প্রতিবছর ভারতে বিশেষত বর্ষাকালে বিভিন্ন রকমের জ্বর ছড়িয়ে থাকে। এই সময় হাসপাতালের বহির্বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যে ধরনের জ্বরের আধিক্য দেখে থাকেন সেগুলোর মধ্যে প্রধানত হল ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, স্ক্রাব টাইফাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি সঙ্গে ইদানীং সবচেয়ে বেশি যে জ্বরের কথা শোনা এবং দেখা যাচ্ছে সেটা হল কোভিড-১৯।
আরও পড়ুন-বেঙ্গালুরু ঈদগাহ ময়দানে গণেশ চতুর্থী উদযাপন নিষিদ্ধ, রায় সুপ্রিম কোর্টের
ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া মুখে মুখে শোনা একটা অসুখ হলেও এই জ্বর কিন্তু প্রাণনাশক সঠিক সময় ওষুধ না খেলে। এটি একটি মশাবাহিত রোগ। এটা হয় ফিমেল অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে। এই মশার কামড়ে প্লাসমোডিয়াম প্যারাসাইট আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তার ফলে এই জ্বর হয়।
ম্যালেরিয়ার উপসর্গ
মাথাব্যথা সঙ্গে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা ম্যালেরিয়ার উপসর্গ। মশা কামড়ানো দশ থেকে পনেরোদিনের পরে এই ম্যালেরিয়ার উপসর্গ দেখা দেয়। যদি প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার ঠিকমতো চিকিৎসা না হয় সেক্ষেত্রে এই রোগ মারাত্মক আকার নিতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ম্যালেরিয়া রোগে বিশেষভাবে মারাত্মক হয়ে ওঠে পাঁচবছরের নিচে বাচ্চাদের, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং এইচআইভি বা এডস সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন-মথুরা রেলওয়ে স্টেশন থেকে চুরি হওয়া শিশু স্থানীয় বিজেপি নেতার বাড়ি থেকে উদ্ধার
ম্যালেরিয়ার থেকে বাঁচার উপায় হল মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানো। মশারি এবং মশা মারার স্প্রের ব্যবহার ও বাড়ির আশপাশে জল জমতে না দেওয়া।
ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা কম খরচে করা যায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। মাইক্রোস্কোপে রক্ত পরীক্ষা করেই বলা যেতে পারে কী প্রকার ম্যালেরিয়া হয়েছে। এটার জন্য ট্রিটমেন্টের সময় আর্টিমিসিন বা ক্লোরোকুইন দেওয়া হয়ে থাকে। সেই চিকিৎসা খুব বেশি খরচসাপেক্ষ নয়। ২০২০ সালে গোটা বিশ্বে ছ’ লক্ষ সাতাশ হাজার লোক মারা গেছেন শুধু এই ম্যালেরিয়ার কারণে।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গুও একটি মশাবাহিত রোগ। এই রোগের প্রধান লক্ষণ হল জ্বর। ডেঙ্গু-জ্বর একটি ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ডেঙ্গু-ভাইরাসকে বহন করে ফিমেল অ্যাডিস ইজিপ্টি মশা।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
ডেঙ্গুর উপসর্গগুলির মধ্যে প্রথম হল তীব্র জ্বর। এর সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, বমি পাওয়া এবং হাত পায়ের পেশিতে ব্যথা বা গাঁটে গাঁটে ব্যথা দেখা যায়।
এর সঙ্গে ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকতে পারে গায়ে হাতে পায়ে র্যাশ। খুব বেশি ভয়াবহ হলে ডেঙ্গু-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তক্ষরণ হয় দাঁত এবং মলদ্বার থেকে।
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় দেরি হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডেঙ্গু পাঁচ ধরনের হয়। সাধারণত একবার কোনও একটি ভাইরাস মানবদেহ আক্রান্ত করলে সেটার বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। অর্থাৎ ডেঙ্গু ওয়ান ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার শরীর শুধমাত্র ডেঙ্গু ভাইরাস ওয়ানের থেকেই ইমিউনিটি পাবে অন্যগুলো থেকে পাবে না।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় মশার কামড় থেকে দূরে থাকা। জমা জল যাতে না থাকে। ঢাকা জামাকাপড় পরতে হবে।
ডেঙ্গু সন্দেহ হলে, প্রথম তিনদিনের মধ্যেই NS1 পরীক্ষা করতে হয় এবং তারপর ডেঙ্গু আইজিএম (Dengue IgM) টেস্ট করানো হয়।
