কিউটিস ল্যাক্সা

বিরল রোগ কিউটিস ল্যাক্সা। জন্মের পর নিকট শৈশবে এই রোগের লক্ষণ প্রকট হয়। এর নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত না থাকলেও প্লাস্টিক সার্জারি এবং থেরাপি কিন্তু দারুণ কার্যকরী চিকিৎসা। লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

বিরল রোগ
কিউটিস ল্যাক্সা। নামটি কিন্তু বেশ কিউট। তবে এর পরিণতি ভয়াবহ! সাধারণত এটি একটি চর্মসংক্রান্ত রোগ; দেহের চামড়া অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কুঁকড়ে যায়, যেন আলগা চামড়া পেন্ডুলামের মতো শরীর থেকে ঝুলতে থাকে! ল্যাটিন শব্দ ‘কিউটিস ল্যাক্সা’। এর অর্থই হল ল্যাক্স স্কিন বা আলগা চামড়া।
কিউটিস ল্যাক্সা হল মানবদেহের সংযোজক কলা সংক্রান্ত বিরল রোগগুলির একটি সামগ্রিক পরিভাষা। এটি সচরাচর একটি জিনগত বিশৃঙ্খলা; তবে সবসময় বংশগত নয়, অনেকাংশেই এই রোগ অর্জিতও বটে। এই রোগের প্রাথমিক বহির্দেশীয় লক্ষণই হল চামড়ার অকালবার্ধক্য; এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাঁর বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধ মনে হয়!

আরও পড়ুন-আজ ও কাল দুই জেলার উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর বহু প্রকল্প উদ্বোধন ও শিলান্যাস

যোজক কলা
মানবদেহে কলা বা টিস্যু হল চার প্রকার। যথা, আবরণী কলা বা এপিথেলিয়াল টিস্যু, পেশি কলা বা মাসল টিস্যু, স্নায়ু কলা বা নার্ভাস টিস্যু এবং সংযোজক কলা বা কানেক্টিভ টিস্যু, যা অল্প কিছু কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি সারাদেহে যোগাযোগ স্থাপনকারী কলা। এই কলা গোটা দেহের মাংসপেশি, গাঁট, ত্বক ও অন্যান্য সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে তাদের গঠন ও শক্তি প্রদান করে। এই কলা দ্বারা সৃষ্ট কঙ্কাল প্রাণীর দেহ কাঠামোগত রূপ প্রদান করে। তরল যোজক কলা শরীরের প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় পদার্থ পরিবহণে সাহায্য করে। বিভিন্ন অঙ্গের সংরক্ষণ ও তাদের চলাচলে সাহায্য করে। দেহে প্রবিষ্ট ক্ষতিকারক পদার্থ ও জীবাণু থেকে দেহকে রক্ষা করে। ক্ষত নিরাময়ে অংশগ্রহণ করে এবং দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
দেহের গাঠনিক, যান্ত্রিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালনের পাশাপাশি অন্যান্য কলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এদের পুষ্টি জোগানো, বৃদ্ধি ও বিভেদকরণে সহায়তা করে। কখনও কখনও একপ্রকার বিশেষ জিনের আকস্মিক মিউটেশন বা পরিব্যক্তির কারণে এবং অনেক ক্ষেত্রে কিছু অর্জিত পরিস্থিতিতে আমাদের শরীরের এই বহুল ব্যবহৃত এবং অতি প্রয়োজনীয় কানেক্টিভ টিস্যুগুলো তাদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন কিউটিস ল্যাক্সা দেখা যায়।
রোগ পরিচিতি
নিদান-বিদ্যার তত্ত্ব অনুসারে, এই রোগ অধিকাংশ সময়ই বংশগত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্জিত। দেখা গেছে মনুষ্য দেহের বিশেষ কিছু জিনের পরিব্যক্তির কারণে একশ্রেণির প্রোটিনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে যা কোষস্থ স্থিতিস্থাপক তন্তুজালকে ভেঙে দেয়। ফলস্বরূপ আক্রান্তের মুখ, হাত, পা, সন্ধি, মাথা, ঘাড়, পেট এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চামড়া আলগা হয়ে যায়, কুঁকড়ে পাশের দিকে ঝুলে পড়ে, ত্বকে স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, কোষের স্থিতিস্থাপক তন্তুগুলো বিরলভাবে বিক্ষিপ্ত এবং খণ্ডিত হয়ে পড়ে; অপরিণতভাবে বয়স্ক মনে হয় কিউটিস ল্যাক্সায় আক্রান্ত মানুষটিকে। ত্বক এবং কোষস্থ তন্তুর এইরূপ দশা দেখে চিকিৎসা শাস্ত্রে এই রোগটিকে অনেকসময় ‘ইলাস্টোলাইসিস’ এবং ‘প্যাকিডার্মাটোসে’ও বলা হয়ে থাকে।
রোগের রূপরেখা
এই রোগটি কোনও কোনও ক্ষেত্রে জ্বর-জ্বর অসুস্থতা এবং পেনিসিলিন জাতীয় কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণে হলেও, মূলত এটি বংশজ। জিনগত এই রোগটি আবার তার সংক্রমণ ও রোগের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তিন প্রকার। যথা, ১. অটোসোমাল ডমিন্যান্ট কিউটিস ল্যাক্সা বা লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম বাদে বাকি অটোজম কর্তৃত্বাধীন কিউটিস ল্যাক্সা; এইক্ষেত্রে ‘এলাস্টিন’ জিনের পরিব্যক্তির ফলে উপস্থিত প্রোটিনের অস্বাভাবিকভাবে গুণগত এবং মানগত পরিবর্তন হয়। এইক্ষেত্রে চামড়ার উপর সেইরকম একটা প্রভাব না পড়লেও, মানবদেহের শ্বাসতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র এবং জননতন্ত্র আক্রান্ত হয়; অনেক সময় দেহনালি বন্ধ হয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলে। ২. এক্স-লিঙ্কড কিউটিস ল্যাক্সা বা লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম সংযুক্ত আলগা চামড়ার রোগ, যেখানে ‘মার্কিস প্রোটিন’ নামে একটি তামা পরিবাহক জিনের পরিব্যক্তির কারণে এই বিকার দেখা যায়। এক্ষেত্রে রোগীর চামড়ার পরিবর্তন প্রকটভাবে দৃশ্যমান, তবে জননতন্ত্র বিকারগ্রস্ত হয় এবং গ্রন্থিগুলো অতিরিক্ত ঢলঢলে হয়ে যায়। আক্রান্তের বুদ্ধাঙ্ক কমে আসে। এবং ৩. অটোসোমাল রিসেসিভ কিউটিস ল্যাক্সা বা লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম বাদে বাকি অটোজম পতনকারী চর্মবিকার, যা সাধারণত সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে থাকে। এই ধরনের কিউটিস ল্যাক্সা ছয় প্রকারের হলেও মূলত এটি দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে ‘ফিবুলিন’ জিনের এবং দ্বিতীয় প্রকারে ‘লাইসিল অক্সিডেজ’ জিনের পরিব্যক্তির ফলে মারাত্মক কিছু লক্ষণ দেখা দেয় রোগীর দেহে। চামড়ার বিকৃতির সাথে সাথেই দ্রুত ফুসফুস, জরায়ু এবং পাচকতন্ত্রকে আক্রমণ করে, লিগামেন্ট আলগা হয়ে যায়, নিতম্বের গঠন বিকৃত হয় এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মারাত্মক পর্যায়ে। মুখ, পায়ের পাতা— সর্বত্র গুটি দেখা দেয়, শ্বাসনালি ফুলে ওঠে; রোগী শারীরিক ও মানসিক পীড়ার শিখরে পৌঁছে যায়; জীবন হয়ে ওঠে বিপন্ন! তবে নানা ধরনের সাধারণ এবং স্থানীয় কারণে অর্জিত কিউটিস ল্যাক্সা রোগীর দেহে একটি ফোলাফোলা সংক্রমণের পর দেখা যায় এবং কখনও কখনও এটি মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়, শ্বসনক্রিয়া থেমে গিয়ে রোগীর মৃত্যু ডেকে আনে।

