সূচনা ১৯৭৪ সালে প্রীতিলতা দাসের হাত ধরে। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছরেরও আগে নারীর অবস্থান বিশেষ করে গ্রাম-জীবন কতটাই বা উন্নত ছিল। যেটুকু ছিল শহরে। গল্পের শুরু হয় বারুইপুর ব্লকের ছোট্ট একটি গ্রাম বৈকুণ্ঠপুরে। সেখানেই প্রথম ভিত গড়ে উঠেছিল ‘নিষ্ঠা’র। যদিও তখন এটি সংগঠনের আকার নেয়নি। সেই সময় ওই গ্রামে মেয়েদের উপর একের পর এক আত্মহত্যা, গৃহহিংসা এবং বাল্যবিবাহর মতো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছিল। যে ঘটনায় চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। ওই গ্রামেরই বধূ প্রীতিলতা দাস নারীর এই ক্রম অবনতি দেখে উপলব্ধি করেছিলেন যে মেয়েরা খুব একা হয়ে যায় বিয়ের পরে। একটা গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যায় তারপর সেখানে নতুন মানুষজনের মাঝে পড়ে অত্যাচারিত হলেও তাঁদের আর কিছু করার থাকে না কারণ হাজার অত্যাচার, অবিচার সহ্য করেও মুখ বুজে মেনে নেওয়াটাই তখন গ্রামীণ এলাকার মেয়ে-বউদের অলিখিত নিয়ম ছিল যে।
আরও পড়ুন-পেশা বাছতে হবে নিজেকে যাচাই করে
তখন তিনি বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের মেয়েদের একত্রে বসে গল্প করার একটা জায়গা তৈরি করার কথা ভাবেন যার উদ্দেশ্য ছিল সেখানে গ্রামের মেয়েরা এসে বসবে এবং নিজেদের মনের কথা বলতে পারবে। এর ফলে কেউ অত্যাচারিত হচ্ছে কি না বা অন্য কোনও সমস্যায় পড়ছে কি না তা জানা যাবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এরপর ধীরে ধীরে ওখানেই মেয়েদের হাতের কাজ শেখান, কেউ যদি অল্প বয়সে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসে তাহলে তাঁকে কিছুটা স্বাবলম্বী করে তোলা, তাঁদের একটা গ্রুপে পরিণত করা— এইগুলো শুরু করলেন তিনি। প্রীতিলতা দাসের স্বামী ছিলেন ওই গ্রামেরই একজন নামজাদা চিকিৎসক বিজয় দাস যাঁর ঐকান্তিক সহযোগিতা এবং আগ্রহে প্রীতিলতা তাঁর এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। এইভাবেই সূচনা হল ‘নিষ্ঠা’। এই কাজে আসছিল প্রচুর বাধা কারণ ওই সময় পশ্চাৎপদ সংরক্ষণশীল প্রত্যন্ত গ্রামে একজন মহিলার পক্ষে এমন উদ্যোগ নেওয়া এবং সফল হওয়া সহজ ছিল না। তবুও সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের কাছে নতি স্বীকার করেননি তিনি। স্বামীর সহযোগিতাতেই একটি হেলত চেক-আপ ক্যাম্প তৈরি করেন যেখানে বিনামূল্যে মহিলাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতেন ডাঃ বিজয় দাস এবং কোনও মহিলার চিকিৎসার প্রয়োজন পড়লে স্ত্রীর পাশে থেকে তাঁর সম্পূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিজে হাতে চিকিৎসাও করতেন তিনি।
এরপরে ১৯৮০ সালে গ্রামেরই এক গৃহবধূ গৃহহিংসার শিকার হন। ওই মহিলাকে তাঁর স্বামী খেতে না দিয়ে বাড়িতে একটা মুরগির খাঁচায় দুদিন বন্ধ করে রেখে আবার অন্যত্র বিয়ে করতে চলে যায়। মেয়েটির মরণাপন্ন অবস্থা হয়। এমতাবস্থায় ‘নিষ্ঠা’র নারীবাহিনী খুব সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। পুলিশের সাহায্যে তাঁরাই সেই মহিলাকে উদ্ধার করে এবং গ্রামপঞ্চায়েত এবং পুলিশের মধ্যস্থতায় ওই মহিলা অধিকারের জন্য লড়াই করে এবং তাঁকে সুবিচার পেতে সাহায্য করে। এটাই ছিল ‘নিষ্ঠা’র প্রথম সফল পদক্ষেপ। এই ঘটনার ফলে ‘নিষ্ঠা’র নাম আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
