লালগড় রাজবাড়ির সর্বমঙ্গলা মা
গভীর জঙ্গলে ঘেরা লালগড়। ঝাড়গ্রাম জেলার অন্তর্গত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বনাঞ্চলে মাথা দোলায় শাল-সেগুন। একটা সময় এলাকাটা ছিল অশান্ত। রহস্যময়। বাতাসে ভেসে বেড়াত বারুদের গন্ধ। নির্জন জঙ্গলের রাস্তায় পা ফেলতে বুক কাঁপত মানুষের। তবে গত ১২ বছরে বদলেছে পরিস্থিতি। স্বাভাবিক হয়েছে জনজীবন।
লালগড় গ্রামে আছে সুপ্রাচীন রাজবাড়ি। বিশাল এলাকা জুড়ে। তবে আগের জৌলুস এখন ফিকে। রাজবাড়ির বেশকিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বিবর্ণ হয়েছে দেওয়াল। কোথাও কোথাও গজিয়েছে গাছপালা।
আরও পড়ুন-শিউলি-গন্ধ মাখা শারদ-সাহিত্য
প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে আজও লালগড় রাজবাড়িতে আয়োজিত হয় দুর্গাপুজো। দেবী এখানে সর্বমঙ্গলা মা রূপে পূজিতা হন। কোনও মূর্তি নেই। মন্দিরের দেয়ালে চুন-সুরকি দিয়ে মা দুর্গার অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। তার উপর প্রতি বছর রং করা হয়। সর্বমঙ্গলা মাকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয় সপ্তমীর সকালে। রাজবাড়ির বর্তমান সেবাইত দর্পনারায়ণ সাহসরায় জানালেন, ‘আমাদের দুর্গাপুজো বহু প্রাচীন। আনুমানিক তিনশো বছরের বেশি পুরনো। দুর্গাপুজোর সময় খড়্গপুজোর রেওয়াজ আছে। এই খড়্গ দিয়ে এগারো হাজার অত্যাচারী বর্গির মস্তক ছেদন করা হয়েছিল। পুজোয় অতীতের জাঁকজমক আর নেই। তবে নিয়মনিষ্ঠা রয়েছে। রীতি মেনে অষ্টমীর দিন আয়োজিত হয় কুমারী পুজো। দেওয়া হয় ফল বলি। এই পুজোয় অংশ নেন গ্রামবাসীরাও। বিতরণ করা হয় প্রসাদ।’
আরও পড়ুন-সন্দেশ-এর সেরা ভূতের গপপো
শবর দেবী গুপ্তমণি
পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরের গ্রামীণ এলাকার বুক চিরে চলে গিয়েছে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। মুম্বই রোড। সাঁই সাঁই করে ছুটে যায় ছোট-বড় গাড়ি। সদাব্যস্ত এই সড়কের পাশেই রয়েছে দেবী ‘মা গুপ্তমণি’র মন্দির। তার মধ্যেই দেবীর অধিষ্ঠান। তিনি শবরদের আরাধ্যা দেবী। তবে গুপ্তমণি মা দুর্গা রূপে পূজিতা হন। খুব জাগ্রত। দেবীর কোনও বিগ্রহ নেই। পুজো করা হয় পাথরকে। হাল আমলে সামনে দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি রাখা হয়েছে। তবে সেটা মূল বিগ্রহ নয়। জানা যায়, আনুমানিক ১২৭২ বঙ্গাব্দে এই দেবীর আরাধনা শুরু হয়। তখন ঝাড়গ্রামে মল্লদেব রাজার সুবর্ণযুগ। রাজা রঘুনাথ মল্ল-উগাল-ষণ্ডদেব সিংহাসনে আসীন। হঠাৎ তাঁর প্রিয় হাতি ‘গজপতি’ নিখোঁজ হয়ে যায়। রাজার সৈন্যসামন্তরা চার দিকে দৌড়য় হাতিটিকে খুঁজে আনার জন্য। