মুক্তচিন্তার অগ্রনায়ক শিবনাথ শাস্ত্রী

“… মানববাৎসল্য প্রবল থাকা সত্ত্বেও সত্যের অনুরোধে তাঁহাকেই পদে পদে মানুষকে আঘাত করিতে হইয়াছে। আত্মীয়-পরিজন ও সমাজকে তো আঘাত করিয়াইছেন, তাহার পরে ব্রাহ্মসমাজে যাঁহাদের চরিত্রে তিনি আকৃষ্ট হইয়াছেন, যাঁহাদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও প্রীতি তাঁহার বিশেষ প্রবল ছিল তাঁহাদের বিরুদ্ধে বার বার তাঁহাকে কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। মানুষের প্রতি তাঁহার ভালোবাসা সত্যের প্রতি তাঁহার নিষ্ঠাকে কিছুমাত্র দুর্বল করিতে পারে নাই।” যাঁর সম্পর্কে এই মন্তব্য রবীন্দ্রনাথের, সেই মহামানবের জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে কলম ধরলেন তানিয়া রায়

Must read

সে ছিল এমন একটা সময়, যখন লোকে ভাবত, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবে, সংসার করবে না, স্বভাবচরিত্র খারাপ হবে। তার মধ্যেও যাঁরা নারী শিক্ষার পক্ষে সেদিন সর্বস্ব পণ করে লড়ে গেছিলেন, শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁদের অন্যতম। নিজেকে বলতেন ‘বিদ্যাসাগরের চেলা’। কেশবচন্দ্র সেনের নারীশিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিতেও বহুবিধ সংকীর্ণতা ছিল। শিবনাথ মেয়েদের জ্যামিতি, লজিক, মেটাফিজিক্স পড়াতে চাইলে তিনি তো বলেই দিলেন, “এ সকল পড়াইয়া কি হইবে? মেয়েরা আবার জ্যামিতি পড়িয়া কি করিবে?” কথাটা মোটেই পছন্দ হয়নি শিবনাথ শাস্ত্রীর। অসন্তুষ্ট, কিন্তু কিছু করার নেই। কেশব সেনকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা নেই তাঁর। তাই নতুন বুদ্ধি আবিষ্কার করলেন। মুখে মুখে বলে গেলেন ‘মেন্টাল সায়েন্স’-এর তত্ত্ব, লিখে রাখলেন ছাত্রীরা। পরে সেই ‘নোট’-ই পরিমার্জন করে ছেপে দিলেন ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায়। কিছুদিনের মধ্যেই আদি ব্রাহ্মসমাজের লোকেদের সঙ্গে স্ত্রী-স্বাধীনতা বিষয়ে শিবনাথের মতবিরোধ বৃদ্ধি পেল। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৪ করা নিয়ে যখন তাঁরা আন্দোলন করছেন, তখন দেখলেন কেশবচন্দ্র নিজের নাবালিকা মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে তুলে দিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, ১৮৭৮ সালে গড়ে তুললেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’।

আরও পড়ুন-কিউটিস ল্যাক্সা

স্বপ্ন ছিল ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়’-কে নিয়ে। তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত স্কুলটি যুক্ত হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। পরে অবশ্য সিটি স্কুল-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নেন তিনি। স্ত্রীশিক্ষা না হলে সমাজ খোঁড়া হয়ে যাবে, সে-কথাটা পরবর্তীকালেও বহু সভাসমিতিতে বলেছেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তা আদৌ পর্যাপ্ত কিনা, এ প্রশ্ন বারবার তুলেছেন শিবনাথ। সখেদে বলেছেন, “এ সকল উন্নতির চিহ্ন তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু বিগত সেন্সাস রিপোর্টে দেখিতেছি, এ সকল সংগ্রহ করিয়াও লিখিতে ও পড়িতে পারেন এরূপ স্ত্রীলোকের সংখ্যা এই বঙ্গদেশে হাজারের মধ্যে ৫ জনের অধিক হয় নাই।”

আরও পড়ুন-আজ ও কাল দুই জেলার উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর বহু প্রকল্প উদ্বোধন ও শিলান্যাস