আরও পড়ুন-কৌশিকী অমাবস্যায় এবার প্লাস্টিক বর্জন
এরপর থেকেই বৈকুণ্ঠপুরে ‘নিষ্ঠা’র মহিলা দল আশপাশের গ্রামে পায়ে হেঁটে যাতায়াত শুরু করে। সেখানেও তৈরি হয় আরও মহিলার দল। প্রীতিলতা দাস চেয়েছিলেন নিঃসঙ্গ একা নারীকে শক্ত করতে, একত্র করতে। কিন্তু তাঁর সেই প্রচেষ্টা যে একটা সংগঠনের রূপ নেবে তা ভাবেননি। ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী মহিলা সংগঠনে পরিণত হতে থাকল ‘নিষ্ঠা’।
এরপর এই সংগঠনের দায়িত্ব নেন তাঁর কন্যা মিনা দাস। মিনা দাস বর্তমানে এই সংগঠনের ফাংশনাল সেক্রেটারি। প্রীতিলতার কন্যা মিনা দাস তখন কলেজের ছাত্রী। সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন মেয়েদের এরকম অবস্থার কারণ হল তাঁদের মধ্যে শিক্ষার এবং সচেতনতার অভাব। শিক্ষার আলো যত কম অত্যাচার, অবিচার তত বেশি। কম বয়সে দায়মুক্ত হতে গ্রামের গরিব বাবা-মা নাবালিকা কন্যাকে পাত্রস্থ করে এবং মেয়েকে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে ছেড়ে দেন। সেই মেয়েকে অত্যাচারিত হতে হতে হয় এক সময় আত্মহত্যা করে, না হয় খুন হয়। বিভিন্ন বয়সি মেয়েদের এমন করুণ পরিণতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে সর্বাগ্রে জরুরি নারী ক্ষমতায়ন এবং সেই ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হল শিক্ষা। একটি মেয়ে যদি ঠিকমতো মানুষ না হয়, জগৎ সম্পর্কে কিছু না জানে, স্বনির্ভর না হয় তবে এই অত্যাচার বন্ধের উপায় নেই। এই উপলব্ধির ফলশ্রুতি হিসেবে তৈরি হয় নিষ্ঠার অ্যাডোলসেন্স গ্রুপ বা বয়ঃসন্ধি বাহিনী। এই রকম আরও চারটে গ্রুপ তৈরি করা হয়।
আরও পড়ুন-এইমসে নিয়োগে দুর্নীতি বিজেপিরই
প্রথম গ্রুপটি হল আট থেকে এগারো বছরের মেয়েদের নিয়ে বালক-বালিকা বাহিনী, দ্বিতীয় তেরো থেকে উনিশ বছর পর্যন্ত বয়ঃসন্ধি বা অ্যাডোলসেন্স গ্রুপ, তারপর ইউথ বা যুবক-যুবতী গ্রুপ, মধ্যবয়সি মহিলাদের নিয়ে অ্যাডাল্ট গ্রুপ এবং বয়স্ক মহিলাদের নিয়ে এজেড গ্রুপ। তখন থেকে মিনা দাস এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ঠিক করলেন ছোট ছোট গ্রুপে গ্রামের মেয়েদের বিনামূল্যে টিউশন পড়ানো হবে। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। টিউশন পড়াতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকেন। কারণ গ্রামের মেয়েদের পড়াশুনোর চর্চা প্রায় ছিল না। ফলে কেউ পড়ানোর জায়গা দিত না। কোনওমতে একটা জায়গা পেলে সেটা গিয়ে ভেঙে দেওয়া হত। মাঠেঘাটে গাছের তলায় বসে পড়ানোর চেষ্টা করলে বিভিন্নভাবে গ্রামের ছেলেপিলে, পুরুষেরা তাঁদের উত্ত্যক্ত করত, বিরক্ত করত। বিভিন্ন সময় তাড়িয়েও দেওয়া হত। তখন মিনা দাস মহিলাদের নিয়ে একটা বড় গ্রুপ তৈরি করলেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন মহিলাদের আসল বিপদ হল তাঁরা একা কিন্তু দল হলে একটু হলেও বিপদ থেকে তাঁরা রক্ষা পাবে এবং কোথাও কোনও বাধা এলে গ্রাম জুড়ে মহিলাবাহিনী সেই লড়াইয়ে শামিল হতে পারবে। কারণ একটা গোটা দল থাকলে সহজে কেউ আর গোলমাল করতে বা কাউকে অত্যাচার করতে সাহস করবে না। এই করে বর্তমানে নিষ্ঠা মহিলামণ্ডলের সদস্য সংখ্যা প্রায় আঠারো হাজারেরও বেশি। বয়ঃসন্ধি গ্রুপের সদস্য ৯ হাজারেরও বেশি।
আরও পড়ুন-থাইল্যান্ডের নাইট ক্লাবে ভয়াবহ আগুন, মৃত ১৩