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। একদিন গভীর রাতে রাজা স্বপ্নে দেখলেন এক কিশোরী তাঁকে বলছেন, শুকনিবাসার গভীর জঙ্গলের মাঝে পাওয়া যাবে গজপতিকে। পরদিন শুকনিবাসার জঙ্গলে পৌঁছে রাজা রঘুনাথ দেখলেন, জঙ্গলের মাঝে গজপতি দাঁড়িয়ে শুঁড় দোলাচ্ছে। গজপতিকে উদ্ধার করে গড় ঝাড়গ্রামে নিয়ে যান রাজা। জনশ্রুতি, সেই রাতেই শুকনিবাসা গ্রামে শবর সম্প্রদায়ের নন্দ ভক্তা স্বপ্নাদিষ্ট হন। দেবী তাঁকে জানান, তিনি জঙ্গলের মাটির নিচে গুপ্ত-অবস্থানে রয়েছেন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নিত্যপুজো পেতে চান। দেবীর নির্দেশে নন্দ একটি মরা কারিগাছের তলায় মাটি খুঁড়ে প্রস্তর কুণ্ডে শিলাময়ী দেবীকে খুঁজে পান। বুনো ফল আর ফুল দিয়ে সেখানেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। গুপ্ত অবস্থায় থাকার জন্য দেবীর নাম হয় ‘মা গুপ্তমণি’। বিষয়টি জানতে পেরে নন্দকে সম্মানিত করেন রাজা। রাজ এস্টেটের পক্ষ থেকে শুকনিবাসা এলাকাটির মালিকানা নন্দ ভক্তার নামে দানপত্র করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, রাজার হস্তক্ষেপে জঙ্গল পরিষ্কার করে গুপ্তমণির মন্দিরও তৈরি হয়। নন্দ ভক্তাকে মন্দিরের দেহুরি ও সেবাইত নিযুক্ত করা হয়। সেই থেকে নন্দর উত্তরসূরি শবররা বংশানুক্রমে এই মন্দিরের দেহুরি ও সেবায়েতর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বর্তমানে ১৯টি শবর পরিবার ভাগ করে সারা বছর পুজোর দায়িত্ব সামলায়। তবে শারদীয় দুর্গাপুজোর সময় ১৯টি শবর ভাগিদার একসঙ্গে অংশ নেয়। পুজো হয় লোকায়ত ধারায়। শান্ত পরিবেশে। অনাড়ম্বর ভাবে। দেখা যায় নিষ্ঠা ও ভক্তি। দেবী গুপ্তমণির পরিচিতি বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা ছাড়িয়ে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। গাড়ি ছুটিয়ে যেতে যেতে অনেকেই দেবীস্থান লক্ষ্য করে খুচরো টাকা-পয়সা ছোঁড়েন। বহু মানুষ গাড়ি থেকে নেমে দেবীকে প্রণাম করে যান।
পাথর-রূপী মা দুর্গা
আরও পড়ুন-রাজ্যপালের পথের কাঁটা বিজেপির রাজনৈতিক চাপ, মন্ত্রীদের মিথ্যাচার, বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
পুরুলিয়ার ঝালদা। জঙ্গলমহল এলাকা। গাছপালা ঘেরা এই শহরের মুচি গড়িয়ায় একটু অন্যরকম ভাবে হয় মা দুর্গার আরাধনা। একটি বিশাল বটগাছের নিচে রয়েছে কালো পাথর। সেই পাথরকে ভক্তি আর বিশ্বাস ভরে শিলা-রূপী মা দুর্গা বলে পুজো করেন এলাকার মানুষরা। আদিকাল থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে এভাবেই পুজো হয়ে আসছে। পুজোর মূল বৈশিষ্ট্য হল, সারাবছর অব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কর্মকার পুরোহিত পুজো করেন। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার। কিন্তু, পুজোর পাঁচ দিন মা দুর্গা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছ থেকে পুজো নেন। এখনও কোনও মন্দির নির্মাণ হয়নি। পুজোয় বাজানো হয় না গান। থাকে না আলোর রোশনাই। কোলাহলহীন নিস্তব্ধ পরিবেশে মাতৃ আরাধনা করা হয়। এইভাবে পুজো হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
