ভাস্কর ভট্টাচার্য: ভাগ্যিস ধার্মিক ও পবিত্র মানুষের বাতলে দেওয়া লক্ষণ কোনও যুগেই বিজ্ঞানীরা কানে তোলেন না, তা হলে গ্যালিলিও দূরবিনে আকাশ দেখে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘোরাঘুরিকে জানতে পারতেন না, ডারউইনের বিবর্তনসূত্র আমরা জানতে পারতাম না, জানতে পারতাম না প্যারাসেলসাস চিকিৎসকদের ভণ্ডামি আবিষ্কার করে বিদ্রোহ ঘোষণার কথা। তেমনভাবেই আমরা পেয়েছি বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী পল এরলিখকে।
আরও পড়ুন-এভাবে কি ভুলিয়ে দেওয়া যায়?
বর্তমান করোনা কালে এখন আমরা কথায় কথায় ‘ইমিউন’ শব্দটির কথা শুনছি। শুনছি ইমিউন বডি বা ‘অ্যান্টিবডি’ নামক শব্দের উচ্চারণ। যে ইমিউন বডি বা জৈব রাসায়নিক মারণাস্ত্র, এই মারণাস্ত্রের ফলেই শরীরে প্রবেশ-করা জীবাণুর বিনাশ ঘটায়। তৈরি হয় অ্যান্টিবডি। আর এই প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরিতে যিনি বিজ্ঞানের জগতে আলোকপাত করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ইমিউনোলজিতে অবদানের জন্য ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি এক ইহুদি-বিজ্ঞানী পল এরলিখ। তাঁর নামে জার্মানিতে আজও অবস্থান করছে পল এরলিখ ইনস্টিটিউট। অথচ ইহুদি-বিদ্বেষের কারণে হিটলারের বাহিনি এই বিজ্ঞানীর সমাধি ফলক উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য এই বিজ্ঞানীকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে হিটলারের দেশ। সে ভিন্ন কথা।
আরও পড়ুন-নিখরচায় প্লাস্টিক সার্জারি
১৯০৮ সালে নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কার ঘিরে সেদিন গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা উল্লাসে আমোদিত হয়েছিলেন। ডিপথেরিয়া বা যক্ষ্মা নিরাময়ের আবিষ্কারের জন্য সারা বিজ্ঞান জগৎ আজ এত বছর পরও তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু তা-ই নয়, তাঁর আরও যুগান্তকারী আবিষ্কার মারণব্যাধি সিফিলিসের নিরাময় খুঁজে বের করার কৌশল আবিষ্কারও রয়েছে তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে। তাঁর নামানুসারেই একটি ব্যাকটিরিয়ার নামকরণ করা হয়েছে।
ইমিউনোলজি, হেমাটোলজি প্রসঙ্গে এই বিজ্ঞানীর কথা সমসময়ে মনে পড়ছে ভাইরাসের কারণে আক্রান্ত মানুষের ইমিউন বাড়ানোর কথায়। ইমিউনোলজির বাংলা করলে দাঁড়ায় শরীর প্রতিরক্ষাবিদ্যা। শরীরের রোগ প্রতিরোধের এই বিদ্যাই জীবনদায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারের পথ উন্মোচন করেছে। তার অগ্রসূরি ছিলেন পল এরলিখ।
আরও পড়ুন-সমস্যার সমাধানে দুয়ারে তৃণমূল কর্মীরা
‘ইমিউন বডি’ বা জৈব রাসায়নিক মারণাস্ত্র, এই মারণাস্ত্রের প্রচণ্ড আঘাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শরীরে প্রবেশ করা জীবাণু। শরীর মুক্তি পায় রোগ থেকে। এরলিখ তাঁর এই নবাবিষ্কৃত তত্ত্বের নাম রেখেছিলেন সাইফ চেইন থিয়োরি। এই আবিষ্কারই চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি আধুনিক শাখা ‘ইমিউনোলজিকে’ গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এবং চিকিৎসকরা ‘অ্যালার্জির’ ওপর গবেষণায় যথেষ্ট প্রেরণা পেয়েছেন।
এই পথ কিন্তু সুগম ছিল না। কঠিন কঠোর অধ্যবসায় ছিল পল এরলিখের। বিজ্ঞানের পাঠ শেষ করে ব্রেসলু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্ষুদ্র ঘরে দিনরাত এক করে গবেষণা চালিয়ে গেছেন। বড় শক্ত সেই পরীক্ষা। কোন কোন রাসায়নিক কোন কোন ভয়ঙ্কর রোগের জীবাণুর মারণ শিক্ষা দিতে পারে? প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে, শরীরের সজীব কোষ কলায় কোনও ক্ষতি করবে না তো? ক্ষতি করবে না এমন প্রতিরোধী রাসায়নিক চাই। এই কঠিন পরীক্ষায় প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেছেন এই বিজ্ঞানী। তারই মাঝে নিজেই আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মায়। দেড় বছর পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আবার নিজেকে নিয়োজিত করলেন তাঁর একান্ত সাধনায়। আবার শুরু হল নানা রোগের জীবাণু ধ্বংস করার বিজ্ঞান-যুদ্ধ। এরলিখের সেই হিস্টোলজি বা কোষকলার পরখ বা কোষবিদ্যার লড়াই সারা বিশ্বে সাড়া ফেলল। তিনি ডাক পেলেন কখ ইনস্টিটিউটে গবেষণা করার। সে-সময়ে ওই ইনস্টিটিউটে চলছে নানা গবেষণা। এলরিখ নিজের গবেষণার গভীরে ডুবে গেলেন।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ডহারবারে করোনার পজিটিভিটি হার কমছেই
