ছুটির জলে সিনান সেরে এবার ফেরা কর্মলহরে

দুর্গাপুজোর দীর্ঘ ছুটি ফুরাল। এবার আবার কাজের জগতে পুরোদস্তুর প্রবেশ। উৎসব উপলক্ষে দীর্ঘ অবকাশের সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস ও অর্থনৈতিক তাৎপর্যের বিশ্লেষণ করে নেওয়া যাক এই সুযোগে। লিখছেন ড. অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়

Must read

২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতার এক বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক সম্পাদকীয় কলামে লিখেছিল কটাক্ষের সুরে, তির্যক ভঙ্গিতে—
‍‘‘ভারতবর্ষ বৈচিত্র্যময় দেশ, বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ। বস্তুত পার্বণের সংখ্যা তেরোয় থামিয়া নাই, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ পার্বণের পর পার্বণ সৃষ্টি হইতেছে। তবে শেষ অবধি এই সকল বহুমুখী ধারা আসিয়া মিলিয়া যায় একটি মহাসমুদ্রে, তাহার নাম ছুটির সমুদ্র।’’
পত্রিকাটি কটাক্ষের সুরে যাই-ই বলুক না কেন, আসল কথাটা কিঞ্চিৎ অন্যরকম। আজ যে ভারতবর্ষের নানা রাজ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শ্রেষ্ঠ উৎসবে অফিস-আদালত প্রভৃতি বন্ধ রাখার ব্যবস্থা হয়েছে, তার শুরুটা কিন্তু এই বঙ্গলোকে।
আজ থেকে ১৮৫ বছর আগেকার একটি খবর। প্রকাশিত হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৭-এর ‍‘সমাচার দর্পণ’-এর পাতায় তাতে লেখা হয়েছিল, ‍‘বর্তমান বৎসরে আগামী পূজোপলক্ষে যে বন্ধ তাহা পূর্ব অনেক ২ বৎসরাপেক্ষা অধিক হইবে। শারদীয়া মহাপূজোপলক্ষে সরকারি কার্যে ৪ অক্টোবর অবধি ১২ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকিবে। কিন্তু ১৪ তারিখে চন্দ্রগ্রহণ আছে। তাহাতেও তাবৎ আপিস বন্ধ হইবে। তৎপ্রযুক্ত একেবারে ১৪ তারিখ পর্যন্ত ছুটির বিস্তারকরণের নিশ্চয় হইয়াছে। অতএব মঙ্গলবার ৩ অক্টোবর অবধি তাবৎ আপিসেই কর্ম বন্ধ হইবে এবং সোমবার ১৬ তারিখের পূর্বাহ্নে কার্য আরম্ভ হইবে।’’
মোদ্দা কথা, ৪ থেকে ১৫, টানা ১২ দিন ছুটি, এবং এই ছুটি দুর্গাপূজা (Durga Puja) উপলক্ষে।
উনিশ শতকে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। তাই এই দীর্ঘ ছুটি আদতে রাজ্যের জন্য নির্দিষ্ট ছুটি ছিল না। তা ছিল একেবারে সর্বভারতীয় ছুটি। কিন্তু দুর্গাপুজো (Durga Puja) তো মূলত বাংলার উৎসব। তাই বাংলার বাইরে অন্যান্য জায়গায় ছুটিতে আনন্দের জোয়ার বইবার কোনও অবকাশ ছিল না। বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের প্রাণবন্ত আবেগ আর বাংলার বাইরে অন্য প্রদেশের লোকজনের আলস্য যাপনের বিড়ম্বনা। ছুটিতে শুধু শুধু ঘরে বসে থাকা। আর কোনও এক কাজ নেই। তাই তারা সরকারের কাছে দরবার করেছিল ছুটি কমানোর জন্য।
১০ অক্টোবর, ১৮৩৫-এ সমাচার দর্পণ পত্রিকায় বের হল একটা খবর।