প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত না হলেও জাতীয়তাবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। একবার বিপিনচন্দ্র পাল গেছেন তাঁর বাড়িতে, সেটাই প্রথমবার। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, একটি নয়-দশ বছরের মেয়ে নিঃসংকোচে দরজা খুলে একদল অপরিচিত যুবককে অভ্যর্থনা জানাল। মেয়ের মধ্যে দিয়ে গৃহস্বামীর চরিত্রের পরিচয় পেলেন তিনি। বিধবাবিবাহ প্রচলনের সঙ্গেও শিবনাথ শাস্ত্রী জড়িয়ে ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। যৌবনে একবার ঘটকালি পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন এক বিধবা যুবতীর। নবদম্পতিকে সমাজ গ্রহণ না করায়, নিজের স্কলারশিপের টাকায় সংসার চালাতেন তাদের।

আরও পড়ুন-অষ্টম দুয়ারে সরকার, সুবিধা পৌঁছে দিতে ডেডলাইন রাজ্যের

তখন স্কুলের ছাত্র তিনি। ক্লাসেরই একটি ছাত্রের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না বাকিদের। ধনী পরিবারের সন্তান; কাজেই তার দেমাকও তেমন। পড়াশোনাতেও মন ছিল না একেবারে। সেই ছেলেই একবার প্রথম হয়ে গেল! ব্যস, আর পায় কে! অহংকার যাকে বলে আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সেই ছাত্রটিকে জব্দ করার জন্যই কিশোর শিবনাথ একটা ফন্দি আঁটলেন। নিজের মনেই লিখে ফেললেন একটি কবিতা; অবশ্যই ব্যঙ্গাত্মক। আর যায় কোথায়! শিবনাথের সেই একটা কবিতাতেই বোমা ফাটল ক্লাসঘরে। জীবনের প্রথম কবিতা ওইখানেই। তারপর থেকে মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এই প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কবিতা। অবশ্য স্বনামে নয়; ছদ্মনামে। ‘শ্রীশ’ নামে ভরে উঠতে লাগল পত্রিকার পাতা।
শিবনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ ছিল না। তাঁহাকে আমি যেটুকু চিনিতাম, সে আমার পিতার সহিত তাঁহার যোগের মধ্য দিয়া। আমার পিতার জীবনের সঙ্গে তাঁহার সুরের মিল ছিল। মতের মিল থাকিলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হয় ভক্তি হয়, সুরের মিল থাকিলে গভীর প্রীতির সম্বন্ধ ঘটে।” এখানেই শেষ নয় দেবেন্দ্রনাথ-তনয়ের শিবনাথ প্রশস্তি। তিনি লিখছেন, ‘‘শিবনাথের প্রকৃতির একটি লক্ষণ বিশেষ করিয়া চোখে পড়ে; সেটি তাঁহার প্রবল মানববৎসলতা। মানুষের ভালমন্দ দোষগুণ সব লইয়াই তাহাকে সহজে ভালোবাসিবার শক্তি খুব বড়ো শক্তি। যাঁহারা শুষ্কভাবে সংকীর্ণভাবে কর্তব্যনীতির চর্চা করেন তাঁহারা এই শক্তিকে হারাইয়া ফেলেন। কিন্তু শিবনাথের সহৃদয়তা এবং কল্পনাদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি দুই-ই ছিল এইজন্য মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়া দেখিতে পারিতেন, তাহাকে সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো বাজারদরের কষ্টিপাথরে ঘষিয়া যাচাই করিতেন না। …তিনি ছোটো ও বড়ো, নিজের সমাজের ও অন্য সমাজের নানাবিধ মানুষের প্রতি এমন একটি ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছেন যাহা হইতে বুঝা যায় তাঁহার হৃদয় প্রচুর হাসিকান্নায় সরস সমুজ্জ্বল ও সজীব ছিল, কোনো ছাঁচে ঢালাই করিয়া কঠিন আকারে গড়িয়া তুলিবার সামগ্রী ছিল না। তিনি অজস্র গল্পের ভাণ্ডার ছিলেন…।”

আরও পড়ুন-কৃত্রিম মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনে চমক : ফল আশাপ্রদ, বললেন মাস্ক

‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ আমরা পরিচিত হই শিবনাথ শাস্ত্রীর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। সেখান থেকে অনুভূত হয়, কেবল একটি মাপকাঠিতে শিবনাথ শাস্ত্রীকে বিচার করা অসম্ভব। উনিশ শতকের এক বিরাট পরিবর্তনের আদর্শকে তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের মধ্যে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যে সঠিক পথেই ছিল, সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে, সমকালে নয়, পরবর্তী সময়ে।

Latest article