মানবিক মানুষ বনাম অমানবিক সরকার

বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনার অভিঘাত। যুগপৎ ধরা পড়ল দুটো বিপ্রতীপ চিত্র। সহমর্মী মানুষের আন্তরিকতা আর দানবিক মোদি সরকারের উদাসীনতা। স্পষ্ট হল এই গেরুয়া সরকারের জনবিরোধী স্বরূপ। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

‘‘জলতলে জাল ফেলে নরমুণ্ড উঠে আসে কটি।
‘ও কিছুই নয়’ বলে
হিতব্রতী
আমরা ফিরিয়ে নিই মুখ।
উৎসব আসরে বসে মনে মনে বলি :
‘আপাতত
যে ভাবে চলছে, চলুক।’ ’’
—শঙ্খ ঘোষ
‘দর্শন’, ‘হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ’
আপাতত কীভাবে চলছে, তা ভালমতো বুঝিয়ে, চিনিয়ে, দেখিয়ে দিয়ে গেল বাহানাগা। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের (Coromandel Express) দুর্ঘটনার পর। কয়েকটি চিত্রের কোলাজে স্পষ্ট প্রকৃত চিত্র।
চিত্র নং ১, বাহানাগার দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা যাত্রীদের দেহ নিয়ে আসা হচ্ছিল বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে। প্রথমে সেখানে আনার পর অবস্থা বুঝে আহতদের পাঠানো হচ্ছিল কাটাপাড়া, সোরো কিংবা কটকের হাসপাতালগুলোতে। জখমদের তখন দরকার রক্ত। ওষুধের চেয়েও বেশি। অনর্গল রক্তক্ষরণে শরীরগুলো ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। খবর পৌঁছে গেল বালেশ্বর জেলায় যাঁরা নিয়মিত রক্তদান করেন, তাঁদের কাছে। একটি অসরকারি সংগঠন সেই কাজটি করল। তারপর দেখা গেল রক্তদাতাদের লাইন বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে। ছেঁড়া জামা পরা মানুষও সেই লাইনে দাঁড়িয়ে রক্ত দিলেন রেল দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহতদের। সারা রাত চলল রক্তদান। পরদিনও লাইনে ভিড়।
চিত্র নং ২, গোদি মিডিয়া আর গেরুয়া পার্টির আইটি সেলের প্রচার অভিযান। কখনও প্রচার করা হল, বাহানাগার আগের স্টেশন পনপনের স্টেশন মাস্টার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁর চেষ্টাতে নাকি সম্পন্ন হয়েছে পয়েন্ট বদলানোর অপকর্ম। বাহানাগার লেভেল ক্রসিংয়ের পাশেই মসজিদ। প্রচার করা হল, সেখানে বসেই নাকি চলেছে সব চক্রান্ত।
পরে জানা গেল দুটো কথা। এক, বাহানাগার লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে কোনও মসজিদ নেই। যেটা আছে সেটা নাকি ইসকনের মন্দির।
দুই, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার এ কে মোহান্তি লিখিত রিপোর্টে জানিয়েছেন ডেটা লগার যন্ত্রে সিগন্যাল পরিবর্তনের যে তথ্য মিলেছে তাতে কোনও পয়েন্টের গোলমাল নজরে আসেনি। বরং, তাঁর দাবি, করমণ্ডল এক্সপ্রেস সেদিন নির্দিষ্ট পয়েন্টের খানিকটা আগেই লাইনচ্যুত হয়েছিল।
আর, পনপনের স্টেশন মাস্টারও মুসলমান নয়।

চিত্র নং ৩, মানুষ তখন মানুষের পাশে। আর্তজনের সেবায় সাধারণ জনতা। যে যেভাবে পারছেন সেভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালনে ব্যস্ত। ঠাণ্ডা জল থেকে গ্লুকোজ মেশানো জল, এমনকী হালকা খাবারও তাঁরা পৌঁছে দিচ্ছেন হাসপাতালে এবং গরমে উদ্ধার-কাজে ব্যস্ত রেলকর্মীদের মধ্যে। ঘর থেকে থালা হাতে বেরিয়ে আসছেন মহিলারা। হাতে-হাতে থালা, তাতে ভাত আর ডালনা।
চিত্র নং ৪, স্থানীয় মানুষ যখন মানবিকতার ডাকে সাড়া দিতে ব্যস্ত, তখন মোদির রেল ব্যস্ত নিহতদের সংখ্যা কম করে দেখানোর অপচেষ্টায়। ঘটনাস্থলে তখন অশ্বিনী বৈষ্ণব। মোদি ক্যাবিনেটের রেলমন্ত্রী। বালেশ্বরের প্রাক্তন কালেক্টরেট। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের নিউজ ভিডিও হোয়্যাটসঅ্যাপে কখনও দেখানো হয়নি স্থানীয় সাধারণ মানুষের ত্রাণের কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ছবি। সেখানে পরিবেশিত হয়েছে বাহানাগায় কী ট্রেন চলল তার খবরাখবর আর অশ্বিনী বৈষ্ণবের নানাবিধ নাটকীয় ভিডিও। কখনও দেখা গেল ভাঙাচোরা করমণ্ডলের বগির নিচে ঢুকে দেখছেন তিনি। কখনও দেখা গেল লাইন সারিয়ে মালগাড়ি চালানোর সময় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ যোগে তাঁর প্রণাম করার দৃশ্য। পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ তদন্তের আগেই অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়ে দিলেন, ওই দুর্ঘটনার (Coromandel Express Accident) পেছনে কোনও অপরাধীর হাত রয়েছে। তদন্তের আগেই তদন্তের কল বেরিয়ে গেল!

