অন্তর থেকে বিদ্বেষ-বিষ নাশো

আজ শুভ শুক্রবার। খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন। আজ ভোরবেলা, অশুভের রাত্রিশেষে যেন সৌভ্রাতৃত্বের ফেরেস্তা এসে যদি দেয় আনন্দের ফরমান, বিদ্বেষের অবসানের বার্তা, তবেই রক্ষিত হবে ভারতাত্মা। সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ও কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী

Must read

আজ ৭ এপ্রিল ২০২৩, গুডফ্রাইডের (Good Friday) ছুটিতে সকালে ঘুম থেকে উঠে নিশ্চিন্তে চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজের পাতা উল্টানো যাচ্ছে, রিমোট টিপে টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিব্যি দেখা যাচ্ছে রাজ্য-সহ সারা দেশের খবর, কারণ আমি জানি আজ সারাদিনে অন্তত এমন কোনও ঘটনা ঘটবে না, যেখানে একদল মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের দিকে হিংস্র জান্তব জিঘাংসা নিয়ে তেড়ে আক্রমণ শানাতে যাবে এই দৃশ্যে আমাদের চোখ শিউরে উঠবে না। একই জিনিস তো দুর্গাপুজো, কালীপুজো, মকরসংক্রান্তি, ইদ, রথযাত্রা, শবেবরাত, ইস্টার, সরস্বতীপুজো কিংবা বড়দিনে— সেখানেও কেউ কাউকে তেড়ে আক্রমণ শানাতে যায় না। উল্টে দুর্গাপুজোর আগে একসঙ্গে রাজীব আর হামিদুল বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা কাটে, ঠাকুর আনতে যায়, আবার ইদের দিন ফরিদার বাড়ির শিমাই আর লাচ্ছা না খেলে ভাত হজম হয় না বন্ধু মানসী কিংবা আরতির। এটাই তো ছিল আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর ‘জন-গণ-মন’র দ্বিতীয় স্তবকে তাই লিখে যান—
‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রীষ্টানী।’