অতন্দ্র গবেষণা একদিন সার্থক হল। যক্ষ্মা রোগীর থুতু বিশেষ অ্যাসিডে স্টেইনিং করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ধরলেই জানা যাবে রোগটি যক্ষ্মা কি না। এইভাবেই চিকিৎসকেরা এরলিখের কাছেই প্রথম জানতে পারলেন কী করে যক্ষ্মাকে ডায়াগোনেস্ট করা যায়।
এইভাবে একের পর এক মৌলিক গবেষণার সাফল্যে ছড়িয়ে পড়ল এই বিজ্ঞানীর নাম। বার্লিন ইনস্টিটিউট ফর সিরাম ইনভেস্টিগেশন এই বিজ্ঞানীকে আহ্বান করল। দায়িত্ব পেলেন এরলিখ। এই জার্মানিতেই শুরু হয়েছিল গবেষক জীবনের চূড়ান্ত পর্বটি। কাজটি হল ইমিউনাইজেশন। অর্থাৎ এ সেই পদ্ধতি যাকে আশ্রয় করে শরীর বহিরাগত জীবাণুর আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি প্রোটিন জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং শরীরকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তাকে বলে রোগ প্রতিরোধী শক্তি।
আরও পড়ুন-বাঘ খুঁজতে ৮২টি দলের ৪০০ প্রশিক্ষিত বনকর্মী ৬ দিন তল্লাশি চালাবে বক্সায়
এই গবেষণার দিগন্ত বিস্তৃত সম্মান এনে দেয় পল এরলিখের জীবনে। তাঁর সিদ্ধিলাভের আরেক নিদর্শন যৌন রোগ সিফিলিসের প্রতিষেধক নির্মাণ। তখন তার বাজার চলতি নাম ছিল ‘সালভারসন’। প্রথমে ব্যর্থ হলেও অবশেষে সফল হয়েছিলেন। আবিষ্কার করলেন সেই রাসায়নিক যা সিফিলিসের জীবাণুকে ধ্বংস করে অথচ মানব শরীরের কোষকলায় কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায় না। তার বৈজ্ঞানিক নাম— ডাই অ্যামিনো ডাই হাইড্রক্সি আর্সেনো বেঞ্জিন। যার বাণিজ্যিক নাম ‘সালভারসন’। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। নানান প্রান্ত থেকে আসতে থাকে বক্তৃতা দেবার আহ্বান। ততদিনে বিজ্ঞানে নোবেল পেয়ে গেছেন তিনি।
পরবর্তীতে বিজ্ঞানের, রসায়নের গবেষণার অগ্রগতিতে এসেছে পেনিসিলিন। নরকযন্ত্রণা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। বিজ্ঞানের সে সব ইতিহাস অনেক দূর বিস্তৃত। বিজ্ঞান গবেষণা এবং বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেন না। বিজ্ঞানের পথচলার শেষ নেই। দিন দিন আধুনিক বিশ্বে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে রোগ ব্যাধিকে প্রতিহত করে মানুষের জীবনকে নতুন আলো দিতে। সেই তালিকায় অবশ্যই উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন এই ইহুদি বিজ্ঞানীর নাম।
জন্ম হয়েছিল ১৪ মার্চ ১৮৫৪ সালে লোয়ার সাইলেসিয়ার প্রুশিয়ান প্রদেশে স্ট্রেহেলেমে। যা এখন দক্ষিণ-পশ্চিম পোল্যান্ড। তিনি ব্রেসলিউ, ফ্রেইবার্গ ইম ব্রেসলাউ, লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল অধ্যয়ন করেছিলেন।
আরও পড়ুন-পিঠেপুলির পসরা নিয়ে দুয়ারে হাজির গাড়ি
আজকের এই মারণব্যাধি করোনায় বারবার উচ্চারিত হচ্ছে মানব শরীরের রক্ষাকর্তায় ইমিউনিটি শক্তি বাড়াবার কথা। যে কথা এই বিজ্ঞানী অনেক বছর দেখিয়ে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, অসংখ্য বিজ্ঞানী গবেষণায় রত আজও। অ্যান্টিবডি, ইমিউন শব্দগুলি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঢুকে পড়েছে আজ।
আজকের এই মারণব্যাধি করোনায় বারবার উচ্চারিত হচ্ছে মানব শরীরের রক্ষাকর্তায় ইমিউনিটি শক্তি বাড়াবার কথা। যে কথা এই বিজ্ঞানী অনেক বছর দেখিয়ে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, অসংখ্য বিজ্ঞানী গবেষণায় রত আজও। অ্যান্টিবডি, ইমিউন শব্দগুলি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঢুকে পড়েছে আজ।