আরও পড়ুন-ভয়াবহ ভূমিকম্প আফগানিস্তানে, মৃত একাধিক
মায়ের কাছে পৌঁছাতে হয় জঙ্গলের ভিতরে মাথা ঝুঁকিয়ে। তারপরে দর্শন পাওয়া যায় শিলা-রূপে বিরাজমানা মা দুর্গার। মনে হতে পারে যেন ছোট্ট কৈলাস পাহাড়ের একটি অংশে রয়েছেন মা। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা যায় মা দুর্গার উপস্থিতি। এলাকার বাসিন্দাদের মতে, এটাই ভক্তি, এটাই বিশ্বাস। তাঁদের কথায়, ছোট থেকেই আমরা দেখে আসছি। পাশাপাশি বয়স্কদের কাছ থেকে শুনেছি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এই দুর্গাপুজো।
বাঙালি মতে নিয়ম মেনে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। দেবী খুব জাগ্রত। তাই দূর-দূরান্তের প্রচুর মানুষ আসেন পুজো দিতে। সারা বছর। মানত থাকলে মানত পূরণ করেন। শারদীয়া দুর্গাপুজোর দিনেও ভিড় হয় ভালই। স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতায় হয়ে আসছে এই পুজো। বাজেট খুব কম। কারণ কোনওরকম চাকচিক্য থাকে না। সম্পূর্ণ দূষণহীন সবুজ গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশে এ এক অন্যরকম দুর্গাপুজো। যেখানে গেলে দু-দণ্ড শান্তি মেলে। চুপচাপ বসে থাকা যায় মায়ের কাছে। জানানো যায় মনের কথা। নিষ্ঠার সঙ্গে বছরের পর বছর আয়োজিত হয়ে চলেছে এই পুজো। আগামী দিনেও চলবে। এইভাবেই। এর কোনও অন্যথা হবে না।
আরও পড়ুন-লাইফলাইন শেষ, চাঁদের দেশে চিরঘুমে বিক্রম-প্রজ্ঞান
কাটা-মুণ্ড ক্ষেপি মা দুর্গা
পূর্ব বর্ধমান জেলার গোমাই। বহু আগে নাম ছিল রাধিকাপুর। এই গ্রামে হয় মা দুর্গার কাটা-মুণ্ডর পুজো। কারণ জানতে হলে অতীতে ফিরে যেতে হবে। এই গ্রামে একসময় শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তিরসের প্রভাব ছিল খুব। সাড়ে চারশো বছর আগে কাজের সূত্রে এই গ্রামে বাসস্থান গড়ে তোলেন দিগনগরের হরগোবিন্দ রায়। তিনি জাতিতে সদগোপ। জানা যায়, একদিন ঠাকুরপুকুর নামের এক পুকুরে তিনি হঠাৎ দেখেন, একটি মেয়ের মাথা ভেসে উঠছে, আবার ডুবে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন মেয়েটি হয়তো গ্রামেরই। বেশিক্ষণ না থেকে ফিরে যান। রাতে স্বপ্নে দেখা পান সেই মেয়েটির। মেয়েটি আর কেউ নন, স্বয়ং মা দুর্গা। স্বপ্নে দেবী তাঁকে বলেন, মেয়েটির যেটুকু রূপ দেখেছেন, সেইটুকু রূপের মূর্তি গড়েই যেন দুর্গাপুজো করা হয়। দেবীর স্বপ্নাদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন হরগোবিন্দ। দুর্গাপুজো শুরু করেন কাটা মুণ্ড তৈরি করে।