আরও পড়ুন-অষ্টম দুয়ারে সরকার, সুবিধা পৌঁছে দিতে ডেডলাইন রাজ্যের

থেরাপিই অন্যতম চিকিৎসা
জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের এই রোগ হতে পারে; অর্জিত ক্ষেত্রে এই বিকার তাঁর বয়সকালে ধরা পড়ে, তবে জিনগত কিউটিস ল্যাক্সা তাঁর জন্মের পর অথবা নিকট শৈশবে শনাক্ত হয়। এখনও পর্যন্ত এই রোগের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এই রোগ নির্ণয় যদিও-বা সহজে হয়, তবে তার বংশগতি সম্বন্ধীয় সংক্রমণের সূত্র পাওয়া এবং তার নিশ্চিন্তকরণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। একটি স্বাস্থ্য-সচেতক শিক্ষিত পরিবার যদি তাঁদের চর্মগত সমস্যার ইতিহাস এবং জন্মপূর্ববর্তী কোনওরূপ জিনগত পরীক্ষার কথা তুলে ধরেন, তাহলে রোগনির্ণয়ে সুবিধা হয়। প্রাথমিকভাবে কোনও চর্মবিশারদ বা প্রজননবিদ্যা বিশারদ ত্বকের বায়োপ্সি বা আণুবীক্ষণিক পরীক্ষা এবং ত্বকের অকালবার্ধক্যের কারণ সংক্রান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের শনাক্তকরণ করে থাকেন। রোগনির্ণয়ের পর চিকিৎসকরা অনুসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করেন; অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি এবং দৈহিক থেরাপি ভাল ফল দেয়।
আমাদের কথা
গোটা পৃথিবীর মধ্যে প্রায় প্রতি দশ লক্ষের মধ্যে একজন এই বিরল রোগে আক্রান্ত হন; সমীক্ষায় জানা গেছে প্রায় দুশোটির বেশি পরিবারের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। অনেকেই মনে করেন ভারতবর্ষে প্রায় ৭০০০-৮০০০ বিরল রোগের দেখা পাওয়া যায়; তবে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের অন্যতম দুরারোগ্য ব্যাধির সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি। আমাদের দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এই বিরল রোগে আক্রান্ত এবং যাদের মধ্যে ৫ শতাংশ রোগের কোনও প্রচলিত চিকিৎসাই নেই। সেই সমস্ত মারণব্যাধির একটি হল কিউটিস ল্যাক্সা; তাই এ-বিষয়ে জনমানসে জাগরণ বিশেষ প্রয়োজন।

Latest article