মানুষ বাইরের দূষণ নিয়ে মাতামাতি করে যে, রাস্তায় কতটা দূষণ হচ্ছে, গ্যাস, ধোঁয়া, ধুলো ইত্যাদি। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি নতুন তথ্য পাওয়া গেছে— যে-সব এরিয়াতে দূষণ বেশি সেইসব এরিয়াতে দেখা গেছে কোভিড সংক্রমণ খুব বেশি ছড়িয়েছে। এখন ঘটনা হচ্ছে সবাই মাস্ক পরে ঘুরছেন, যতটা সম্ভব দূষণ এড়ানো যায় সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন। মানুষের এটাই বদ্ধমূল ধারণা যে যত দূষণ সবটাই বাইরে। যেই আমরা ঘরে ঢুকে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে সব দূষণ চলে গেল কারণ ঘরের ভিতরে আর কোনও দূষণ নেই। কাজেই যেই বাড়িতে ঢুকে পড়লাম বেঁচে গেলাম পলিউশন থেকে।
আরও পড়ুন-অন্দরমহলের তিনকাহন
এখানে ঘর বলতে ক্লোজ স্পেসকেই বলব, সেটা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম হতে পারে, সিনেমা হল হতে পারে, রেস্তরাঁ হতে পারে, নিদেনপক্ষে ট্রেন, বাস, ট্যাক্সিও হতে পারে। অর্থাৎ একটা ঘেরাটোপ— যেটার মধ্যে চলে এলাম মানেই দূষণ থেকে বেঁচে গেলাম।
কিন্তু মজার এবং একইসঙ্গে দুশ্চিন্তার বিষয় হল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাইরের থেকে ঘরের মধ্যে দূষণ অনেক বেশি। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। ঘরের দূষণ মারাত্মক। ঘরের দূষণ বা ইনডোর পলিউশনের কারণে কোভিড অনেক বেশি স্প্রেড করেছে অনেক জায়গায়। এই দু বছরে কোভিডের কারণেই অনেক ধরনের ভেন্টিলেশন সিস্টেম চালু হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায়, নতুন বাড়িতে অনেক নতুন নতুন ভেন্টিলেশন সিস্টেম চালু হয়েছে।
আরও পড়ুন-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসংবাদী আবহ, অবিলম্বে অবসান আবশ্যক
একটা রান্নাঘরে অনেক ধরনের পলিউশন হয়। সেখানে যদি ঠিকঠাক এক্সজস্ট সিস্টেম না থাকে বা জানালা থাকে তাহলে সেই দূষণ রান্নাঘর পেরিয়ে পাশের ঘর সেখান থেকে তার পাশের ঘর এইভাবে ছড়িয়ে যায়। দূষণের মূল উৎস বাতাসের মাধ্যমে যে পলিউশন ভিতরে ঢুকছে। যেমন বড় রাস্তার ধারে যাঁদের বাড়ি, গাড়িঘোড়া চলছে আর গলির ভিতরে নিরিবিলিতে যাঁদের বাড়ি, গ্রামের মধ্যে বাড়ি— এই দুটোর ক্ষেত্রে ইনডোর পলিউশনের তফাত রয়েছে। বাইরের ধুলো-ধোঁয়া বাড়িতে ঢুকলে সেটা আর বেরতে পারে না। ঘরের মধ্যেই রয়ে যায় যদি সেই বাড়িতে খুব ভাল রকমের ভেন্টিলেশন সিস্টেম না থাকে। যেমন এসি এখন বহু বাড়িতে রয়েছে। সেই এসি কিন্তু ভাল করে পরিষ্কার না হলে তা থেকে নানারকম ব্যাকটেরিয়া, ডাস্ট ঘরে ছড়াচ্ছে। কাজেই ঠিকমতো ক্লিন না করলে সেই দূষণ ঘরেই থেকে যাচ্ছে। পাশেই হয়তো ফ্যাক্টরি আছে বা বাড়ির পাশেই কেউ উনুন জ্বালায়। এখন তো রাস্তাঘাটে অলিতে-গলিতে চায়ের দোকান, রুটির দোকান। এগুলো থেকেই দূষণ ঘরে ঢুকে পড়ছে প্রতিনিয়ত আমরা জানতেই পারছি না। তাই এই দূষণকে আমরা বলি আউটডোর পলিউট্যান্ট বা বাইরে থেকে আসা দূষণ।
আরও পড়ুন-ঘরেই বাড়ুক গাছ