পরবর্তী সময়ে মায়ের শুধু মুখখানি তৈরি করেই পুজো করা হত। সেই ধারা আজও চলছে। তাই মা দুর্গা এখানে কাটা-মুণ্ড মা নামে পরিচিত। মায়ের ছেলেমেয়ে, অসুর, সিংহ, মোষ কিছুই নেই। মন্দির চত্বরে ঢোকার দরজার উপরে আটচালার মাথায় লেখা ‘ক্ষেপী মায়ের মন্দির’। মৃৎশিল্পী এবং পুরোহিতরা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন বংশ-পরম্পরায়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কাটা-মুণ্ড দুর্গামায়ের পুজোয় আরতি হয় মাত্র একবার। সন্ধেবেলায়। অষ্টমীতে একটি কালো ছাগ বলি হয়। নবমীতে দুটি যে কোনও রঙের ছাগ বলি হয়। একটি মা দুর্গার জন্য, আর একটি মা কালীর জন্য। এ-ছাড়াও হয় মানতের বলি। ভোগ দেওয়া হয় ফলমূল, লুচি আর নুন ছাড়া ভাজা। দশমীতে হয় চিঁড়েভোগ। এই পুজোকে ঘিরে সারা গ্রাম মেতে ওঠে। আসেন দূর-দূরান্তের মানুষজনেরাও।
শিবের কোলে দুর্গা
কলকাতার ঠনঠনিয়া লাহাবাড়ির দুর্গাপুজো বহু প্রাচীন৷ প্রামাণ্য ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ১ নম্বর বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এই বাড়িটি কিনে ১৮৫৭ সালে রাজীবলোচন লাহা প্রথম এই পুজো শুরু করেন। ওঁর তিন ছেলে প্রাণকৃষ্ণ, নবকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণ। পরিবারে তিন ঘরের উত্তরসূরি প্রতি বছরই পালা অনুসারে এই পুজোটি করেন। প্রত্যেকের নিজস্ব ঠাকুরদালানে তৈরি হয় মৃন্ময়ী মূর্তি।
দেবী মহিষাসুরমর্দিনী নন, এখানে দুর্গা পূজিতা হন জগজ্জননী হিসাবে। দুর্গাপুজোর কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন। প্রথম থেকে একচালার প্রতিমাই পুজো হয়ে আসছে এই পরিবারে। বৈষ্ণব মতে পুজো করেন এঁরা। মহিষাসুর বধকে হিংস্র মনে করেন। তাই তো এঁদের কাছে মা দুর্গা দশভুজা নন, হরগৌরী রূপে আরাধ্যা। দুর্গা বসেন স্বামী শিবের কোলে। শিবের বাহু বেষ্টন করে থাকে তাঁকে। গৃহদেবী ও মৃন্ময়ী দুর্গা যেন দুই ভিন্ন রূপে একাকার। এই প্রসঙ্গেই পরিবারের মেজো তরফ অর্থাৎ নবকৃষ্ণ লাহার উত্তরসূরি পরিবারের কন্যা সুস্মেলী দত্ত জানালেন, ‘লাহা বাড়ির স্বপ্নে পাওয়া কুলদেবী হলেন শ্রীশ্রী জয় জয় মাতা। অষ্টধাতুর এই মূর্তিটি মূলত সিংহবাহিনী রূপে প্রতিষ্ঠিত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, প্রতিবছর যে মৃন্ময়ী মূর্তিটি পুজো করা হয় সেটি শিবদুর্গা মূর্তি। লাহাবাড়ির সদস্যরা মায়ের বিসর্জনের ধারণাকে একেবারেই মান্যতা দেন না। সকলেই মনে করেন, মা তাঁদের ঘরে সারা বছরই থাকেন। তাই তো দুর্গাপুজোর সময়েও কুলদেবীর সিংহাসন সবসময় প্রতীকী মৃন্ময়ী মূর্তির সামনে বসানো থাকে।’
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নীল-কালো-লাল রঙের মা দুর্গা
ভক্তি এবং শক্তির মহামিলন দেখা যায় নদীয়া জেলায়। গঙ্গা-তীরবর্তী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাভূমিতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই আয়োজিত হয়ে আসছে বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো। একসময় রাজবাড়ি, জমিদার বাড়ি, বনেদি বাড়িতে হত। পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছে সর্বজনীন পুজো। প্রচলিত দেবী মূর্তির পাশাপাশি দেখা যায় অন্য রকমের দেবী মূর্তি। নানা রঙের।
কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ায় চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর দুর্গামূর্তি নীল রঙের। শরিকি দ্বন্দ্বে বনেদি বাড়ি ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ হয়েছে পুজোও। এখন পাশাপাশি দুই বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয়। দুই বাড়িরই দেবীর রং নীল। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার রামরাইন গ্রামে। সেখানেও পুজো হত। তবে শুরু থেকেই এই দুর্গাপুজোর মূর্তি নীল রঙের ছিল না। বংশপরম্পরায় চালু রয়েছে একটি গল্প। প্রতিমা শিল্পী রাতের অন্ধকারে ভুল করে নাকি দেবীমূর্তির গায়ের রং নীল করে ফেলেছিলেন। পরদিন সকালে পুজো। তখন আর কোনও উপায় ছিল না। সেই থেকে এই বাড়ির দেবীমূর্তির রং অপরাজিতা নীল।
আরও পড়ুন-দুর্গত এলাকা দেখলেন অরূপ, দুর্যোগেও কেন্দ্রের বরাদ্দ-রাজনীতি, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
এবার আসা যাক নদিয়া জেলার কালো দুর্গার কথায়। মা কালী কালো। দুর্গাও কালো? অবাক হবেন অনেকেই। কিন্তু এটাই সত্যি। হাঁসখালির বাহিরগাছি গ্রামে যে দুর্গাপুজো হয়, সেই দেবীমূর্তির গায়ের রং কুচকুচে কালো। তবে এই পুজো বনেদি বাড়ির নয়, আশ্রমের। যেটি এলাকায় শান্তি আশ্রম বলে পরিচিত। একসময় এই পুজো ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলগ্রামের জমিদারবাড়ির। ওই বাড়ির বংশধর সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়ে বাহিরগাছিতে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপুজো শুরু করেন। পাবনার স্থল গ্রামের দুর্গামূর্তির রংও হত কুচকুচে কালো। সেখানেও রয়েছে ভুল করে কালো রং করে ফেলার গল্প। প্রায় ৫০ বছর ধরে শান্তি আশ্রমের দুর্গাপুজোর মূর্তির রং ঐতিহ্য মেনেই কালো।
লাল দুর্গার পুজো হয় নবদ্বীপের যোগনাথতলার ভট্টাচার্য বাড়িতে। একশো বছর পেরিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। এই পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মিতরা গ্রামে। সেখানেও লাল দুর্গার পুজো হত। দেশভাগের বহু আগেই তাঁরা যোগনাথতলায় চলে আসেন।
আরও পড়ুন-৩৬ ঘণ্টা হাতে আছে : দ্রাবিড়
ঐতিহ্য মেনে পূর্বপুরুষদের সেই পুজো এখনও চলছে। দেবীমূর্তির রং লাল কেন? জানতে হলে অতীতে ফিরে যেতে হবে। ঘটনাস্থল বাংলাদেশের মিতরা। দেবীবন্দনার সময় গৃহকর্তা ছেলেকে পাশে বসিয়ে চণ্ডীপাঠ করছিলেন। ছেলে বাবার উচ্চারণে ভুল ধরে। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বাবা ছেলেকেই চণ্ডীপাঠ করতে বলেন। ছেলের বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং অপূর্ব সুরের চণ্ডীপাঠ শুনে নাকি দেবী দুর্গা প্রসন্ন হন এবং দক্ষিণমুখী দুর্গা পশ্চিমমুখী হয়ে যান। সেই সঙ্গে তাঁর মুখের আভা আনন্দে লাল হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গামূর্তির গায়ের রং লাল হয়ে যায়। লাল দুর্গামূর্তি পুজো হয় কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ার চক্রবর্তী পরিবারেও। আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর শহরের নগেন্দ্রনগরে। সেখানেই শুরু হয়েছিল লাল দুর্গামূর্তির পুজো। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছন বংশধররা।
তিন হাতের মা দুর্গা
দুর্গা তো দশভুজা। দশ হাতে দশ অস্ত্র। দেবীর এমন রূপের সঙ্গেই সবার পরিচয়। কিন্তু এক জায়গায় পুজো হয় তিন হাতের মা দুর্গার। সেটা হুগলির সোমরাবাজারে। হাওড়া-কাটোয়া রেলপথে সোমরাবাজার স্টেশন। সেখান থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। সেখানেই রয়েছে সুপ্রাচীন সেনবাড়ি। ওই বাড়িতে হয় মা দুর্গার পুজো। ২৬০ বছরের বেশি সময় ধরে। প্রথম পুজো হয়েছিল ইংরেজির ১৭৬০ সালে। পলাশির যুদ্ধের তিন বছর পরে। রাজা রামচন্দ্র সেন দুর্গাপুজো প্রচলন করেন। তিনি দিল্লির নবাব বাহাদুর শাহের পৌত্র মোহম্মদ শাহের কাছ থেকে রায় রায়ান উপাধি পেয়েছিলেন। আগে তাঁরা ছিলেন নদিয়া জেলার নেদের পাড়ার বাসিন্দা। পূর্বপুরুষ কৃষ্ণরাম সেন সেখানেও দুর্গাপুজো করতেন। কিন্তু সোমরাবাজারের সেনবাড়ির পুজো রামচন্দ্র সেনের আমলেই শুরু হয়। মূর্তির বিশিষ্টতা রয়েছে। মা দুর্গার তিনটি হাত দেখা যায়। ডান দিকে দুটি হাত এবং বামদিকে একটি। ডান দিকের উপরের হাতে খড়্গ, নিচের দিকের হাতে ত্রিশূল। বাম হাত নিচের দিকে, একসঙ্গে সর্প আর অসুরের কেশ ধরা। কিন্তু মা দুর্গা তো দশভুজা। তিনটি হাত দেখা গেলেও সেনবাড়ির দেবীমূর্তির দশটি হাতই রয়েছে। হাতগুলো দেবীমূর্তির কাঁধের উপর ছোট ছোট আকারে রাখা। সাধারণত দেখা যায় না। চুলে, সজ্জায় ঢাকা থাকে। পরিবারের কেউ একজন নাকি মায়ের এই রকম মূর্তি গড়ে পুজো করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-ভোররাতে মুম্বাইয়ের বহুতলে আগুন, মৃত ৭
চতুর্ভুজা দুর্গা
হুগলির জনাই রেল স্টেশনের কাছেই বাকসা গ্রাম। এই গ্রামের চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো। প্রচলন করেন রাজরাম চৌধুরী। তখন তিনি ছিলেন বর্ধমান রাজাদের দেওয়ান। সেই পুজো এখনও চলছে। এখানকার মা দুর্গা চার হাতবিশিষ্টা। মনে করা হয়, বিষ্ণু চৌধুরীর পূর্বপুরুষেরা বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। তাই তাঁদের মা দুর্গা চতুর্ভুজা। তবে একচালির মূর্তিতে মা দুর্গা পরিবার-সহ বিরাজমান। চালচিত্রে একদিকে কৃষ্ণ, আর একদিকে রাধার মূর্তি আছে। এই রূপেই মা পূজিতা হন।
বৈষ্ণব ও শাক্ত ধারার মেলবন্ধনও ঘটেছে চৌধুরী বাড়িতে। এক সময় পশুবলি হত। এখন প্রতীক হিসেবে ফলবলি হয়। দুর্গা মণ্ডপের পিছনে আছে রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দির। নিত্যসেবা হয় মন্দিরে। তাই হয়তো বন্ধ হয়েছে পশুবলি।