১৯৪৭। দেশভাগ। বাঙালি মুসলমান ভেবেছিল আগে ধর্ম, পরে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা।
১৯৫২। ভাষা আন্দোলন। বাঙালি মুসলমান বুঝেছিল আগে মাতৃভাষা, মায়ের ভাষা, পরে ধর্মকেন্দ্রিক সম্পর্কের বুনোট।
সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ এভাবেই ভারত ভাগ থেকে পাকিস্তান ভাগ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিবর্তন— এই যাত্রাপথটাকে ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত হওয়া কিংবা না-হওয়াকে দূরে সরিয়ে রাখলে যেটা পড়ে থাকে, সেটা হল একেবারে রসকষহীন ইতিহাস।
সেই ইতিহাসের পাতাতেই আজ চোখ আমাদের।
আরও পড়ুন-আত্মজাগানিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ
ওই যে শুরুতে ১৯৪৭-এর উল্লেখ, সেটা অবান্তর কোনও সূচনা নয়। ১৯৪৭-এ এই সলতে পাকানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ওই রাষ্ট্রটির সঙ্গে অন্বিত হয়ে ছিল উর্দু-বাংলা বিতর্ক। এই বিতর্কের পিছনে ছিল দু-দুটো দেশলাই কাঠি। এক মাতৃভাষা নিয়ে আবেগ। দুই, আবেগবর্জিত অর্থনীতি।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির গঠন যখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন ‘মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হল, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনও ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।” এটা আবেগ। বাস্তবতাবর্জিত আবেগ।
আবার ১৯৪৭-এ ‘দৈনিক আজাদি’ পত্রিকায় সাংবাদিক আবদুল হক লিখলেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরির যোগ্যতা লাভ করবেন এবং প্রত্যেকটি বাংলাভাষীই চাকুরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন।” এটা আশঙ্কা। আবেগবর্জিত বাস্তবতাজাত আশঙ্কা।
পাকিস্তানে তখন শুধুই উর্দু। মুদ্রায় উর্দু। ডাকটিকিটে উর্দু। পোস্টকার্ডে উর্দু। ট্রেনের টিকিটেও উর্দু। কোথাও কোথাও উর্দুর সঙ্গে ইংরেজি। বাংলা কোত্থাও নেই।
আরও পড়ুন-চৈতন্যের আলো
ক্ষোভে ফেটে পড়লেন পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাঙালি অফিসাররা। কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা চাই। মুদ্রা, ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, ট্রেনের টিকিট— সব জায়গায় উর্দু আর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও চাইছিলেন তাঁরা। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদের অধিবেশনে সাফাই দিলেন, উর্দু-বাংলা বিতর্ক শুরু হওয়ার ঢের আগেই ওসব ছাপা হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর কিছু করার নেই। এমন সাফাইয়ে চিঁড়ে যে ভিজল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। বরং অসন্তোষ তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলা শুরু করল।
এর মধ্যে এসে পড়ল ২১ মার্চ, ১৯৪৮। পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তার চেয়েও বড় কথা, তিনিই ‘কায়েদে আজম’ আবার তিনিই ‘বাবায়ে কওম’। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্দ্বিধ ঘোষণা, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
বাঙালি প্রমাদ গুনল।
আরও পড়ুন-শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে শিবরাত্রির পুজো দিলেন দূরদূরান্তের মানুষ
২৬ জানুয়ারি, ১৯৫২। জিন্নাহ তখন প্রয়াত। পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, উর্দুই হবে সেদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি ভেঙে পড়ল।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২। ঢাকা সফরে এলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনিও জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। বাঙালির চোয়াল শক্ত হল।
স্লোগান উঠল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
২৮ জানুয়ারি, ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হল ধর্মঘট। বিক্ষোভে মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠল গোটা দেশ। নেতৃত্বে ‘মজলুম জননেতা’ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি।
আরও পড়ুন-বিএসএফের গুলিতে মৃত্যু
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-তে দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল। আর, ধর্মঘট রুখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের এলাকায় জারি হল ১৪৪ ধারা। ২১ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে শুরু হল ধরপাকড়। একের পর এক ছাত্রনেতা কারাবন্দি হলেন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একদল নেতা সিদ্ধান্ত নিলেন, হরতাল বাতিল করা হবে এবং ভাঙা হবে না ১৪৪ ধারা। রাত ১০টায় সেই সিদ্ধান্তের কথাটা মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হল।