আসলে তখন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ইঞ্জিনিয়ররা ঘেমেনেয়ে একসা। শনিবার সকাল থেকে তাঁরা পোস্ট আর পয়েন্টের ছবি এঁকে চলেছেন। কিন্তু কম্পিউটার চালিত লাইনের পয়েন্ট রেঞ্জ বদলাল কে, তা ঠাহর করে উঠতে পারছেন না তাঁরা। এটা তো বাইরে থেকে করা সম্ভব নয়। করমণ্ডল এক্সপ্রেস আসছিল ১০০ কিমির বেশি গতিতে। চালক সিগন্যাল দেখেই ট্রেন চালাচ্ছিলেন। পয়েন্ট কোন দিকে রয়েছে সেটা সবসময় দেখা সম্ভব হয় না চালকের পক্ষে। নিজেদের ব্যবস্থার দিকে গাফিলতির আঙুল উঠছে, সেটা কীভাবে সামলাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না রেলের কর্তারা।
ঠিক এই সময় তাঁদের বাঁচিয়ে দিল ঘটনাস্থলে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাব।
তিনি কি আর যে সে ব্যক্তি? ছোটদের জন্য দেশের লোককথা, উপকথা, রূপকথা, মহাকাব্য নিয়ে যারা কমিক স্ট্রিপ বানায়, সেই অমর চিত্রকথা তাঁর ওপর কমিক স্ট্রিপ বানিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্কুলগুলোতে পড়ুয়াদের কাছে তা পৌঁছে দিতে বিশেষভাবে উদ্যোগী এনসিইআরটি। অমর চিত্রকথার ওই কমিক স্ট্রিপে দেখা গিয়েছে পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে শিক্ষক বলছেন, এবার থেকে সপ্তাহে অন্তত একটা পিরিয়ডে মোদিজির ‘মন কি বাত’ নিয়ে আলোচনা হবে।
এহেন প্রবল দাপুটে প্রধানমন্ত্রী এলেন ও গেলেন। তার পরেই গোটা ঘটনার তদন্তের মোড় ঘুরে গেল।
এতক্ষণ কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, কেন্দ্রীয় ফরেনসিক দলকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। আর প্রধানমন্ত্রীর প্রস্থানের পর থেকে রেলের আধিকারিক থেকে ওড়িশা প্রশাসনের কর্তা, সবার মুখে কুলুপ। কিছু জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর, ‘বলতে পারছি না!’
কেন্দ্রীয় বাহিনীর নির্দেশে রাত ন’টার পর স্থানীয় মানুষদের ঘর থেকে বের হওয়া এমনকী রাত দশটার পর বাইরের আলো জ্বালানো বন্ধ করে দেওয়া হল। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে মৃতের সংখ্যা ২৮৮ থেকে কমে হল ২৭৫। অনেককেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁদের পরিবারের লোকজন। নিখোঁজ অগুনতি। তবু, কোনও এক অদৃশ্য চোখরাঙানিতে মৃতের সংখ্যা অপরিবর্তিত (Coromandel Express Accident)।
ভারতবর্ষ এর আগে এত অমানবিক, এত দানবিক প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকারকে দেখেনি।
তবে এসব বলে বা লিখে কোনও লাভ নেই।
‘‘কানকাটাদের রাজ্যে
ঠোঁটকাটারা যাই বলুক না কেন
আনে না কেউ গ্রাহ্যে।”
তাই, ইভিএম-এর বোতামেই এদের মোক্ষম জবাব দিতে হবে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন ও তৎপরবর্তী লোকসভার ভোটে।

আরও পড়ুন- অঙ্গ হারানো শ্রমিকরা কীভাবে রোজগার করবেন, উঠছে প্রশ্ন

Latest article