দুর্নীতিবাজ বিজেপি-র বুঝি সাতখুন মাফ

ইডি-সিবিআই বুঝি কেবল ইন্ডিয়া জোটের জন্য? আর কতদিন এই শয়তানি? লিখছেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য মুখপাত্র ড. প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

Must read

‘কে তোমায় বলে ডাকাতবন্ধু, কে তোমায় চোর বলে?’ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই লাইন আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক। কারণ— ঘটনা ১, ১৪ মার্চ, ২০১৬, বিজেপির রাজ্য প্রধান অফিস ৬ নম্বর মুরলীধর লেন থেকে একটি ভিডিওতে দেখানো হল শুভেন্দু অধিকারী কাগজে মুড়ে টাকা নিচ্ছে। বিজেপি তাকে চোর বলল। তারপর ২০২০ সাল অবধি প্রায় সব জনসভায়, গণমাধ্যমে শুভেন্দুকে চোর বলে তার বিরুদ্ধে সিবিআই নিয়ে হইহুল্লোড় চালালেন মোদি-শাহ সহ বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারা। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সেই চোর-অভিধাভুক্ত শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগেই উক্ত ঘুষ নেওয়ার ভিডিও বিজেপির সামাজিক মাধ্যম থেকে উবে গেল! এখন সে মেদিনীপুর ছেড়ে রাজ্যের নেতা— বিরোধী দলনেতা (পড়ুন চোর বা ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজ নয়)!

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি, স্ত্রীকে গণধর্ষণ

ঘটনা ২, ৭২০০০ কোটি ও ২৫০০০ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প ও মহারাষ্ট্র রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অজিত পাওয়ার ২০১৯ ও ২৩ সালে যখন বিজেপির সঙ্গে জোট করে তখন তার বিরুদ্ধে ওঠা উক্ত দুই দুর্নীতির অভিযোগ-সহ মোট ন’টি বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ হিমঘরে চলে যায়। উল্লেখ্য, ২০১৯-এ যখন তিনি বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হন তখন মহারাষ্ট্রের অ্যান্টি করাপশন ব্যুরো ওই ন’টি কেসের তদন্তই বন্ধ করে দেয় এবং বলে সেক্ষেত্রে কোনও অনিয়ম পাওয়া যায়নি, শুধুমাত্র রুটিন তদন্ত হয়েছে। আবার সেই যখন বিজেপি ছেড়ে মহাজোটের দায়িত্ব নেয় তখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শুরু করে। সেই পাওয়ারই পুনরায় বিজেপি-শিবসেনা সরকারের যোগ দিলে আবার সকল দুর্নীতির অভিযোগ আড়াল করা হয়। অজিত পাওয়ার নিয়ে বিজেপির এখন আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কিন্তু ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ বলা মোদিজি ২০২৩ সালের জুন মাসে ভোপালের এক জনসভায় অজিত পাওয়ারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে বলেছিলেন পাওয়ার খুব শিগগিরই জেলে যাবেন। তিনি জেলে না গিয়ে বিজেপিতে হাত মিলিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।

আরও পড়ুন-অসময়ে বৃষ্টির জেরে ধান-সব্জি চাষে ক্ষতি, দেওয়া হল একগুচ্ছ পরামর্শ

ঘটনা ৩, হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে ওঠা সারদা মামলা বা লুই বার্জার-সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ ও তদন্ত ঠান্ডা ঘরে রয়েছে। কারণ তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। যে অমিত শাহ জোর গলায় বলেছিলেন শর্মাজি জেল খাটবেন। সেই অমিত শাহকেই যখন বিজেপির হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দুর্নীতি ও তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তিনি সাংবাদিককে উল্টে প্রশ্ন করেন এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তিনি উত্তর দেবেন না! ঘটনার উল্লেখ করলে একইভাবে কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার জমি কেলেঙ্কারি, মধ্যপ্রদেশের মামা তথা মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের ব্যাপম বা খাদ্য কেলেঙ্কারি, রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক-এর জমি ও হাইড্রো ইলেকট্রিক দুর্নীতি, নারায়ণ রানের জমি ও ৩০০ কোটির দুর্নীতি, প্রফুল প্যাটেলের এরোপ্লেন দুর্নীতি, কর্নাটকে রেড্ডি ভাইয়ের ১৬ হাজার ৫০০ কোটির খনি দুর্নীতি, প্রেমা খান্ডুর বিরুদ্ধে খুনের তদন্তের কথা স্মরণ করা যায়।