রাস্তায় কোনও পাবলিক প্লেসে, কর্মক্ষেত্রে সবার মাঝে ধূমপান করলে মানুষ প্রতিবাদ করবে বা পুলিশ ধরবে বা ফাইন হতে পারে ইত্যাদি ভয় থাকে কিন্তু বাড়িতে ঢুকে সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি খেলে তো কেউ বাধা দেবে না, কিছু বলবে না কিন্তু সেই ধোঁয়া ঘরেই থেকে যাচ্ছে। প্যাসিভ স্মোকিংয়ের শিকার হচ্ছে পরিবার এবং ছড়াচ্ছে মারাত্মক দূষণ। এই সিগারেট স্মোক বা ধোঁয়ার মধ্যে যে হার্মফুল কম্পাউন্ডগুলো আছে যেমন বিভিন্ন সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ফরমালডিহাইড, কার্বনমনোক্সাইড, কার্বন পার্টিকলস রয়েছে যা আমাদের শরীরে বিশেষত ফুসফুসে, পালমোনারি সিস্টেমে গিয়ে আঘাত করে এবং সেগুলো জমে যায়। এর থেকে ব্রঙ্কাইটিস, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, নিউমোনিয়া হতে পারে। এখন চারপাশে খুব কাশি দেখতে পাওয়া যায়। কাশি কমে না, থেকেই যায়। এটার কারণ এই স্মোক থেকে হওয়া ইনডোর পলিউশন।
আরও পড়ুন-১৩ জুন সর্বদল, নিরাপত্তায় কড়া ব্যবস্থা
এরপর আসছে বায়োলজিক্যাল পলিউট্যান্ট বা পোকামাকড়। ঘরে তো আপনি একা নন আপনার সঙ্গে রয়েছে অনেক কীট-পতঙ্গও। মশা, মাছি, মাকড়শা, পিঁপড়ে আরশোলা, টিকটিকি, উইপোকা, ইঁদুর, ছোট ছোট মাইস। এদের সময় সময় আমরা দেখতে পাই মানেই এরা কম শক্তিশালী এটা ভাবা ভুল। এরাই বাড়ির মধ্যে ঘুরছে ক্রমাগত এবং পলিউশন ছড়াচ্ছে ক্রমাগত। চারদিক খুব ভাল করে পরিষ্কার না হয় তবে ধুলো জমবে এবং কীটপতঙ্গের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এদের হাউজহোল্ড পেস্টও বলে। রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকে পড়া দূষণের চেয়ে এরা আরও বেশি ক্ষতিকর। ভেন্টিলেশন সিস্টেম যদি ভাল না হয়, আলো-বাতাস না খেলে তা হলে এগুলো ভীষণভাবেই পলিউশন তৈরি করে। এর থেকেও কফ, কাশি, হজমের গোলমাল, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট— সবকিছুই হতে পারে। এখন আর বাড়িতে ক্রস উইন্ড— দু’দিক মুখোমুখি জানলা বা একটা জানলার উল্টোদিকে একটা দরজা দেখা যায় না যা স্বাস্থ্যকর নয়।
আরও পড়ুন-বিরাট-রাহানের ব্যাটে বেঁচে স্বপ্ন
ফ্যাক্টরিগুলোতে এখন এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেল তৈরি হয়েছে। সেখানকার লোক দেখে ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা কতটা পলিউশনে আক্রান্ত। যত বেশি দূষণ ফ্যাক্টরির কর্মচারীদের ওয়র্ক পারফর্ম্যান্স তত কমে যাবে। ফলে তখন তাঁর ল্যাথার্জি আসবে, কনসেনট্রেশন বা মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে।
ঘরে ফার্নিচারের নতুন রঙ করলে সেই রঙের গন্ধ বা নতুন বাড়ি রঙ করলে যে তীব্র গন্ধ বেরয় সেটা ওইসব রঙের মধ্যে থাকা কেমিক্যালের গন্ধ যা অভ্যন্তরীণ দূষণ ছড়ায়। ধূপকাঠি জ্বালানো হয় এখন প্রতিটা বাড়িতে। সেই ধূপের গন্ধ থেকে পলিউশন ছড়ায়, মস্কুইটো রিপলেন্ট, কয়েল— এগুলো ভীষণভাবেই অভ্যন্তরীণ দূষণ ছড়াতে ওস্তাদ-উপাদান। পারফিউম ব্যবহার করেন মোটামুটি সবাই। বাড়িতে সুন্দর গন্ধের জন্য স্প্রে ব্যবহার করেন। এগুলো প্রত্যেকটাই দূষণ ছড়ায়। এগুলো সবই কেমিক্যালে তৈরি। ধূপকাঠির গন্ধে যতই মন শান্ত হোক তা হাইলি অ্যালার্জিক। সুন্দর গন্ধের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে দূষণ। পারফিউম এবং পাউডারও অ্যালার্জিক যার গন্ধ, পার্টিকলস সব ঘরের মধ্যেই থেকে যায় বাইরে বেরতে পারে না।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বাথরুমে পাওয়া গেল পরমাণু অস্ত্রের গোপন নথি