ডেঙ্গু হলে প্রচুর জল খেতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ আর স্যালাইন হল চিকিৎসা। ডেঙ্গুতে বাড়াবাড়ি হলে প্লেটলেট দেওয়ার দরকার পড়তে পারে। ডেঙ্গু শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য ভয়ের।
আরও পড়ুন-বন্দুকবাজের গুলিতে হত ৭
টাইফয়েড
টাইফয়েড জ্বর হয় সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার জন্য। এই জ্বর খুব সাধারণ বা সামান্য রোগ থেকে ভয়ঙ্কর পর্যায় চলে যেতে পারে। সালমোনেলা টাইফি মুখ দিয়ে গ্রহণ করার ছয় থেকে তিরিশ দিনের মধ্যে টাইফয়েড জ্বরের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া খাবার ও জলের সঙ্গে মুখের মধ্যে দিয়ে সংক্রমিত হয়।
টাইফয়েডের উপসর্গ
পেটে প্রচণ্ড ব্যথা সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্বলতা, কোষ্টকাঠিন্য বা ডায়েরিয়া দুই হতে পারে, মাথায় অসহ্য ব্যথা বা অল্প বমি হতে পারে। টাইফয়েডে সাধারণত প্রথম সপ্তাহে শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে। জ্বরের ওঠানামা দেখা যায়। পালস কমে যায়, মাথাব্যথা কাশি, ব্রাডিকর্ডিয়াও দেখা যায় অনেক সময়।
আরও পড়ুন-নৌসেনা ম্যাচের প্রস্তুতি শুরু মোহনবাগানের, আজ শহরে পেত্রাতোস
দ্বিতীয় সপ্তাহে ১০৪ ডিগ্রি জ্বরও উঠতে পারে। তখন রোগী হঠাৎ করে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। গায়ে লালচে ধরনের র্যাশ আর শ্বাসকষ্টও হতে পারে। টাইফয়েড বাড়লে রোগী বোধশক্তি হারাতে পারে। টাইফয়েড তিনসপ্তাহ থাকলে রোগী ভুল বকতে শুরু করে। পেটে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে, প্লেটলেট নেমে যেতে পারে তখন জীবনহানির আশঙ্কা থাকে।
এই রোগের চিকিৎসা ঠিকমতো না হলে দু-এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাসের পর মাস শরীরের ভিতরে থেকে যেতে পারে এই জীবাণু। টাইফয়েড ছড়ায় সালমোনেলা টাইফি যুক্ত খাবার বা জল খেলে হয়। এই ব্যাকটেরিয়া অন্য কারও মল থেকেই আর একজনের মধ্যে আসা সম্ভব। সেক্ষেত্রে ঠিকমতো হাত না ধুয়ে খেলে, স্যানিটাইজ না করলে, নোংরা হাতে খাবার বানালে সালমোনেলা টাইফি একজন থেকে অন্যের শরীরে ঢোকে এবং সংক্রমিত করে। এরপর এই ব্যাকটেরিয়া অন্ত্র সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। শেষে রক্তকে সংক্রমিত করে। রক্তে টাইফয়েড রয়েছে কি না তা শনাক্ত করতে টাইফি ডট আইজিএম বা উইডল টেস্ট করতে হয়।
আরও পড়ুন-আইপিএল নেতৃত্ব বদলে দিয়েছে হার্দিককে : সানি
টাইফয়েড থেকে বাঁচতে হলে পরিস্রুত জল খেতে হবে। হাত ধুয়ে তবে খাবার খেতে হবে। টাইফয়েডের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেমন অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও বিভিন্ন ধরনের ফ্লুরোকুইনারল জাতীয় ওষুধ।
ইনফ্লুয়েঞ্জা
জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, অত্যধিক ক্লান্তি, গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা বা গলাব্যথা, নাক দিয়ে জলপড়া সবই ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ। এটি-একটি ভাইরাসজনিত রোগ। হাঁচি কাশি ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একজনের থেকে আর একজনের শরীরে। কাশি খুব সামান্য থেকে শুরু প্রচণ্ড বাড়তে পারে। প্রায় দু’ থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ এই ধরনের জ্বর, সর্দিকাশিতে ভুগে থাকেন। তবে মনে রাখতে হবে বিনা চিকিৎসায় ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি মারাত্মক রোগ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে খুব বয়স্ক মানুষ বা যাঁদের কো-মর্বিডিটি রয়েছে তাঁদের জন্য বিপজ্জনক। এইচআইভি পজিটিভ রোগী বা কড়া স্টেরয়েড চলছে তাঁদের জন্য এই জ্বরে রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি। বাচ্চাদের স্কুলে একজনের হলে বাকি সবার মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে যেতে পারে সহজেই। মোটামুটি পাঁচবছরের নিচের শিশুরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় প্রায়শই আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবায় যাঁরা রয়েছেন তাঁদেরও ইনফ্লুয়েঞ্জার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসযুক্ত ইনফেকশাস ড্রপলেট একটা মানুষের থেকে এক মিটার পর্যন্ত যে কোনও মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। অপরিষ্কার হাতের সংস্পর্শেও সংক্রমণ হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের। ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দু’দিনের মধ্যে সিম্পটম আসা শুরু হয়ে যায়। এই জ্বরের আলাদা কোনও পরীক্ষা হয় না। ক্লিনিক্যালি অর্থাৎ উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করা হয়।
আরও পড়ুন-শুভেন্দু-সুকান্তদের প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, কুলাঙ্গার অমিত শাহর ছেলে জয় শাহ
মাস্ক ব্যবহার করলে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোধ করা যায়। হাত ধোয়া, স্যানিটাইজেশন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে মানুষকে সুরক্ষিত রাখে। এর সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন হয়। যে বছর যে দেশে যে ধরনের ভাইরাস ছড়ায় সেই ধরনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। বাচ্চা এবং বয়স্কদের যাঁদের কো-মর্বিডিটি রয়েছে তাঁদের প্রত্যেক বছর নেওয়া উচিত ফ্লু ভ্যাকসিন।
স্ক্র্যাব টাইফাস
এটি একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ জনিত রোগ। ওরিয়েন্টাস শুশুরামুসি নামক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে শরীরে সংক্রমিত হয়। ছোট্ট একটি ট্রমবিকুলিদ মাইট নামক পোকার কামড়ে মানবদেহে এই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন-সাভারকর স্তুতি করতে গিয়ে গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদল বিজেপি, নির্লজ্জ ইতিহাস বিকৃতি কর্নাটক সরকারের
স্ক্র্যাব টাইফাসের উপসর্গ
জ্বর, মাথা যন্ত্রণা, গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, র্যাশ বেরনো। এছাড়া হয় লিম্ফাডিনোপ্যাথি। উপসর্গের মধ্যে আর একটি হল স্ক্যাব বা সিগারেটের ছ্যাঁকা লেগে পুড়ে যাবার মতো একটি ক্ষত তৈরি হওয়া শরীরের যে কোনও স্থানে। এটি জ্বরের সঙ্গে লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসকে জানানো উচিত।
এই জ্বরের জন্য স্ক্র্যাব টাইফাস আইজিএম পরীক্ষা করতে হয়। এর চিকিৎসা হল অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন জাতীয় ওষুধ। যে কোনও বয়সের মানুষকে দেওয়া যেতে পারে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। এর থেকে সুরক্ষিত থাকার উপায় হল ঢাকা দেওয়া জামাকাপড় পরা। ইনসেক্ট রিপালেন্ট ও মশারির ব্যবহার করা।
আরও পড়ুন-অবিবাহিত, সমকামী যুগলদের সম্পর্কও পরিবার হিসাবে গণ্য, সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য
কোভিড
কোভিডও কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই ভাইরাসজনিত রোগ। এটি ছড়ায় সার্স কোভ টু ভাইরাসের মাধ্যমে। এই ভাইরাস শরীরকে সংক্রমিত করে যা মাইল্ড থেকে মডারেট এবং সিভিয়র পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এতে সর্দি কাশি থেকে প্রবল জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, হাঁচি, অত্যধিক ক্লান্তি এবং মুখের স্বাদ এবং গন্ধ চলে যাওয়া থাকতে পারে। এটাও ছড়ানোর মূল মাধ্যম হল হাঁচি, কাশির ড্রপলেট। এই ড্রপলেট এক মিটার দূরত্বের ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে। এর থেকে বাঁচার উপায় হল মাস্ক পরা, হাত পরিষ্কার রাখা, কোভিড রোগীকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা করা ও সুস্থ মানুষদের ভ্যাকসিন দেওয়া। এখন বুস্টার ডোজও এসে গেছে। কাজেই ভ্যাকসিন নেওয়া খুব জরুরি।
এই সবক’টা রোগের চিকিৎসাই আর জি কর বা যে কোনও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে করা হয়।