আরও পড়ুন-যাত্রাদলের বাসে লরির ধাক্কা, আশঙ্কাজনক অবস্থা ১০ জনের

আসলে বিজেপি এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করেছে যাতে তাদের নেতা, তাদের সহযোগী বা অন্য দল থেকে তাদের দলে আসা নেতাদের বিরুদ্ধে চলা ইডি, সিবিআই বা আয়কর তদন্তের কোনও অগ্রগতি হবে না। কারণ মোদি হ্যায় তো মুনকিন হ্যায়। মোদি সরকার নিজের দলের ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়ে চোখ বেঁধে রেখেছে। তাই কোনও দুর্নীতিবাজ তার দলে থাকলেও তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রচার করা হবে। তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ২০১৪-’২২ সময়ে ১২৪টি কেসের (সিবিআই) মধ্যে ১১৮টি অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ কেস বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চলছে, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সময় ছিল ৬০% অর্থাৎ ৭২টির মধ্যে ৪৩টি ছিল বিরোধীদের বিরুদ্ধে। সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী গত ৩১ জুলাই জানান ২০২০-’২১, ২০২১-’২২ ও ২০২২-’২৩ সালে ইডি আর্থিক বিষয়ে ৩১১০টি এবং বিদেশি মুদ্রার দুর্নীতির বিষয়ে ফেমার (FEMA) অধীনে ১২ হাজার কেস নথিভুক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ থেকে ২২ সাল অবধি প্রায় ২২ হাজার ৩০০টি বিষয়ে আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তার মধ্যে ৯৯৬টি সার্চ, ৫৩৯৯টি শোকজ ও ৩০১০টি রেড করেছে। উল্লেখ্য ২০০৫ সাল থেকে ২০২২ অব্দি ইডি ৫৯০৬টি কেস নিবন্ধীকরণ করেছে তার মধ্যে মাত্র ১১৪২টি কেসে চার্জশিট দাখিল করতে পেরেছে এবং মাত্র ২৫টি তদন্ত সম্পন্ন করতে পেরেছে অর্থাৎ ইডির সাফল্যের হার ০.৪২ শতাংশ। কিন্তু তারা সদর্পে বলে যে ২৫টি তদন্ত তারা শেষ করেছে তার মধ্যে ২৪টি ক্ষেত্রেই তারা সফল অর্থাৎ তাদের সাফল্যের হার ৯৬%! এটাই মোদির নতুন ভারত, যেখানে তথ্যের ভোজবাজি সরকারের সাফল্যের শেষ অস্ত্র।

আরও পড়ুন-টানা ৯৬ ঘণ্টা টানেলে আটকে ৪০ শ্রমিক, বাড়ছে উদ্বেগ

বস্তুত ইন্ডিয়া সন্ধি গড়ে ওঠার পর মোদি সরকারের এজেন্সিরাজ আরও জোরালোভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে। ইডি-সিবিআই-আয়কর দপ্তর তেড়েফুঁড়ে মাঠে নেমে পড়েছে। ইন্ডিয়া জোটের প্রথম বৈঠকের দিনেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার নানান কর্মসূচির মাঝেই তাঁকে বারবার সমন পাঠানো হয়, নানান মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করার চেষ্টা। একইভাবে এই মাসের শুরুতেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ইডি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়। এর আগে এপ্রিলে সিবিআই একই কাজ করে। আপ দলের সিসোদিয়া এখনও জেলে, কিন্তু কোনও চার্জশিট নেই। আপেরই সঞ্জয় সিং ও সত্যেন্দ্র জৈন ইডি-সিবিআই দ্বারা হয়রানির শিকার।

আরও পড়ুন-কলকাতায় নামবে বৃষ্টি! ইডেনে ভেস্তে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ?

মোদি সরকার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, শিবসেনার সঞ্জয় রাউত, কাশ্মীরের ফারুক আব্দুল্লাহ, মুম্বইয়ের অনিল দেশমুখ প্রমুখ বিরোধী নেতাদের কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে হেনস্থা করে ইন্ডিয়া জোটকে দুর্বল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তার পরিষ্কার বার্তা— হয় জোট ভাঙো নয় (বিনা বিচারে) জেলে যাও। একইভাবে রাহুল গান্ধীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ, সোনিয়া গান্ধীকে সমন পাঠানো, পি চিদম্বরমকে জেল খাটানো, ভূপেশ বাঘেলকে হেনস্থা করা সমান্তরালভাবে চলছে। আসলে ইডি-সিবিআই-এর প্রধানগণ মোদি সাহেবের মোসাহেবি করে তাঁর বিশেষ আশীর্বাদ নিয়ে দুর্নীতি রোধ ও নিরপেক্ষ তদন্তের বদলে বিরোধী দলগুলিকে ক্রমান্বয়ে হেনস্থা ও ভয় দেখিয়ে চলেছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট এই নভেম্বর মাসেই বলতে বাধ্য হয়েছে এজেন্সি দিয়ে দেশ চলে না। তদন্ত করার ক্ষেত্রে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে কিনা সে-নিয়েও দেশের প্রধান আদালত বারবার প্রশ্ন করেছে। এজেন্সি দিয়ে যে কোনও প্রকারে ইন্ডিয়া জোটকে দুর্বল করার চেষ্টা হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস বুকচিতিয়ে রাজনীতির যে প্রমাণ রাখছে তা ইন্ডিয়া জোটের কাছে এক বিশেষ উদাহরণ। বারবার ইডি-সিবিআই-এর তদন্তের সম্মুখীন হয়ে বেরিয়ে এসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ পয়সার দুর্নীতি প্রমাণ হলে তিনি জনসমক্ষে ফাঁসি নেবেন। স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয় বক্তব্য ও ক্রমান্বয়ে ইডি-সিবিআইকে কোর্টের ভর্ৎসনা ইন্ডিয়া জোটকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ২০১৪ সালে মিথ্যাবাদী মোদি সরকারের পতন হবে। তাই কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়েই শেষ করি—

আরও পড়ুন-সাংসদদের ওয়েবসাইটে লগ ইন করতে পারবেন না আপ্তসহায়ক-সহ অন্য কেউই

‘…অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু/দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধংসের পিছু পিছু। … মানুষ দেখলে বাল্মীকি হও তোমরা রত্নাকর!’ (পড়ুন মোদি সরকার)।

Latest article