এইভাবে ‘নিষ্ঠা’ কিশলয় থেকে মহীরুহে পরিণত হতে শুরু করল। বর্তমানে এই মহিলাদের জন্য উৎসর্গীকৃত সংগঠনটির শাখাপ্রশাখা বহুদূর বিস্তৃত। বারুইপুর, বিষ্ণুপুর, মগরাহাট, সোনারপুর ব্লক জুড়ে কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নামখানা এবং বীরভূমও।
প্রীতিলতা দাসের নাতনি মনামি দাস এই মুহূর্তে নিষ্ঠার প্রজেক্ট হেড। এই সংগঠনের বৃহৎ কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব অনেকটাই এই মুহূর্তে তাঁরই কাঁধে। শৈশবে ‘নিষ্ঠা’কে ভালবেসেই বড় হয়ে ওঠা তাঁর। শহরে পড়াশুনো করলেও উদ্দেশ্য একটাই ছিল ভবিষ্যতে এই সংগঠনের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করা। প্রায় ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে ‘নিষ্ঠা’র নানা ধরনের প্রজেক্ট পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিচ্ছেন মনামি দাস। তিনি চান তাঁর মেয়েও বড় হয়ে এই সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত হোক। তাঁর কাছে জানা গেল এই সংগঠনের বর্তমান বহুমুখী কর্মকাণ্ডের কথা। জানালেন, ‘নিষ্ঠা’র মূল উদ্দেশ্যই হল মহিলাদের সশক্তীকরণ করা এবং ক্ষমতায়ন করা।
আরও পড়ুন-সংসদ হোক বা বসতি, জনতার বিরোধিতা গুঁড়িয়ে দেবে বুলডোজার
এই ক্ষমতায়ন দু’ভাবে সম্ভব এক তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা এবং দুই তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলা। কিন্তু শুধু টিউশনের মাধ্যমে সেই শিক্ষা পর্যাপ্ত হবে না। ততদিনে নিষ্ঠার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তখন বহু মানুষ এগিয়ে এলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিছু কিছু সহৃদয় মানুষ যাঁর বা যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা কয়েকটি মেয়ের শিক্ষার ভার গ্রহণ করলেন। তখন থেকেই ‘নিষ্ঠা’ মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করতে শুরু করে। কারণ স্কুলে ভর্তি হলেই এই সব নাবালিকারা দুটো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে বাঁচবে— বাল্যবিবাহ এবং পাচার বা ট্রাফিকিং। এই সংগঠনের অ্যাডোলোসেন্স বা বয়ঃসন্ধি গ্রুপের ন’হাজার মেয়েই এখন স্কুলে পড়াশুনো করে। এই কিশোরীদের এডুকেশনাল মেটিরিয়াল, টিউশন ফি এবং হাইজিন কিট দিয়ে সাহায্য করে ‘নিষ্ঠা’। এখানেও একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল এই সংগঠনের— বললেন মনামি তা হল বয়ঃসন্ধিতে বহু মেয়ে স্কুল ড্রপ আউট হয়। তারা আর স্কুলে আসতে চায় না। এর মূল কারণ হল এই বয়সে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। পিরিয়ডের সময় অত লম্বা সময় বিনা সুরক্ষায় স্কুলে থাকা অসুবিধাজনক তাই স্কুল বাঙ্ক করতে থাকে। প্রতিমাসে এটা করতে গিয়ে দেখা গেল মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। পরিবারেরও সামর্থ্য নেই। কাজেই হাইজিন কিট পেলে স্কুল বাঙ্ক করার ইচ্ছেটা কমবে এবং পাশাপশি পড়াশুনোর মেটিরিয়াল এবং টিউশন ফি-ও ‘নিষ্ঠা’র পক্ষ থেকে তাঁদের দেওয়া হয়। কারণ গ্রামের গরিব পরিবারের বাবা-মায়েদের সামর্থ্য থাকে না মেয়েকে পড়াশুনো করানোর। এই তিনটে গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী সরবরাহ করার ফলে গ্রুপের মেয়েদের স্কুল আসা সমস্যাজনক হয় না। এখানেই শেষ নয় তাদের স্কুলে আসা থেকে টিউশন যাওয়া— সবটার প্রতি তীক্ষ্ণ নজরও থাকে।
আরও পড়ুন-অরণ্যভূমিতে গড়ে উঠবে মহিলাদের নয়া জীবন-জীবিকা