কিন্তু সেই ভারতের শেকড়ে আজ এত ঘুণ ধরে গেল কেন যাতে হনুমান জয়ন্তীর দিন আতঙ্কে থাকতে হয় একটা বিশেষ ধর্মের মানুষদের, কেন মসজিদগুলোকে বারবার আক্রান্ত হতে হয় রামনবমীর মিছিলে? বেলুড়মঠ তৈরির পরে স্বামী বিবেকানন্দ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘তোরা হনুমানের মতো হ। দরকারে তাঁর নাম করে সাগর ডিঙিয়ে যা।’ হনুমান বীর, সূর্যকে খপ করে পাকা ফলের মতো পেড়ে আনতে পারে, কুস্তিগির ও চিরকুমার যোগী। সেই হনুমানের সৌম্যসুন্দর মূর্তি বীরের প্রতীক, ধর্ম ও ন্যায়স্থাপনার প্রতীক যাঁর হৃদয়ে থাকেন ভগবান রাম ও জননী সীতা। অথচ আজ সৌম্যদর্শন সুঠামদেহী বুকে রাম-সীতাধারী পবনপুত্রের বদলে রাগী হিংস্র মুখওয়ালা গো-বলয়ের হনুমানমূর্তি পূজিত হচ্ছে দেশব্যাপী যা আমাদের সনাতনী বিশ্বাসের পরিপন্থী। আর শুধু মূর্তির আঙ্গিকেই নয়, আসলে ধীরে ধীরে তো ভারতের ইতিহাসটাকেই বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সুকৌশলে, যে ইতিহাস বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের পছন্দর ভিত্তিতে রচিত হবে। তাই পাঠ্যবই থেকে ৩০০ বছরের মুঘল সাম্রাজ্য বাদ চলে যায়, মহাত্মা গান্ধীর খুনি আরএসএসকে যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেই ইতিহাসটা প্যাটেলের মূর্তির উন্মোচনকারীরাই সরিয়ে দেন। তারপর ধরুন বাবরি মসজিদ, কিন্তু আমরা এখন জানলাম, না ওটি কোনও মসজিদই নয় আসলে রামমন্দির। তারপর জানলাম ওখানেই শেষ না, এখনও কাশী-মথুরা বাকি। এরপর আবার জানলাম জ্ঞানবাপি মসজিদ নয়, শিবমন্দির। এখন জানছি, তাজমহল আসলে তাজমহলই নয়, সে তেজো মহালয়া। এই দিন আসতে পারে অনুমান করেই সুকুমার রায় হযবরল-তে লিখে গিয়েছিলেন, ‘সকালে আমার নাম থাকে আলুনারকোল আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু, আবার রাতে বিস্কুট,’ অনেকটা সেই রকমই ব্যাপারখানা হতে চলেছে জাতীয় শিক্ষানীতির হাত ধরে আগামীদিনে, আজকের এই ইতিহাসবদল সেই মূল সিনেমারই ট্রেলার মাত্র।
রামনবমীর মিছিল হবে রামনবমীর ৫ দিন পরেও এবং সেই মিছিলকে মসজিদের সামনে গিয়েই যদি অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করতে হয়, তাহলে মসজিদগুলো ভাঙার দরকারটাই বা কী? বড়দিনে চার্চে প্রভু যিশুর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা কি ২৫ ডিসেম্বরের বদলে ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হয়? যে রিষড়ায় রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে এত অশান্তি সেই রিষড়া-শেওড়াফুলি দিয়েই তো প্রতিবছর লাখো-লাখো হিন্দু পুণ্যার্থী তারকেশ্বরে বাবার থানে জল ঢালতে যান, কই সেখানে তো এ-জাতীয় কোনও অসভ্যতামো হয় না একটিও। আর তাই রামনবমীর মিছিল কেন পুলিশের নির্দিষ্ট করে দেওয়া রুটে রামনবমীর দিনেই হবে না— এর উত্তরটাও খুব সহজ। এটি আদতে একটি রাজনৈতিক দলের আস্ফালন প্রদর্শনের মঞ্চ মাত্র, এর সঙ্গে আদৌ ধর্মের কোনও যোগই নেই। ভগবান শ্রীরাম প্রজাপালক, দুষ্টের দমনকারী, শিষ্টের সহায়ক। যারা রামনবমীর নামে ডিজে বাজিয়ে, বোমা, বন্দুক, অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে অন্য ধর্মের মানুষের উপরে চড়াও হয় তারা ভগবান শ্রীরামকেও মানে না, সনাতনী হিন্দু ধর্মকেও মানে না। এরা রামজাদা নয়, স্রেফ হারামজাদা। তারা বাংলার হোক বা বিহার, তেলেঙ্গানার হোক বা গুজরাতের, এই দাঙ্গাবাজদের চেহারা সব জায়গায়ই এক। আমাদের দুর্ভাগ্য যে জাতির জনক দেশকে মানবিকতার ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ শিখিয়েছিলেন, আর তার হত্যাকারীরা আজও দেশবাসীকে ধ্বংসের শিক্ষা দিয়ে চলেছে। প্রভু যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েও ক্ষমার কথা প্রচার করেছিলেন, শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষার সনাতন ধর্ম আমাদের প্রেমের কথা শেখায়, ক্ষমার কথা বলে। স্বয়ং ঠাকুরের শিক্ষা আমাদের অহঙ্কার, আমরাই পৃথিবীকে যত মত তত পথের শিক্ষা দিয়েছি। দু’দিনের দাঙ্গাবাজরা এসে সনাতন ধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদারি নিয়ে এই হাজার বছরের ইতিহাসকে কলুষিত করতে পারবে না।

আর ‘বাঙালি দাঙ্গা চায় না’ গোছের এই গোল গোল বোকা কথা তো অনেক দিন হল। মারাঠি, পাঞ্জাবি, বিহারি, তামিল, তেলুগু, উত্তরপ্রদেশি কারা দাঙ্গা চায়? কেউ দাঙ্গা চায় না, কোনও সুস্থ বুদ্ধির মানুষ হিংসা চায় না। রামরাজাতলা থেকে রিষড়া, তেলেঙ্গানা থেকে বিহারের সাসারাম, কোনও জায়গার সাধারণ মানুষই দাঙ্গা চায় না। দাঙ্গা আসলে তারাই চায়, যারা দাঙ্গা থেকে সরাসরি রাজনৈতিক লাভ কুড়োতে পারে। আর বিগত চার দশকের ভারতের ইতিহাস সাক্ষী, দাঙ্গা হলে একটাই রাজনৈতিক দলের লাভ হয়, তার নাম বিজেপি। তাই ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিশ করুন।

Latest article