পোড়া জিনিস ভীষণ দূষণ ছড়ায় ঘরের মধ্যে। যেমন রান্নাঘর থেকে সারা ঘরে দূষণ ছড়ায় বেশি। চা থেকে তরিতরকারি— সবকিছুর ধোঁয়া বেরয়। রান্নার গ্যাস থেকে দূষণ বেশি ছড়ায়। ইনডাকশন ব্যবহার করলে সেই দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। রান্নার ধোঁয়া থেকে দূষণ ছড়ায়। এগুলোকে কম্বার্শন প্রোডাক্টস বলা হয়। সেগুলো বেরতে পারে না। রান্না থেকে নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে থাকে কার্বনমনোক্সাইড, কার্বনডাইঅক্সাইড ইত্যাদি। অনেকে হুঁকো বা পাইপ খান সেটাও ভীষণ দূষণ ছড়ায়। এর থেকে নানা ধরনের রোগ ছড়ায়। বিশেষ করে আমাদের ট্র্যাকিও ব্রঙ্কিয়াল সিস্টেমের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। আরও নানাধরনের রোগ হয়।
আরও পড়ুন-প্রস্তুতি ম্যাচে জয় ডায়মন্ড হারবারের
অ্যাসবেসটস এখন প্রচুর জিনিসপত্রে ব্যবহৃত হয়। অ্যাসবেসটস শিট, শেড থেকে শুরু করে ঘরের ছাত, ফার্নিচারে এখন ব্যবহৃত হয়, মেঝে তৈরি করাও হয়। অ্যাসবেসটসের ছোট ছোট দানাগুলো খুব ক্ষতিকর। এর থেকে লাং ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। পেট্রোল মারফত আসছে লেড। এই দূষণটা আসছে পেট্রোলের ধোঁয়া থেকে। ধরে নেওয়া যাক কারও বাড়ির সামনেই পেট্রল পাম্প রয়েছে। তাঁদের বাড়িতে কনস্ট্যান্ট একটা গন্ধ যায়। কেরোসিন আগে খুব দূষণ ছড়াত। কেরোসিনের ধোঁয়া খুব ক্ষতিকর। এখনও অনেক বাড়িতে কেরোসিন ব্যবহৃত হয়।
ইনডোর পলিউশনের মধ্যে হাসপাতালও পড়বে। যে হাসপাতালের ভেন্টিলেশন সিস্টেম ঠিক নেই, ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল সেইসব হাসপাতালে ঘরগুলো এফেক্টেড হয়, রোগীর জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন-মোদির রাজ্যে দলিত যুবককে পিটিয়ে খুন
অভ্যন্তরীণ দূষণ বা ইনডোর পলিউশন রোধ করতে বাড়ির ভেন্টিলেশন সিস্টেমকে আরও উন্নত করতে হবে। ঘর পরিষ্কার রাখতে, জানলা-দরজা খুলে রাখতে হবে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢোকে। ঘর-বাড়ি যতদূর সম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে। কীটপতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ার ডিম না পাড়ে সেগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। মেঝে পরিষ্কার রাখা, জুতো পরে ঘরে না ঢোকা। রান্নার চিমনি পরিষ্কার রাখা। ধোঁয়া বেরনোর আউটলেট যেন বড় হয়। লেড রয়েছে এমন কিছু ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সস্তার পেন্ট ব্যবহার করা উচিত নয়।
বিভিন্ন ধরনের রঙচঙে খেলনা থাকে ছোটদের। সেগুলোতে একটা গন্ধ থাকে। এগুলো দূষণ ছড়ায় এবং শিশুরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও পড়ুন-আলকারেজের জন্য মন খারাপ জকোর
রাডন নামে একটি গ্যাস রয়েছে, যা মাটির তলা থেকে ওঠে। এই গ্যাসকে রেডিওঅ্যাকটিভ গ্যাসও বলে। এই গ্যাস মাটি থেকে ওঠে। খুব পুরনো বাড়ি যাতে ফাটল রয়েছে, বাড়ির একতলার ঘর, আন্ডারগ্রাউন্ডে যদি কোনও ঘর থাকে, যেখানে ভেন্টিলেশন সিস্টেম নেই সেইসব বাড়িতে রাডন গ্যাস থাকার খুব সম্ভাবনা রয়েছে। যা ভীষণভাবেই দূষণ ছড়ায়। খেয়াল রাখতে হবে ফাটল না থাকে, যাতে গ্যাসটা উপরে উঠে চলে আসতে না পারে।