‘নিষ্ঠা’ ছোটদের গ্রুপকে বিভিন্ন বিষয়ে লিডারশিপ ট্রেনিং দেয় যাতে তারা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে যেমন, চাইল্ড ম্যারেজ, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন, ট্রাফিকিং বা নারী ও শিশু পাচার, সাইবার ক্রাইম ইত্যাদি। যাতে শহরের মতো গ্রামের মেয়েরাও সবটা জানতে এবং বুঝতে পারে।
এই সংগঠনের অন্তর্গত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গ্রুমিং সেন্টার, স্পোকেন ইংলিশ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় বিনামূল্যে যাতে ভবিষ্যতে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারে। স্বাবলম্বী হতে পারে।
সদ্য, কলেজ পাশ করা মেয়েরাই ‘নিষ্ঠা’র ইউথ ফেডারেশনের বা যুবা গ্রুপের লিডার। এদের কাজ হল বয়ঃসন্ধি গ্রুপ ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা দেখা। ওই গ্রুপকে শক্তিশালী করে তোলা। অন্য গ্রামে গিয়ে আরও নতুন চাইল্ড গ্রুপ, অ্যাডোলসেন্স গ্রুপ এবং ইউথ গ্রুপ তৈরি করা।
‘নিষ্ঠা’র মহিলামণ্ডল গ্রুপের কাজ হল বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে নতুন মহিলামণ্ডল তৈরি করা। প্রতিটা গ্রামে এক একটি পাড়া নিয়ে তৈরি হয় এই মহিলাদল। দলের উদ্দেশ্য নিজেদের এবং আশপাশের প্রতিটা গ্রামের মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো। নারী-শিশু পাচার, নাবালিকা বিবাহ, যে কোনও অপরাধমূলক কর্ম আটকানো। ওই গ্রামে কোনও মহিলা গৃহহিংসা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হলে সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ হস্তক্ষেপে তাঁর সমাধান নিষ্পত্তিকরা। মামলা হলে কোর্টে যাওয়া এবং থানা পুলিশ সব দায়িত্ব এই সব মহিলামণ্ডলের। ‘নিষ্ঠা’র মহিলা গ্রুপ বর্তমানে নিজেরা চাঁদা তুলে কোর্টে প্রায় বাহান্নটি কেস চালাচ্ছেন। এই কেসগুলো সব দায়িত্ব তাঁরা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন-অরণ্যভূমিতে গড়ে উঠবে মহিলাদের নয়া জীবন-জীবিকা
সম্প্রতি করোনা অতিমারি কালে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অনেকাংশে বেড়ে গেছে। জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের সর্বস্তরে মহিলাই কোনও না কোনওভাবে নির্যাতিতা। তাই নারী ক্ষমতায়নে তাঁদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ‘নিষ্ঠা’র অন্তর্গত প্রায় ৫৭টা মহিলা গ্রুপ আছে যেখানে ৫৫৭ জন মহিলা রয়েছেন। যাঁরা স্বনির্ভর হয়েছেন বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে। এই সংগঠনে মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কাঁথাস্টিচের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, আচার তৈরির গ্রুপ রয়েছে, বড়ি তৈরির গ্রুপ, জুট সামগ্রী তৈরির গ্রুপ রয়েছে, মাদুর তৈরির গ্রুপ রয়েছে। মধ্যবয়সি থেকে বৃদ্ধা— যে কেউ এই প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসব গ্রুপে থেকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে সক্ষম। এর জন্য ‘নিষ্ঠা’র মহিলামণ্ডলের নিজস্ব ফান্ড রয়েছে যেখান থেকে তাঁরা বিনা সুদে টাকা লোন নেয় এবং ব্যবসা করে সেই টাকায় আসলটা তাঁরা শোধ করেন। কারণ এই অর্থ মহিলাদেরই। তাঁরাই রাখেন তাঁদের জন্যই সবটা।
আরও পড়ুন-কুস্তিতে সোনার হ্যাটট্রিক বজরং, সাক্ষীর পর স্বর্ণপদক দীপকেরও