রাত ১২টায় ঢাকা হলের পুকুরের পূর্বদিকের পাড়ে আর একদল ছাত্র শুরু করল গোপন বৈঠক। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল, পরদিন আমতলায় সভা হবে। সেই সভায় সভাপতিত্ব করবেন গাজিউল হক। তিনি পেশায় আইনজীবী। তিনি গ্রেপ্তার হলে সভাপতিত্ব করবেন আখতার মুকুল। তাঁকেও যদি পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তবে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করবেন সৈয়দ কামরুদ্দিন হোসেইন শহুদ। সভা থেকে তখন ১৪৪ ধারা ভাঙার ডাক দেওয়া হবে। তার আগে নয়।
আরও পড়ুন-অভিষেকের সভার আগেই ভাঙল কংগ্রেস
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে আটটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামের মাঠে হাজার হাজার পুলিশে ছয়লাপ। সঙ্গে কাঁদানে গ্যাসের স্কোয়াড। একটা দুটো করে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট মিছিল আসা শুরু হল।
বেলা সাড়ে এগারোটা। দশ হাজার ছাত্রছাত্রী ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে স্টেডিয়ামের মাঠে। স্লোগান উঠল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
এদিকে আমতলার সভা শুরু হয়ে গিয়েছে। মঞ্চ থেকে তখনও বক্তব্য রাখা হচ্ছে ১৪৪ ধারা না-ভাঙার পক্ষে। একই সঙ্গে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থনও জ্ঞাপন করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে খবর এল, লালবাগ এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের একটা মিছিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে।
ব্যস! ভেঙে গেল সংযমের বাঁধ।
আবদুল মতিন আর গাজিউল হক, দুজনেই ১৪৪ ধারা ভাঙার ডাক দিলেন। চারদিক কাঁপিয়ে স্লোগান উঠল, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না’।
আরও পড়ুন-স্মৃতির আঁকা ছবি পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাঠালেন উপহার
কীভাবে ভাঙা হবে ১৪৪ ধারা?
ঠিক হল, সবাই একসঙ্গে নয়, দশজন করে মিছিল করবে ছেলেমেয়েরা। নামবে রাস্তায়। কলাভবনের গেট খুলে দেওয়া হল।
প্রথম মিছিলের নেতৃত্বে হাবিবুর রহমান। দ্বিতীয় দশজনী মিছিলের নেতৃত্বে যৌথভাবে আবদুস সামাদ আজাদ ও ইব্রাহিম তাহা। তৃতীয় মিছিলের নেতৃত্বেও দুইজন, আনোয়ারুল হক এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। চতুর্থ মিছিলটি মেয়েদের। পুলিশ কাদের কাদের কারারুদ্ধ করল, তাদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব নিলেন মোহাম্মদ সুলতান আর কাজি আজহার।
আচমকা পুলিশের লাঠিচার্জ। সেইসঙ্গে শুরু হল কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া।
ছেলেমেয়েরা দৌড়ে-দৌড়ে আসতে লাগল কলাভবনের পুকুরে। রুমাল ভিজিয়ে চোখে দেয়। ফের ছুটে গিয়ে যোগ দেয় মিছিলে।
একদমই আচমকা ঘটল একটা ঘটনা। টিয়ারশেল এসে আঘাত হানল গাজিউল হকের বুকে। অজ্ঞান হয়ে পড়লেন তিনি।
দোতলার কমন রুমে উঠে গেল মেয়েরা। নিচে বেলা ২টো পর্যন্ত ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকল। পুলিশ লাঠিচার্জ করছে আর ছেলেমেয়েরা ঢিল ছুঁড়ছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ।
আরও পড়ুন-ইংল্যান্ডের কাছে হার ভারতের
এরমধ্যেই কলাভবন আর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল ছাত্রছাত্রীরাই। স্রেফ যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আর তারই সঙ্গে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পুলিশ তখন বেপরোয়া।
নাঃ! কোনও আগাম সংকেত ছিল না। একদল সশস্ত্র পুলিশ দৌড়ে এসে পজিশন নিল জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশির নির্দেশেই তাদের এই কাজ। চারদিকে তখন ক্লোরোপিকরিনের ধোঁয়া। তার মাঝেই চলল গুলি।
একের পর এক ছাত্র লুটিয়ে পড়তে লাগল মাটিতে, কেউ কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এদের মধ্যেই ছিলেন জব্বার, রফিকউদ্দিন আর বরকত।
আরও পড়ুন-মাথায় বল, ছিটকে গেলেন ওয়ার্নার
সেই অভিশপ্ত দিনটায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে ডিউটি ছিল মুহম্মদ মাহফুজ হোসেনের। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি আমি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয়। আর ঊরুতে গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান রাতে, আমার চোখের সামনেই।”
বিবিসি-কে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে মাহফুজ আরও বলেন, “আমরা তখন বাইরে থেকে বহু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা শুনেছিলাম বহু মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে। মুহূর্তেই এমার্জেন্সি ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে যায়। আহতদের অনেকেই মুমূর্ষু, তাদের সঙ্গে আসা মানুষজন আর চিকিৎসকে ঠাসাঠাসি হয়ে যায় জরুরি বিভাগ।”
আরও পড়ুন-নেতৃত্বে স্মৃতিই, ঘোষণা বিরাটের
সেদিন আহত হয়েছিলেন আবদুস সালাম। বাদামতলির একটা ছাপাখানায় কাজ করতেন। ১৪৪ ধারা ভাঙার মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের গুলি লাগে শরীরে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা চলে তাঁর।
১৭ এপ্রিল, ১৯৫২। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেই মারা গেলেন সালাম। রফিক, বরকত, জব্বারের মতোই আর এক ভাষা শহিদ।
তবে কি শহিদের সংখ্যা এই চারই? তার বেশি নয়?
