্যাল কনজাংটিভাইটিস অর্থাৎ বাইরে থেকে কেমিক্যাল জাতীয় কিছু চোখের মধ্যে পড়লে এই জাতীয় কনজাংটিভাইটিস হয়। সুইমিং পুলের জলে ক্লোরিন মেশানো থাকে সেই ক্লোরিনের পরিমাণ যদি বেশি হয় তা চোখে চলে গেলে বা রং খেলার সময় চোখে রং ঢুকে গেলে এই ধরনের সমস্যা হয়।

আরও পড়ুন-প্রকাশিত সূচি, ডুরান্ডে একই গ্রুপে দুই প্রধান

কী উপসর্গ
চোখ খুব লাল হয়ে যায়। প্রথমে একটা চোখ, তারপর দুটো চোখেই সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়।
চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়তে থাকে। অস্বস্তি হয় এবং খচখচ করতে থাকে। প্রচণ্ড ব্যথা-যন্ত্রণা হয় চোখে।
আলো এই সময় একেবারেই চোখে সহ্য হয় না। ইরিটেশন বাড়ে।
চোখে থেকে শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থ বা পিঁচুটি বেরয় এবং হলুদ রঙের পুঁজ দেখা দেয়।
ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের পাতা জোড়া লেগে যায়।
কর্নিয়া যদি কোনওভাবে আক্রান্ত হয় তাহলে সেই ব্যক্তি চোখে ঝাপসা দেখে।
কর্নিয়াতে সাদা দাগ দেখা যায়। খালি চোখে দেখে যেটা বোঝা যায় না।
সতর্কতা ছাড়া অন্য উপায় নেই
সাধারণত এই রোগ ভাল হয়ে গেলেও দিন পনেরো কষ্ট দেয়। এক বিরক্তিকর অনুভূতি। দেরি করলে এটা জটিল আকার নিতে পারে। একজনের হলে তাঁর সংস্পর্শে থাকা প্রত্যেকের সংক্রমণ হয়।

আরও পড়ুন-বিদ্রোহের পর পুতিনের সঙ্গে কথা প্রিগোজিনের

প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ডোজ মেনে ব্যবহার করতে হবে। তবে, সেক্ষেত্রে চক্ষূরোগ-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তবেই ব্যবহার করতে হবে।
ঘনঘন চোখ ঘষা যাবে না। খুব বেশি বার জলের ঝাপটা দিলে ক্ষতি হতে পারে।
এই অবস্থায় চোখে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যাবে না।
যতদিন না সারছে ধুলো-বালি সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে কালো সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে।
ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। এইসময় যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকুন।
চোখ মোছার জন্য আলাদা কাপড় ব্যবহার করুন।
চোখ উঠলে আলাদা থাকলেই ভাল, যাতে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে।
অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত নিজেই ওষুধের দোকান থেকে স্টেরয়েড জাতীয় ড্রপ নেন। কিন্তু এ জাতীয় ড্রপ বেশি দিলে চোখের জটিলতা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেমন গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই নিজে নিজে চিকিৎসা করবেন না।

আরও পড়ুন-কর-সংক্রান্ত মামলার সময়সীমা বাড়ল

কখন ডাক্তার ছাড়া গতি নেই
কারও চোখের খচখচে ভাবটা যদি বেশি হয়, খুব বেশি পরিমাণে পিঁচুটি জমছে বা চোখে ভালরকম ঝাপসা দেখে, তাহলে চক্ষূরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
শিশু ও বড়দের ক্ষেত্রে এ-রোগের চিকিৎসা একই। তবে, শিশুরা যেহেতু সবটা বলতে পারে না তাই তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
কনজাংটিভায় জল জমে গিয়ে অনেক সময় চোখ বেশি ফুলে যায়। আবার কারও কারও চোখ দিয়ে রক্তও পড়ে। তবে এটার সংখ্যা কম। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
সাধারণভাবে চোখ লাল হলে ও সামান্য জল পড়লে ৭ দিন অপেক্ষা করাই ভাল। যদি ততদিনে ভাল না হয়, তখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যেতে পারে৷

Latest article