‘নিষ্ঠা’য় একটি রাত্রিনিবাস রয়েছে যেখানে যৌনকর্মীদের সন্তানরা সারাদিন রাত থেকে পড়াশুনো করে। বারুইপুরে শাসনে একটি রেডলাইট এরিয়ার যৌনকর্মী এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নব্বইয়ের সময় থেকে কাজ করছে ‘নিষ্ঠা’। উদ্দেশ্য একটাই তাঁদের সন্তানদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনদান। কারণ মায়ের সঙ্গে থাকতে গিয়ে এই সব বাচ্চারা একটা সময় সেই অন্ধকারেই হারিয়ে যেত। তাই তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছে এই সংগঠন। এইসব ছেলেমেয়েরা সন্ধে থেকে পরেরদিন স্কুল যাওয়া পর্যন্ত এই নাইট শেল্টারে থাকে। সেখানে তারা পড়ে, নাচ, গান আঁকা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ নেয় তারপর পরবর্তীকালে আরও পড়তে চাইলে সেই ব্যবস্থাও করে দেয় ‘নিষ্ঠা’। এই সংগঠনের একটি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে যেখানে ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারদের নিয়ে প্রাইমারি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত বিভিন্নভাবে তৈরি করা হয় এরপর তাদের সরকারি স্কুলে মেনস্ট্রিমে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এই সব বাচ্চা মূলত স্কুল ড্রপ-আউট চিল্ড্রেন। যাঁদের বাবা-মায়েরা খেটেখাওয়া দিনমজুর। রোজ সকালে শহরে পাড়ি দিয়ে সেই রাতে ফেরে ফলে এই পরিবারের বাচ্চারা স্কুল তো যায়ই না নষ্ট হয়ে যায়, পরিবার থেকে ফিজিকালি অ্যাবিউজড হয়। তাদের সুস্থ পরিবেশ দিতে এই ডে-কেয়ার সেন্টার।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পাওনা প্রায় ১ লক্ষ ৯৬৮ কোটি টাকা মেটানোর দাবি মুখ্যমন্ত্রীর
স্পেশ্যাল চাইল্ডদের জন্য এক ছাদের তলায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। নিষ্ঠায় যেখানে তাঁরা স্পিচথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পেশ্যাল এডুকেশন— সব সুবিধা তাঁরা পায়। শুধু এইসব শিশুর নয় তাঁদের মায়েদেরও আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে তাঁরা নিজের সন্তানের ত্রুটি বুঝে ঠিক পদ্ধতিতে বড় করে তুলতে সক্ষম হয়। এঁরা প্রত্যেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। এই সংগঠনের কোনও ছুটি নেই। বছরের ৩৬৫ দিন এখানকার সদস্যারা মানুষের জন্য কাজ করেন।
আরও পড়ুন-কমনওয়েলথ গেমস: প্যারা পাওয়ারলিফটিংয়ে সুধীরের ঐতিহাসিক সোনা জয়, অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর
আমপান, আয়লা, ইয়াস, করোনা অতিমারিতে নারী-পুরুষ বিচার করেনি ‘নিষ্ঠা’। লকডাউন পিরিয়ডে গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ব্লকে-ব্লকে গিয়ে কাজ করেছে। বারুইপুর তো আছেই, মগরাহাট, বিষ্ণুপুর, নামখানা, কুলতলি, জয়নগর— সর্বত্র গিয়ে শুকনো খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ত্রাণসামগ্রী জামাকাপড়, পড়াশুনোর সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে তাঁরা। ‘নিষ্ঠা’র ইউথ গ্রুপ মেডিকেল কিট নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল গ্রামে-গ্রামে ঘরে-ঘরে। এই কাজে প্রতিটা মুহূর্তে নিষ্ঠা সাহায্য পেয়েছে রাজ্য সরকার তথা প্রশাসনের। কারণ সরকারি সাহায্য ছাড়া এত বড় প্রয়াস সম্ভব হত না। ‘নিষ্ঠা’র পরবর্তী পরিকল্পনা আরও বেশি করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন, তাঁদের এগিয়ে নিয়ে আসা ও সমাজে তাঁদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা৷