এম আর আখতার মুকুলের লেখা ‘একুশের দলিল’ কিন্তু অন্য কথা বলছে। ওই ‘দলিল’ জানাচ্ছে, “ওইদিন এ ছাড়া রাস্তায় পড়ে থাকা আরও কিছু লাশ পুলিশ দ্রুত ট্রাকে করে নিয়ে যায়, যাদের পরিচয় আর জানা যায়নি।”
আরও পড়ুন-প্রয়াত সাংবাদিক তাপস গঙ্গোপাধ্যায়, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
প্রতিটি প্রদীপ জ্বালানোর আগে একটা সলতে পাকানোর ইতিহাস থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-র ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল মুজিবুর রহমানকে। ১১ থেকে ১৫ মার্চ, জেলেই কেটেছিল তাঁর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে ওই পাঁচদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে মুজিব লিখেছেন, “দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত আর চারটেয় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’— নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, হক সাহেব, ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।”
প্রতিটি প্রদীপ জ্বলে ওঠার পর আলো ছড়ায়। যতক্ষণ সেই দেদীপ্যমান আলো সলতে আর তেলের সাহচর্য সঠিকভাবে পায়, ততক্ষণ সেই আলো বাতাসকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য রাখে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-র ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ পূর্ব পাকিস্তানে গণ-আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। বিক্ষোভ দমনের জন্য জারি হয় সান্ধ্য আইন।
সান্ধ্য আইন ভেঙে মিছিল বের হল, ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সেই শুক্রবারই প্রথম ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে পূর্ব বাংলায় সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়েছিল। আর সেদিনই, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯- এ খুলনায় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হল দশজনের, আহতের সংখ্যা তিরিশ।
আরও পড়ুন-নাট্যমেলায় দ্বিমুখী তরঙ্গ
২১ ফেব্রয়ারি, ১৯৭১। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন পাকিস্তানের মসনদে। শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানালেন মুজিব। তিনি বক্তৃতায় বললেন, “শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না। চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।… শহিদের আত্মা আজ বাংলার ঘরে ঘরে ফরিয়াদ করে ফিরছে, বলছে, বাঙালি তুমি কাপুরুষ হইয়ো না। স্বাধিকার আদায় কর।”
শহিদ বেদি থেকে সেদিন আহ্বান জানালেন মুজিব, “আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রস্তুত হও। দরকার হয় রক্ত দিব। কিন্তু স্বাধিকারের দাবির প্রশ্নে কোনও আপস নাই।”
এই আপসহীন সংগ্রামের আহ্বানেই শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু তারপর?
আমরা এখানে, এপার বাংলায়, বাংলা ভাষা চর্চা নিয়ে অনেক সময়েই হতাশা ব্যক্ত করে ফেলি। ইংরেজি মিডিয়ামের দাপট আর আধিপত্য নিয়ে রাগ করি। কিন্তু যেদেশে বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি বাঙালির স্বাধিকার অর্জনে পরিণতি লাভ করেছে, সেই দেশেই বাংলা নিয়ে ভাবনাচিন্তা কোন খাতে বইছে, সেটা আমাদের আবেগের তোড়ে ভেসে যায়।
বাংলাদেশের জুলফিকার রাসেল পাঁচ-ছয় বছর আগে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যা লিখেছিলেন, সেটাই উদ্ধৃত করা যাক।
আরও পড়ুন-শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে শিবরাত্রির পুজো দিলেন দূরদূরান্তের মানুষ
“বাংলা এখনও পূর্ণ মর্যাদার আসনে বসতে পারেনি। এখনও চাকরির জন্য বাংলার আগে ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখনও দফতরগুলোতে ইংরেজির প্রাধান্যই বেশি। অথচ যে ভাষা আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি, তার মূল্যায়ন করার দায়িত্ব তো আমাদেরই ছিল।”
এপার হোক বা ওপার, আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস বোধহয় সব পাড়েই। এবং সেটা অভিন্ন কারণে।