আরও পড়ুন- মা দুর্গা গেলেন, আসছেন মা জগদ্ধাত্রী

‘‘কিঞ্চিৎকাল হইল গবর্ণমেন্টের তাবৎ দপ্তরখানাতে ছুটির দিনের অল্পতা করিতে পরামর্শ হইয়াছিল। এতদ্দেশীয় লোকেরা স্বপক্ষে অন্যায় বুঝিয়া তাহা অন্যথার্থ অধিক চেষ্টা করিলেন। কিন্তু বঙ্গদেশস্থ লোকেরা যাহা অতি প্রয়োজনীয় বিষয় বুঝিয়া থাকেন তাহা পশ্চিমদেশীয় তাবল্লোক ইঙ্গলণ্ডীয় লোকেদের ন্যায় তুচ্ছ বোধ করেন। অতএব দুর্গোৎসবোপলক্ষে যে ছুটি বঙ্গদেশীয় লোকেরা কোনও প্রকারে উপেক্ষা করিতে ইচ্ছুক নহেন ওই ছুটিতে পশ্চিমদেশীয় লোকেদের অত্যন্ত ক্লেশ হয়ে যেহেতুক তাহাতে সর্বপ্রকার কর্ম নিরর্থক স্থগিত হয়। পশ্চিম দেশে ওই উৎসব সময়ে কোনও ব্যক্তিও স্বীয় দোকান ও ব্যবসায় কার্য বন্ধ করেন না। অতএব যে দেশীয় লোকেরা ওই ছুটির অধিক দিন ইষ্ট বোধ করেন তবে ভালো হয় যেহেতুক মিথ্যা কাল হরণ করণেতে সবর্বদেশে সাধারণ ঐক্যতার নিয়ম স্থাপনেতে ফলোদয় মাত্র নাই।’’
এসবের ফল পরিণামে সরকার দুর্গাপুজার (Durga Puja) ছুটি কমানোর জন্য একটা কমিটি গঠন করল। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৯-তে ওই ‍‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই মর্মে একটা সংবাদ প্রকাশিত হল।
‘‘ইংরাজ বণিক সমাজ দুর্গাপূজার দীর্ঘাবকাশ রহিত জন্য গবর্ণমেন্টের নিকট আবেদন করায় লেপ্টেন্যান্ট গবর্ণর এক কমিটি নিযুক্ত করিয়াছেন।’’ ওই কমিটি পরে ঘোষণা করে, দুর্গাপুজো উপলক্ষে চারদিন সরকারি অফিস ছুটি থাকবে।
সরকার এই মর্মে নির্দেশিকা জারি করার পর ১৪ অক্টোবর ১৮৭৯-তে ‍‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় একটা চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিটা লেখা হয়েছিল অনারেবল লম্বোদর রায় বাহাদুর সিএসআই-কে। অর্থাৎ পার্বতীপুত্র গণেশকে। তাতে লেখা হল—
‘‘যেহেতু আমরা নিতান্ত দুখিত আছি, এ কারণ হুজুরের কাছে আমাদের একটি নিবেদন আছে, ভরসা করি আপনি তাহা শুনিয়া যাহা বিচার করুন। হুজুর মায়ের সাথে বছর বছর এসে থাকেন, সুতরাং আমাদের আপনি ভাল ওয়াকিবহাল আছেন। আমরা আপনাদের শুভাগমন উপলক্ষে ফি বছর বার দিন করিয়া ছুটি পাইয়া আসিতেছি। এবার কোনওরূপ কেঁদে কঁকিয়ে সেই ছুটি মঞ্জুর রহিল, কিন্তু আসছে বছর থেকে তাহা আর পাওয়া যাইবে না। বড়লাট সাহেব হুকুম দিয়াছেন যে আগামী বছর থেকে চার দিনের অধিক আর কেহ ছুটি পাইবে না।’’
দুখের অশ্রুধারায় সিক্ত সেই পত্র। তাতে লেখা হল—
আমরা ছা পোষা লোক, কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ঘর করি, ভূতের মতো খেটে বৎসরান্তে স্ত্রী পুত্র পরিবারের মুখ দেখিতে কি সাধ হয় না? সম্বৎসর পরিশ্রম করিয়া হাড় মাটি করি খেটে খেটে প্রাণ বেরিয়ে যায়, তার উপর আবার উপরি পাওনাও বিলক্ষণ আছে, মধ্যে মধ্যে লাথি ঝাঁটাও খেতে হয় হয় কত রকম মন জুগিয়ে কাজ করি। ইহাতেও গরিবদের উপর এত লাছব না?’’

অন্তিমে আবদার : ‍‘‘লাটসাহেব আপনারই অন্তরঙ্গ লোক, অতএব হুজুরে হাজির হইয়া এই দরখাস্ত দিতেছি আপনি ইহা মায়ের কাছে পেশ করিবেন।’’
এই চিঠি লেখা হয়েছিল ৯ নম্বর প্যাঁচার গলিতে অবস্থিত ভূত নন্দী সভার পক্ষ থেকে। পত্র প্রেরকের নাম হিসেবে যাদের নাম উল্লিখিত হয়েছিল তারা হল ওই সভার অনাহারী (অনারারি নয়) সেক্রেটারি অখারাম হাবা এবং জয়েন্ট মাগারাম জুজু।
৯ অক্টোবর, ১৮৫৮। ‍‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন ছুটির শেষের কথা। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘‘শারদীয় মহোৎসব শেষ হইয়াছে… পূজা পূজা বলিয়া পূর্ব প্রায় মাসদ্বয় ব্যাপিয়া এই রঙ্গভূমি বঙ্গদেশের মহাধূম উঠিয়াছিল, কিন্তু পূজা যেমন এল অমনি গেল, গত দিবস ছুটি থাকাতে যদিও কিঞ্চিৎ পূজার গন্ধ ছিল, অদ্য আফিস সকল খোলা হওয়াতে আর তাহার চিহ্নও নাই, আহা কালের কার্যই এইরূপ ঐন্দ্রজালিক ও স্বপ্নবৎ।’’
প্রায় দেড়শো বছর আগেকার কথা। কিন্তু আজকের দিনের সঙ্গে বোধ হয় খুব একটা পার্থক্য নেই। এটা নজরে এলেই বিস্ময়ে আবিষ্ট হতে হয়। কালান্তরেও অভিন্ন বোধের বহমানতা।

Latest article